November 1, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নিজের মানসিকতা দিয়ে সবাইকে বিচার করবেন না

সুবীর সাহা শুভ্র।। আপনারা যার প্রগতিশীল মানসিকতা ধারণ করেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বলছেন বিয়ের ‘প্রলোভন’ দেখিয়ে ধর্ষণ ব্যাপারটাই হাস্যকর। উভয় পক্ষের সম্মতিতেই হয়েছে সহবাস। আবার অপ্রগতিশীল মানসিকতা যাদের, তারাও বলছেন ‘প্রলোভন’ আবার কী জিনিস, সম্পর্ক করেছে আর মজা উভয়পক্ষই নিয়েছে। এটা ধর্ষণ নয়।

আপনাদের দুই পক্ষই অন্তত একটা বিষয়ে একমত হয়েছেন দেখে ভালো লাগলো।

এবার আসেন, অন্যভাবে দেখি একটু এই ঘটনাটা।

প্রগতিশীলরা প্রেম করে প্রগতিশীলদের সাথে, ওদের উভয়ের মানসিকতা এক বলেই প্রেম জমে ওঠে এবং উনারা বিশ্বাস করেন চরিত্র যৌনাঙ্গে থাকে না। সুতরাং উভয়ের সম্মতিতে সহবাস করে বিচ্ছেদ হলেও প্রবলেম নাই। সুন্দর কথা।

এখন প্রশ্ন হলো, আপনাদের মতো প্রগতিশীল মানসিকতা তো সবার নেই, সমাজের মূল স্রোতে যারা আছে, তারা তো আপনাদের মতো ভাবেন না। সেইসব অসহায় মানুষেরা ভাবেন, চরিত্র যৌনাঙ্গেই থাকে এবং একবার যার সাথে সহবাস হয়েছে, তাকেই বিয়ে করা লাগবে। কিন্তু আপনারা বলছেন, স্বেচ্ছায় সহবাস করে পরে ধর্ষণ বলছেন কেন?

ভাই/আপু, স্বেচ্ছায় মানে বুঝেন আগে? প্রেমিক/প্রেমিকা কেউ একজন যদি রাজি না হয় বিয়ের আগে সহবাস করতে, তখন তার অপরপক্ষের মানুষটা কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা দেয়, সেই ধারণা আছে আপনাদের? প্রথমেই বলবে- তুমি আমাকে এই বিশ্বাস করো?
তারপর- তুমি আমাকে ভালোই বাসো না।

– তোমার সাথে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

– কোনো যৌনকর্মীর কাছে যাবো আমি।

– ব্রেক আপ। সম্পর্ক শেষ।

– বিয়ে করতে পারবো না তোমাকে।
– আমার সাথে সহবাস না করলে এখন, বিয়ে করবো না তোমাকে। আর সহবাস করলে সারা দুনিয়া বিপক্ষে থাকলেও বিয়ে করবো।

– তোমার অন্য কারো সাথে অ্যাফেয়ার আছে? তাই ঠকাচ্ছো!

এরকম অজস্র কথা এবং গালিগালাজ আর মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। তারপর যদি এইসব থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনের আশায় মানুষটা রাজি হয়ে সহবাস করে এবং পরবর্তীতে অপরপক্ষের মানুষটা বিয়ে না করে, তাহলে এটা ধর্ষণ নয় কেন?

কৌশলে বা জোর করে কাউকে রাজি করালে কি সেটা স্বেচ্ছায় হয়? আর যদি অনেক দিন কারো সাথে সহবাস করেও থাকে, যখনই সে ‘না’ বলবে, সাথে সাথেই থামা উচিত। না থামলে এটা ধর্ষণ অবশ্যই।

তা ভাই/আপু, নিজের মানসিকতা দিয়ে তো সবাইকে বিচার করলে হবে না। আপনি হলে হয়তো সেই প্রেমিক/প্রেমিকাকে লাথি মেরে চলে আসতেন। কিন্তু কেউ তো থাকে নিজের প্রেমের জন্যে সব করতে পারে। এখন সে ভুল করলেও, বিচার পাওয়ার অধিকার তার আছে।

যে মানুষটা বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগটা এনেছে, তার কাছে বিয়েটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সে যার সাথে সহবাস করেছে, তাকেই বিয়ে করতে চাচ্ছে। তার মানে তার চোখে চরিত্র যৌনাঙ্গে। এখনো আমাদের সমাজে তথাকথিত ‘হাইমেন’ ম্যাটার করে। সুতরাং সে সহজে রাজি ছিলো না সহবাস করতে, জোর করে রাজি করানো হয়েছে। না হলে এই মানুষটা সেই জানোয়ারকে লাথি মেরেই চলে যেতো।

নিজেকে  দিয়ে নয়, সমাজ বাস্তবতা দেখে কথা বলা লাগবে।

আর অপ্রগতিশীল মনের ভাই/আপু, শোনেন, একজন যৌনকর্মীও যদি আপনার সাথে সহবাস করতে রাজি না হয়, তখন যদি জোর করে আপনি সহবাস করেন, তাহলে সেটাও ধর্ষণ। এমন কি, কোনো যৌনকর্মী যদি টাকা নিয়েও নেয়, কিন্তু শেষ মুহুর্তে মত পাল্টায়, তখনও আপনাকে থামতে হবে, অন্যথায় এটা ধর্ষণ হবে।

আর কোন নারী/পুরুষের ধর্ষিত হওয়ার আগে কিংবা পরে ভিক্টিমের সাথে অপরাধীর কী রকম মধুর সম্পর্ক ছিলো এটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হবে আসলেই ধর্ষণ হয়েছে কি না! বিবাহিত জীবনেও স্বামী/স্ত্রী কর্তৃক ধর্ষণ ঘটে। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা- যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।

দেশের আইনগুলো তৈরি হয় সমাজের সকল মানুষের নিরাপত্তার কথে ভেবেই। আপনার বা আমার একক মনোভাবে তো সমাজের সবার মনোভাব প্রকাশ করে না। তাই সবার কল্যাণ নিশ্চিতেই উপযুক্ত আইন তৈরি হয়।

তাই, নিজের মস্তিষ্কের যত্ন নিন, ব্যক্তিগত নয়, সকলের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেকোন বিষয়কে দেখতে শিখুন। ধন্যবাদ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]