September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

সব কিছু মেনে নিয়ে নারীবাদী না হওয়াটাই সহজ

কানিজ ফাতেমা।। মেয়েমানুষ অমন জোরে কথা বলতে নেই, পায়ের উপর পা তুলে মেয়েমানুষের বসতে নেই!

ভাবী মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন কবে? বয়স তো কম হলো না।

মেয়েমানুষ ওতো পড়াশোনা করে কী হবে? শেষমেশ তো সেই রান্নাঘরই সামলাতে হবে!

আরে ছেলেমানুষ এমন একটু আকটু করবেই, তোকেই মানিয়ে নিতে হবে।

শোন মা সাবধানে যাস, রাস্তায় কেউ কিছু বললে তুই আবার তর্কাতর্কি করিস না।

জানেন ভাবী, সখিনা আপার মেয়ে না রেপড হইসে, হ্যাঁ হবেই বা না কেন? যে জামা কাপড় পরে।

আচ্ছা এ গেল সমাজের কথা, পাশের বাসার আন্টির কথা, নিজের বাসার মুরব্বিদের কথা। মানে এই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে কোনো মেয়ে যখন বের হতে চায়, নিজের অধিকারের কথা বলে, কোন কোন ক্ষেত্রে অধিকারও না শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্য আওয়াজ তোলে, নিজের মতো করে বাঁচতে চায়, স্বাধীন পোশাক, যা সে পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তা পরতে চায়, তখনই একদল বলে- ‘‘কিরে তুই তো দেখি নারীবাদী হয়ে যাচ্ছিস।”

যে সমাজব্যবস্থায় পুত্র সন্তান নিয়ে গর্ব করে বলা হয় ‘সোনার আংটি বাঁকা হইলেও ভালো’ সে সমাজব্যবস্থায় কেউ যদি আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয় সোনার আংটিই হোক বা নেকলেসই হোক সেটা সোনার দোকানে কালো প্রতিমার গায়ে না উঠলে চমক দেয় না। আর সোনা যদি কোনো মেয়ে গায়ে না ওঠায় তবে এর দাম কানাকড়িও থাকে না। তাহলেই কলরব উঠবে, ‘‘এই মেয়ে তো নারীবাদী।” কেউ যদি বলে ‘‘ছেলেরা যদি সোনার বাঁকা আংটি হয়, তাহলে মেয়েরা হচ্ছে হিরা যা কোনো বাঁকা আংটিতে বসে না।”- তাহলেই সে নারীবাদী।

যে সমাজব্যবস্থা নারীর কপাল ভালো বলতে কেবল তার স্বামীর  উচ্চ পদমর্যাদাকে, আর্থিক স্বচ্ছলতাকে বোঝে, যে সমাজব্যবস্থায় মেয়েকে তার মা বলে ‘‘পড়ালেখা দিয়া কী হইবো, কপাল সুন্দরই আসল সুন্দর। ঈশ্বরের কাছে সবসময় প্রার্থনা করি যাতে ভালো একটা বর পাস, জামাই যাতে শিল্পপতি হয়”- সে সমাজব্যবস্থায় কোনো মেয়ে যদি বলে- ‘‘আমার স্বামীর অনেক আছে মানেই আমার কপাল ভালো তা কিন্তু নয়”, তাহলে অন্তত আমার জন্য করা প্রার্থণাটা না হয় আমারই থাক মা। প্রতিষ্ঠিত জীবনসঙ্গী পাওয়ার প্রার্থণাটা না করে বরং আমার পায়ের নিচের মাটিটাকে আমি যাতে শক্ত করতে পারি সেই প্রার্থণাটাই না হয় করো।  এসব বললেই বলবে, “খুব নারীবাদী হয়েছো!”

যে সমাজব্যবস্থায় ১৭ বছরের মেয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মা-বাবা বলে ১২ বছরের ছোট ভাইটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে সুরক্ষার জন্য, সেই সমাজব্যবস্থায় কোনো মেয়ে যদি বলে বসে ‘‘কেন? ঈশ্বর কি আমাকে একটা হাত কিংবা চোখ কম দিয়েছে নাকি?” ব্যাস, বলবে, “নারীবাদী হয়েছো!”

