‘গরুচোর’ মা-মেয়ে ও এক নির্লজ্জ সমাজে নারী উন্নয়নের গপ্পো
শারমিন শামস্।। সবকিছুই কি নিদারুন সহজ হয়ে গেছে! ভয়ানক সব অপরাধ, নারী নির্যাতন নিপীড়ন- সব কি এক যাদু মন্ত্রবলে হয়ে উঠছে নিতান্ত স্বাভাবিক! একের পর এক মধ্যযুগীয় ঘটনায় হতবাক হচ্ছি, এরপর দু’দিনেই ভুলছি। দেশে যদি বিচার, আইন কানুন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী- এত সবকিছু থেকেই থাকে, তবে কী করে সম্ভব হয় ‘গরুচোর’ অপবাদ দিয়ে একজন মা আর তার মেয়েকে বেধে রেখে দিনভর নির্যাতন করা? তাও হাজার হাজার লোকের সামনে?
কক্সবাজারের চকরিয়া। সেখানে বাস করেন একজন মা ও তার তরুণী মেয়ে। যতবার খবরটা পড়ছি, চোখের সামনে একটা নীল কামিজ আর কালো বোরখার অবয়ব চোখে পড়ছে। নিতান্ত নিম্নবিত্তের পোশাক, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা দুটি নারীর অবয়ব, দুটি ‘ঊনমানুষে’র গল্প।
‘গরু চোর’ আখ্যা দিয়ে একদল দুর্বৃত্ত রশিতে বেঁধে নির্মমভাবে পিটিয়েছে এই মা আর মেয়েকে। পরে কোমরে রশি বেঁধে দুই নারীকে প্রকাশ্য সড়ক দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোথায়? স্থানীয় চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে। সেখানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হারবাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম নিজেই সেই মা আর মেয়েকে মারপিট করেছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন, মা-মেয়ের ওপর একদফা নির্যাতন চলার পর হারবাং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) পাঠিয়ে তাদেরকে রশিতে বেঁধে তার কার্যালয়ে এনে আবার নির্মমভাবে নির্যাতন করেন। উপর্যুপরি নির্যাতনে তাদের শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটলে চেয়ারম্যানের লোকেরাই তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে পুলিশ এনে তাদের হাতে মা-মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থায় তুলে দেন। পুলিশ এসে মা ও মেয়েকে ‘উদ্ধার করে’ চকরিয়া হাসপাতালে ভর্তি করে।
কি সুন্দর না? কি দারুন এক নারীবান্ধব পরিবেশ! একটু কেঁচো খুঁড়তেই সাপও বেড়িয়ে আসছে। এলাকাবাসীর ধারনা, মেয়েটি বিয়েতে রাজী না হওয়ায় গরু চোরের অপবাদ দিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
নারীবান্ধব সরকার, নারী উন্নয়ন, সিডও সনদ, নারী অধিকার নিয়ে সভা সেমিনার, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের হাজারো প্রকল্প, নারীর জন্য প্রতিশ্রুতি, নারী শিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান- এই সমস্ত শব্দই কেমন হাস্যকর রকম বেকায়দা আর অশ্লীল লাগছে না? যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন মা তার তরুনী কন্যাসহ হাজার হাজার লোকের চোখের সামনে দিনভর নির্যাতিত হন, সেই সমাজে, সেই রাষ্ট্রে বসে আমরা যদি ওই মা আর মেয়েটিকে স্বনির্ভরতা আর নারী অধিকারের গল্প বলি, তবে এর চেয়ে হতকুচ্ছিত বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। যে রাষ্ট্রের পুলিশ একেবারে মরো মরো মা মেয়েকে শেষ মুহুর্তে ‘উদ্ধার করে’ হাসপাতালে পৌঁছে দেয় আর তার আগের কয়েকটি বীভৎস ঘণ্টার নির্যাতনের খবর তাদের কানেই পৌঁছায় না, সেই রাষ্ট্রের সাথে ঢাকাইয়া বাংলা সিনেমার খুব মিল পাওয়া যায়। এইসব সিনেমায় মেয়েরা এভাবেই পড়ে পড়ে মার খায়, কোন মেয়ে মাথা উঁচু করে পথ চলে না। যদি চলে, তবে গুন্ডাবাহিনী তাদের ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়। জানে মেরে দেয়। এইসব সিনেমায় নারীর মানুষ বলে কোন মর্যাদা নেই। ঠিক যেরকম নেই এই সমাজে, এই রাষ্ট্রে।
একটি দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকা সরকারদলীয় লোকেরা কতটা বাড় বাড়লে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজারো প্রত্যক্ষদর্শীর তোয়াক্কা না করে দুটি নারীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্যাতন করতে পারে- তা ভাবলে যে বিস্ময় ঘটে, যে হতবাক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেই পর্যায়টিও হয়তো আমরা পার করে এসেছি। এখন সব সম্ভবের দেশ এটি। নারীর প্রতি যেকোন ধরণের অসভ্য বর্বরতা ঘটে যাওয়া সম্ভব এখানে। আর বিচার? থাক, সে কথা আর না বলি। আর বলবোই বা কত?
চকরিয়ায় যে বর্বরতা ঘটেছে, তা একমাত্র আদিম বর্বর সমাজেই ঘটা সম্ভব। ২০২০ সালের কোন ডিজিটাল বাংলাদেশে এটি ঘটার কথা নয়। তবু ঘটেছে। ঘটেই চলেছে। এবং আমরা জানি, আরো ঘটবে।
বিচার চেয়ে কী হয়, জানি না। তবু বিচার দাবি করে গেলাম। কঠিন শাস্তি দাবি করে গেলাম। দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক ওই আওয়ামী লীগ নেতার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের। দেশের প্রত্যেকটি নারীকে নিরাপত্তা দিতে হবে। সব নারীকে মর্যাদা দিতে হবে। সুস্থ পরিবেশ দিতে হবে। আর তা দিতে না পারলে গালভরা বড় বড় বুলি আওড়ানো বন্ধ করতে হবে। লজ্জিত হতে হবে। নত হতে হবে নিজেদের ব্যর্থতায়।
ভালো থাকুন। নিরাপদ থাকুন।