November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নারীবাদ আসলে কী?

তাসনিয়া আল সুলতানা।। আচ্ছা, নারীবাদের সংজ্ঞা আসলে কী?

না মানে, এই প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ নারীবাদ নিয়ে যথেষ্ট ভ্রান্ত ধারণায় ভোগেন। নিজের কথাই বলি। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়, বিতর্ক, অন্যান্য সংগঠন করার সুবাদে অনেকগুলো সার্কেল মেইনটেইন করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় যখন শেষের দিকে তখন বেশিরভাগেরই মুখে একটাই প্রশ্ন শুনি- “তোর বিয়ে কবে খাচ্ছি?” অথবা “বিয়েটা সেরে ফেল, আর কত?” উত্তরে যখন বলি কেরিয়ার গোছানোর আগে বিয়ে করাটা উচিত নয়, তখন বিপরীত পাশ থেকে একটা বাক্যই শোনা যায়- “ধুর, নারীবাদী কথাবার্তা বলিস না তো! বিয়ে করে জামাইয়ের টাকায় বইসা খাবি কত না! এতো চিন্তা কিসের?”

আমার বন্ধুমহলে আমি “ফেমিনিস্ট” হিসেবেই বেশি পরিচিত। কারণ আমার মধ্যে কিছু সমস্যা(!) আছে (তাদের মতে)। প্রথমত, অন্যের কোনো কিছুকে নিজের ভাবতে না পারা, সে যারই হোক না কেন। এমনকি বাবার টাকাকে নিজের ভাবতে পারিনি কোনোদিন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি দীর্ঘদিন যাবৎ বেশ কয়েকটা টিউশন করে নিজের খরচ জুগিয়েছি, এরপর কিছু থাকলে পরিবারেও কন্ট্রিবিউট করেছি। প্রেমিকের সাথে কোথাও গেলে সমান সমান খরচ করেছি, খরচের জন্য প্রেমিকের দিকে চেয়ে থাকিনি কোনোদিন। এমনকি আমার পকেট খালি থাকলে নিঃসংকোচে প্রেমিককে বলেছি “আজ আমার কাছে টাকা নেই, অন্য একদিন।” আমার এ সমস্ত আচরণে প্রেমিকও খানিক বিরক্ত।

দ্বিতীয় যে সমস্যা(!) আমার মধ্যে বিদ্যমান সেটি হলো আমার অতিমাত্রায় আত্মসম্মান প্রবণতা। পরিস্থিতি যেমনই হোক, নিজের আত্মমর্যাদার সাথে আপোষ করিনি কোনোদিন। অনেকসময় আমাকে উদ্দেশ্য করে আম্মাকে বলতে শুনেছি, মেয়েদের অনেক বুঝেশুনে পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে আপোষ করে চলতে হয়, তা নাহলে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে টিকে থাকতে কষ্ট হয়ে যায়। কারণ আম্মার মতে আমি খুব বেশি এক্সপ্রেসিভ, স্ট্রেইটফরোয়ার্ড এবং খোলামেলা মানসিকতার মেয়ে এবং বিয়ের পরেই নাকি এসবের খুব একটা ভ্যালু থাকে না, সংসারের কষাঘাতে আত্মসম্মান জানালা দিয়ে পালায়!

আব্বাকে হারালাম ছ’মাস হতে চলল। যেহেতু আমার কোনো বড় ভাই নেই, পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব এখন মোটামুটি আমার কাঁধের উপর বললেই চলে। আচ্ছা, একজন মেয়ে হয়ে যখন আমি পরিবারের খরচ যোগান দিই তখন তো কাউকে দেখি না সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে। কিন্তু একই কথা যখন আমি মুখে বলি, তখন আমার কপালে ট্যাগ লেগে যায় “নারীবাদী!” অর্থাৎ বেশিরভাগেরই মতে নারীবাদ মানেই হল নেগেটিভিটি, নারীবাদ মানেই সমাজের বিরুদ্ধাচারণ।

কথায় কথায় ধর্মের রেফারেন্স টেনে আমার বন্ধুরা বলে শরীয়াহ আইন অনুযায়ী স্ত্রীর ভরণপোষণের সকল দায়িত্ব স্বামীর উপর বর্তায়। আমিও ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ। আমি জানি স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর। কিন্তু শরীয়াহ আইনে তো এটা উল্লেখ নেই যে দুজনের সমান কন্ট্রিবিউশন থাকতে পারবে না। এবং ধর্মমতে এ বিষয় নিয়ে কোনো বিধিনিষেধও নেই। বরং বলা হয়েছে, স্ত্রী চাইলে তার খুশিমতো স্বামীর জন্য বা পরিবারের জন্য খরচ করতে পারবে। যে কথা ধর্মে উল্লেখ আছে সেকথা সঠিকভাবে প্রচার না করে একপাক্ষিকভাবে সকল দায়িত্ব পুরুষের উপর দিয়ে আমরা কি পুরুষতন্ত্রকে প্রোমোট করছি না?

আমি শুধু “নারীরা পারে” কিংবা “শুধু পুরুষ পারে” এই নীতিতে বিশ্বাসী নই। আমি স্বাভাবিকতায় বিশ্বাসী আর স্বাভাবিকতা হলো নারী হোক কিংবা পুরুষ, একজন মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি প্রত্যেকের সমান দায়িত্ব এবং অধিকার রয়েছে। আর এটাই হলো নারীবাদ। নারীবাদ মানেই স্বাভাবিকতা, পুরুষকে হটিয়ে একপাক্ষিকভাবে সমাজে রাজত্ব স্থাপন নয়। বরং পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমতার সাথে চলার নামই হলো ফেমিনিজিম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো এই একটি সামান্য স্বাভাবিক বিষয়কে আমরা খুবই নেতিবাচকতার সাথে উপস্থাপন করে ফেলছি। কদিন আগে ফেইসবুকে একটা মিম দেখেছিলাম, যেখানে লেখা ছিল তালাকপ্রাপ্তা, নারীবাদ শব্দের সমার্থক! বেশিরভাগেরই মতে তালাকপ্রাপ্তা নারী বা একাধিক পুরুষ দ্বারা নিগৃহীত নারীরা যখন ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে যায়, তখনি তারা নারীবাদের বুলি আওড়ায়! আমি তো শুধু একটা ধারণার কথা বললাম, সমাজে এমন নেতিবাচক বহু ধারণাই প্রচলিত আছে নারীবাদ নিয়ে।

আমার কাছে নারীবাদ মানে হলো স্বাভাবিকতা, যে স্বাভাবিকতা প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের থাকা উচিত। আর যতদিন সমাজে এই স্বাভাবিক মন-মানসিকতা আসবে না ততদিন স্লাট শেইমিং থাকবে, ধর্ষণ থাকবে। আমি বিশ্বাস করি, একদিন সমাজের চেতনায় পরিবর্তন আসবে, সবকিছু একদিন স্বাভাবিক হবে, অবশ্যই হবে। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা অর্জন করতে সমাজের প্রতি স্তরে পরিচ্ছন্ন স্বাভাবিক মানসিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযান চালাতে হবে। তারপর লক্ষ্য অর্জন হলেও হতে পারে। এখনও আরো বহুদূর পথ পাড়ি দেওয়ার বাকি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]