যে সমাজব্যবস্থায় মেয়েদেরকে বলা হয়- “সন্তান না হলে মহিলা মাইনষের কোনো দাম নাই” সে সমাজ ব্যবস্থায় যদি কেউ বলে বসে নারীরা শুধু সন্তান তৈরির মেশিন না, তাহলেই শুরু হয়ে যাবে, ‘‘ওই যে নারীবাদী আসছে।”

নিজের অধিকারের জন্য আওয়াজ তুললে আর উচিত কথা বললেই যদি সে নারীবাদী হয়ে যায় তাহলে হোক সে নারীবাদী। আর নারীবাদী কি খারাপ কিছু ভাই? এরা নারীবাদ মানে জানুক আর না জানুক নারীবাদীদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ সমালোচনা না করলে এরা নিজেদেরকে একজন আর্দশ পুরুষ ভাবতে পারে না। এরা মনে করে কেবল নারীশিক্ষা মানেই নারীমুক্তি। কিন্তু না ভাই কেবলমাত্র নারীশিক্ষা মানেই নারীমুক্তি না, এদের এটা বোঝানো বড়ই দায়। এরা পূর্ববর্তী নারীবাদীদের সঙ্গে বর্তমান নারীবাদীদের তুলনা করে নানাভাবে বোঝাতে চায় বর্তমান নারীবাদীরা নারীবাদী না বরং সুবিধাবাদী। তবে এরা জানে না শুধু আজকের নারীবাদীরা না, পূর্ববর্তীতেও নারীরা/নারীবাদীরা, যারা তাদের অধিকারের কথা বলে এসেছেন তাঁরাও সুবিধাবাদী খেতাব পেয়ে এদ্দূর এসেছেন, তাঁরাও এদের মতো পচা মস্তিষ্কের মানুষের সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে এসেছেন।

আমি জানিনা কেন আমরা নারীবাদী শব্দটাকে এখনও পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারছি না। কেন আমরা এখনো মনে করি নারীবাদী মানেই কপালে কালো টিপ, স্লিভলেস ব্লাউজ আর হিপোক্রেট? যখন শুনি নারীবাদী মানেই নাকি সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া, স্বার্থপরতা, হিপোক্রেসি- সত্যিই  হাস্যকর লাগে তখন এসব শুনে। আমার তো মনে হয় উল্টো সবকিছু মেনে নেওয়া বরং সহজ। আর নারীবাদীরা এতো এতো সমালোচনার মধ্যদিয়ে যায় যে সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ কোথায়?

অনেকেই মনে করে নারীবাদী মানেই পুরুষবিদ্বেষী। কিন্তু নারীবাদী মানেই পুরুষের শত্রু না। নারীবাদী মানেই পুরুষকে গালি দেওয়া না বরং উল্টো। নারীবাদীরা পুরুষের বিরুদ্ধে না, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এখনো পর্যন্ত অনেকেই মনে করেন নারীর কথা বলা মানে সংসার ভাঙতে চাওয়া, কী আশ্চর্য! নারীবাদী মানেই সংসার নাই। মানে কতোটা বুদ্ধির অভাব হলে আমরা কারো লাইফস্টাইল, ব্যাক্তিগত জীবনের সাথে নারীবাদকে মিলিয়ে ফেলি?

তবে হ্যাঁ অপব্যবহার সবকিছুর হয়, যেকোনো মতবাদ এমনকি ধর্মের পর্যন্ত অপব্যবহার হয়েছে। সেখানে নারীবাদের যে অপব্যবহার দুই এক জায়গায় হবে না, তা আমরা আশা করি  কেমন করে? তার মানে এই নয়, এজন্য পুরো মতবাদকে অশ্লীল আক্রমণ করে খারিজ করে দিতে চাইবো এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]