September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

একধাপ এগিয়ে, শতধাপ পিছিয়ে যাওয়ার ছবি

সাবিহা ইশরাত জাহান স্টেলা।। স্থায়ী ও অস্থায়ী দুরকমের ট্যাবু হতে পারে। মানুষের কতকগুলো সাময়িক অবস্থা বা তৎসংক্রান্ত ঘটনাকে, যেমন রজঃস্রাব অবস্থায় বা আঁতুড় অবস্থায় নারী, যুদ্ধযাত্রার আগে ও পরের যোদ্ধা, মাছ ধরা ও শিকার সংক্রান্ত আচার-বিচার প্রভৃতি অস্থায়ী ট্যাবু। ধর্ম সংক্রান্ত বাধা-নিষেধের মতো সাধারণ ট্যাবু যদি কোন জেলায় বা বিস্তৃত এলাকায় প্রচলিত করা হয় তাহলে অনেক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। (টোটেম ও ট্যাবু, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, ভাষান্তর: ধনপতি বাগ, দ্বিতীয় অধ্যায়: টাবু ও প্রক্ষোভের উভয়বলতা, পৃষ্ঠা ২৯) এটি গবেষনাধর্মী লেখা নয়, কেবল বিশেষজ্ঞ উদাহরণ আনার জন্য লিখছি বলেই বিবলিওগ্রাফির নিয়ম না মেনেই শুধু কোথা থেকে নিয়েছি তা জানালাম।

এখন কথা হলো লেখার শিরোনামের সাথে ফ্রয়েডিয় উদাহরণের সম্পর্ক কী? আসলে আমরা কি এখন একটি স্থায়ী ট্যাবু সময়কাল পার করছি না? বলতে চাচ্ছি, বোরখা পরিহিত মা-ছেলের ছবিটির কথা। অল্প, স্বল্প, বেশি, অধিক বা ফেসবুকিয় পরিচিতদের বেশিরভাগই প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

যখনই ছবিটিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে কিছু বলতে চাইছেন নারীবাদী বা নারীবাদের সমর্থকেরা, তখনই চরম উত্তেজিত হয়ে উঠছেন সামাজিক বা অসামাজিক সব মাধ্যমের সুশীল সমাজ। হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই ছুঁড়ে মারছেন তাদের দিকে। এই যেমন, জানিনা ওর পোশাক-আশাক, দেখিনা ওর কর্মকাণ্ড, বুঝিনা কী চায়? এজন্যই তো এই ছবিটাকে একটুও ভালো লাগছে না- ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে, চলমান স্থায়ী ট্যাবুর কারণে অনেক জ্ঞানী মানুষও ছবিটিকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে আসলে যে অন্ধত্বকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে চলেছেন সেটা বুঝেও বুঝতে পারছেন না। হয়তো বুঝতে চাইছেন না। কারণ, তারা জানেন এভাবেই তাদের জ্ঞানচর্চা করে চলতে হবে। যাতে থাকবে কিছুটা তাবেদারি, নিজেকে সুশীল হিসেবে জারি রাখার চেষ্টা, সব আধুনিকতা চর্চা করেও শেষমেশ কে কী পরবে এটা তার ইচ্ছে জাতীয় মন্তব্য করে ইতি টানা।

বর্তমান সময়কে চলমান স্থায়ী ট্যাবু কেন বলছি? সিনান মানে ছবিতে ক্রিকেট খেলারত মাদ্রায় পড়ুয়া শিশুটির মা’র পোশাক কিন্তু সাধারণ কোন বোরখা নয়।বাংলাদেশের তীব্র গরমে তিনি মোজা দিয়ে জুতোও পড়েছেন। ক্রিকেটের মতো দৌঁড় ঝাপের খেলায় একবারের জন্য কোন দিক দিয়েও সরে যায়নি তার আভরণ। মানে পরতের পর পরত কাপড় রয়েছে পরনে। আবার, সাধারণত মাঠে ক্রিকেট বা অন্য যেকোন খেলার সময় বাংলাদেশের শিশুদের প্রচলিত পোশাকও নয়। সিনান পরেছে পায়জামা-পাঞ্জাবি।

