November 23, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ধর্ষণের সমাধান কোথায়?

লামিয়া ইসলাম।। কোনো সমস্যা সমাধান করতে হলে তা শুধু বাহ্যিকভাবে বিচার না করে ঘটনার মূলে গিয়ে সংশোধন করা জরুরি। সেরকম ধর্ষণের জন্যও শুধু  ধর্ষককে হত্যা বা লিঙ্গ কর্তনে সমস্যার সমাধান হবে না। হ্যাঁ, ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত অবশ্যই জরুরি। সেই সাথে আরো কিছু বিষয় সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সাথে আরো কিছু বিষয় প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করা দরকার। যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেক্স এডুকেশন জরুরি। একটি বাচ্চার গুড টাচ ব্যাড টাচ সম্পর্কে জানা খুব দরকার। সেইসাথে ছেলেদেরও জানতে হবে কী করতে হবে, কী করা উচিত না, এসব বিষয়ে তাদের পরিস্কার ধারণা থাকা জরুরি। সমাজে মেয়েদেরকে অব্জেক্টিফাই করা, ভোগ্যপণ্য বা খাবার ভাবার যে মানসিকতা তা থেকে বের করা জরুরি। এজন্য সুশিক্ষা চাই। সাথে কাউন্সিলিং করতে হবে। সমাজের মনস্তত্ত্ব না বদলালে  নারী যতই মেধাবী হোক, যে পোশাকই পরুক, বয়স যতই হোক পুরুষের কাছে খাবার হিসেবেই গন্য হবে। এ ধরণের চিন্তা লালন করা কোনো পুরুষের হাত, পা, বা পুরুষাঙ্গ কাটেন বা ফাঁসি দেওয়া হোক তাতে সমাধান আসবে না। আর একজন মরবে বটে, কিন্তু আরো শত শত ধর্ষক জন্মাবে।

ধর্ষণ বন্ধে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার মূলে আঘাত করতে হবে। বোঝাতে হবে মেয়েরা কোনো তেঁতুল, ডিম, চকলেট বা খাবার না। এবং ছেলেরাও হায়না, কুকুর,শেয়াল বা কোনো হিংস্র জীব না। আমাদের সমাজে শেখানোই হয় মেয়েরা খাবার আর পুরুষরা তাকে পেলে খাবেই অর্থাৎ তাদের রেইপ করবেই এটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি  সমাজে আরো কিছু জিনিস শেখানো হয়, যেমন নারীরা দুর্বল, নারীর উপর রাগ হলেই বা প্রতিশোধ নিতে হলে বা প্রস্তাবে রাজি না হলেই তার উপর যৌন নির্যাতন করে শিক্ষা দেওয়া যায়। এতে নাকি নারীর ইজ্জত যায়, নারীর সম্মান যায়।

অথচ সমাজের শেখানো উচিত ছিল উল্টোটা। কোনো মেয়ের সাথে কোনো ছেলে অসভ্যতা করলে ছেলের ইজ্জত যাওয়া উচিত, ছেলের সামাজিকভাবে ছোট হওয়া উচিত, তাকে দুর্বল, অসভ্য হিসাবে সমাজের চেনা উচিত। এর বদলে শৈশব থেকে শেখানো হয়- মেয়ে তুমি দুর্বল, এটা করো না, কারণ তাহলে ছেলেরা হ্যারাস করতে পারে। যেন ছেলেরা তাকে শাস্তি দিচ্ছে, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, এটা হতেই পারে। তার ভয়ে মেয়েদের থাকতে হবে। অথচ এই ভয়টা দেখানো দরকার ছিল ছেলেদের, যে তার মধ্যে এই আচরণের আভাস পেলে তাকে গৃহবন্দি হতে হবে নাহলে মেয়েরা কমপ্লেন করবে।

আমাদের সমাজে মেয়েরা স্বামীর দ্বারা ম্যারিটাল রেপড হলেও তাদের শেখানো হয় আওয়াজ না করতে, কারণ এমন হতেই পারে। আর বাইরে ইভটিজিংয়ে শিকার হলে শেখানো হয় চুপচাপ চলে আসতে, প্রতিবাদ না করতে, এমনকি মেয়েটাকে আরো বেশি বদ্ধ করা হয় যেন দোষটা মেয়ের। অনেক সময় তার পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ে দেওয়ার মতো জীবন ধ্বংসকারী পদক্ষেপও নেওয়া হয়। এতে যা হয়, সমাজ এসব অনৈতিক নিয়মকেই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। যেন এমনটাই স্বাভাবিক।

ছেলে মানেই মেয়েদের সাথে যা ইচ্ছা করতে পারে। এবং একসময় ধর্ষণও তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। এমনকি মিডিয়ায় নাটক, সিনেমাগুলোও এমন যে বারবার একটা মেয়ে না বলার পরও একটা ছেলে তাকে বিরক্ত করবে, হ্যারাস করবে, হাত ধরে টানাটানি করবে, রাস্তাঘাটে ফলো করবে, বন্ধুদের নিয়ে বুলিয়িং করবে। ব্যাপারটা যেন কিউট এবং স্বাভাবিক। অথচ এইসব হয়রানিই একসময় ধর্ষণে গিয়ে শেষ হয়।

সুতরাং সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মুল করতে চাইলে আগে এই পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন আর শিক্ষিত করতে হবে। শিশুকালেই সেক্স এডুকেশন নিশ্চিত করতে হবে। আইন প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই কয়েক প্রজন্ম পরে এর মাত্রা অনেকটা কমে আসবে। আর এই মূল জায়গায় হাত না দিয়ে ধর্ষককে পাথর মেরে, লিঙ্গ কর্তনের মতো বর্বর পন্থা অবলম্বনে কখনোই এর সমাধান আসা সম্ভব না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]