তো, পত্রিকা ও টেলিভিশনের রিপোর্টের বদৌলতে জানলাম, সিনানের মা তাকে মাদ্রাসায় পড়িয়ে কোরানে হাফেজ বানানোর পাশাপাশি ক্রিকেটার বানাতে চান।  গ্ল্যামারাস ক্রিকেট জগত, টাকা পয়সা, বিজ্ঞাপন, পাঁচ তারকা জীবনযাপন। তিনি নিজে ধর্মের দোহাইয়ে চাপিয়ে দেয়া অন্ধত্বের শিকার তো হয়েই গেছেন। কিন্তু মনে ইচ্ছে আছে আরো একটু আর্থিক স্বচ্ছলতা বা আরাম-আয়েশের।  মাদ্রাসায় না পড়িয়ে যেহেতু উপায় নেই তাই না হয় ছেলে ক্রিকেটারই হলো। পরবর্তীতে না হয় ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে ছেলে কমেন্টেটর না হয়ে স্পিরিচুয়াল মটিভেশনাল স্পীকারই হয়ে রইবে।

এখন কথা হলো এই যে সমাজ তা যে স্থায়ী ট্যাবুর শিকার তা তো বুঝতে পারছেন এবারে। সিনান হয়তো আগামী দশ বছর পরই বিরাটমাপের ক্রিকেটার বনে যাচ্ছে।সেই সাথে উইকি’তে অ্যালমা ম্যাটারে যুক্ত হবে তার বিদ্যাপীঠের নাম। তখন তাতে উৎসাহিত হবেন আরো একাধিক বা লাখোধিক বাবা-মা। তবে, তো তারাও পারেন, সন্তানদের একাধারে বেশ কিছু নৌকায় পা রাখতে শেখাতে! পারেন বৈকি! এই শুরু তো হয়েই গিয়েছে।

এবারে স্বল্প জ্ঞান দিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে চাই স্থায়ী ট্যাবুর ক্ষতিকর দিক। যা ওই ছবিটির মতোই, একধাপ এগিয়ে দশধাপ পিছিয়ে নিচ্ছে আমাদের। নিয়ে যাচ্ছে এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে। সুযোগ করে দিচ্ছে দেশসেরা ক্রিকেটারের স্ত্রীর পোশাক নিয়ে ক্রমাগত ভয়ঙ্কর মন্তব্যকারীদের হাত মকশো করতে, যাতে তারা আরো আরো সব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে পারে। যার ফলস্বরূপ, সুশীল দেশবাসীর পক্ষ থেকে এমন আব্দারও আসতে পারে যে, সিনানের মায়ের মতো পোশাকেই তো খেলতে পারে সালমা-শুকতারারা। হয় তাদের পোশাক পাল্টাও নয়তো নিষিদ্ধ করো বাংলাদেশের নারীদের খেলাধুলো। দাবি উঠতে পারে, জোবেরা রহমান লিনুর পদকগুলো কেড়ে নেয়ার। তিনি তো বেশ আঁটোসাটো পোশাকে খেলতেন এককালে। নারী আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশরী বা যেকোন পেশার নারীদের বাধ্যতামূলক ড্রেসকোডের দাবি ওঠা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আর, যারা ছবিটি ভাইরাল হওয়ার বিরুদ্ধে বলছেন, বোঝাতে চাইছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে মিল-অমিলের কথা, তারা ভাবছেন অনেক গভীরভাবে। যে সমাজে, ধর্ষণের কারণ হিসেবে এখনো আঙুল তোলা হয় মেয়েদের পোশাক, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়, তার জীবনযাপনের ঘরানার দিকে, সে সমাজ তো যে কোন মুল্যেই চাইবে নারীকে আরো বেশি করে আবৃত করতে। বেঁধে ফেলতে শতেক নিয়মের বেড়াজালে। পিছিয়ে দেবে কয়েকশ বছর। একই সময়ে কয়েকধাপ এগিয়ে যাবে অন্য কোন মহাদেশের নারীরা। প্রতিষ্ঠিত করবে নিজেদের অধিকার, শত মাইল বেগে তারা যখন স্পোর্টসকারে গতির ঝড় তুলতে ব্যস্ত তখন আমাদের সুশীল সমাজ মুঠোফেোন টাইপ করছেন, পোশাক যেমনই হোক, তা তো যার যার ইচ্ছে। কিন্তু মনে রাখছেন না বা সমর্থন দিচ্ছেন না এই পোশাকের কারণেই কটু আক্রমণের শিকার হওয়া কোন নারীকেই। খুব কমই কথা বলছেন ধর্ষণ বা এ ধরণের যে কোন ঘটনার বিরুদ্ধে। নারীকে ফিরিয়ে নিচ্ছেন আঁতুড় ঘরে।

স্থায়ী অন্ধত্ব আর গোঁড়ামির দিকে এড়িয়ে নিচ্ছেন সমাজকে। তাই আমার কাছে ছবিটি একধাপ এগিয়ে যাওয়ার হলেও শতভাগ পিছিয়ে যাওয়ার চিত্র।

(ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য)