ধর্ষণের মানসিকতা গড়ে ওঠে পরিবার থেকেই
শাকিল মাহমুদ।। ধর্ষণের মানসিকতা গড়ে ওঠে ছোটবেলায়, পরিবার থেকে। ছোটবেলায় মা-বাবা আদর-সোহাগ করে সন্তানকে বোঝায় বড়দের সম্মান করতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তাদের বেশিরভাগই কখনো নারীকে সম্মান করার শিক্ষা দেয় না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে ভাবুন, আপনার পরিবার আপনাকে কি কখনো বলেছে – নারীকে যথার্থভাবে সম্মান করতে? রাস্তায় নারীদের দেখলে চোখ না মেরে, আকার ইঙ্গিতে নানা কথা না বলতে?
আজকাল হরহামেশাই দেখা যায় সভ্য দেশগুলোর কিছু ভিডিও, যেখানে অল্পবয়সী তরুণরা বয়ঃজ্যেষ্ঠদের রাস্তা পার করে দিচ্ছে কিংবা পরিবহনগুলোতে নারীকে আসন ছেড়ে দিচ্ছে- দেখা যায়। সেগুলো আমরা দেখি, দেখে জ্ঞানী বয়ান দেই। কিন্তু এই আমরাই রাস্তায় একজন সুদর্শন নারীকে দেখলে ১০০ গজ দূর থেকে হলেও পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তার নিতম্ব কত ডিগ্রিতে দোল খায়। এসব দেখে আমরা পাশবিক আনন্দ পাই। কিন্তু এ আনন্দের গোড়াপত্তন হয়েছে পরিবার থেকে।
নারী যে আমাদের মতই মানুষ, যৌনতার গোডাউন নয়- এ শিক্ষাটা ছোটবেলায় মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরিবারের, যা বেশিরভাগ পরিবারেই করা হয় না।
আজকের এই ধর্ষণ- এর পেছনে ধর্ষকরা যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী তার পরিবার। ধর্ষণ রোধের জন্য ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করা, ফাঁসি দেয়া কোনো সমাধাণ নয়।
আমাদের এদেশের বাম নামধারী বিপ্লবীরা ভোটে দুটো আসন পেলে দু’হাত তুলে ধেইধেই করে নাচে। কিংবা ঘেরাও সমাবেশে বেরিক্যাড উল্টে দিতে পারলেই মনে করে আন্দোলন সফল। কিন্তু আদতে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি আরো গভীরের বিষয়, লড়াইয়ের বিষয়, যেটা আদৌ আমরা উপলব্ধি করতে পারি নি বলেই মুক্তি আজো মরীচিকা। তেমনই ফাঁসি কোনো সমাধান নয়। সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার যে প্রয়োজনীয়তা তা নিয়ে পরিবারকেন্দ্রিক কাজ করার যে প্রয়াস তা আমাদের নেই।
মোমবাতি হাতে, প্ল্যাকার্ড হাতে চিল্লালে ক্ষুধার্ত শিশুর মত আপনারব দাবি হয়তো রাষ্ট্র মেনে নেবে। কিন্তু নারীর উপর ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ করতে পরিবারগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। বড়দের সম্মান করো, গায়ে পা লাগলে স্যরি বলো – বাক্যগুলোর শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে শেখাতে হবে, নারী ও পুরুষ এক, নারী মানুষ। নারীকে সম্মান দিতে হবে। রাস্তায় নারীকে দেখলে লকলক জিভ বের করা কোনো মানুষের কাজ নয়৷
আমাদের সমাজের একটি বদ্ধমূল, প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা- বয়স হলেই ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। এতে তারা উচ্ছৃঙ্খল হবে না। মূলত ছেলেরা বাইরের মেয়েদের দিকে কু নজর দেবে না। তার মানে বাইরের কু নজর ঘরের নারীর উপর ফেলো!(?)
আমি মনে করি বিয়ে নামক বিষয়টাও পুরুষকে আরো জন্তুতে পরিণত করে। কেননা, আমাদের সংস্কৃতিতে বিয়ে মানেই নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রয়োগের আইনানুগ বৈধতা পাওয়া। ফলে স্ত্রীর প্রতি স্বামী যাই-ই করুক না কেন, সেটা বৈধ। যার কারণে স্বামীর ইচ্ছে হলো আজ সেক্স করবে, বাসায় এসে স্ত্রীর ইচ্ছের পরোয়া না করেই শুরু করে দিলো! এটা যে ধর্ষণ সেটা এ সমাজে আপনি বলতে পারবেন না, কারণ পুরুষ আইনগতভাবে এই বৈধতা পেয়েছে। ফলে বিয়ে নামক বিষয়টা মানুষকে কখনোই শৃঙ্খলিত জীবন দেয় না বরং আরো উগ্র করে তোলে।
মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের পরিবার এবং সমাজ উভয় পক্ষের প্ররোচনাতেই হয়। ফলে ধর্ষকের উপর চড়াও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ও সমাজের উপরও আমাদের নজর দেয়া উচিত- যেটা দিচ্ছি না, এড়িয়ে যাচ্ছি। যার ফলে দিনকে দিন ধর্ষণ কমছে না, বাড়ছে। সেটা রাস্তায় হোক কিংবা ঘরে৷
সেদিন একটি গ্রুপে একজন নারী বলছেন, তিনি নিরাপদে ঘরে যেতে চান। এর প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি ঘরেও নিরাপদ? জবাবে বললেন, যেহেতু বিয়ে করেননি সেহেতু ঘরে এমন কোনো নিপীড়নের শিকান হননি ৷ ফলে ঘরকেই তিনি নিরাপদ মনে করেন। এবং এ নিয়ে এখন প্রতিবাদ করবেন না যতক্ষণ না তিনি তার শিকার হচ্ছেন!
কথাগুলো শুনে আমি খানিকক্ষণ হাসলাম এবং সেই সঙ্গে ভাবলাম, ধর্ষণ হওয়ার পর আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে এটা নিয়ে কথা বলা উচিত! মানুষের যাতে কোনো রোগ না হয় সে কারণে কত কত সতর্কতা। এই যেমন ধরুন করোনার সময়ে, আমাদের যাতে করোনা আক্রমন না করে সে কারণে মাস্ক, হ্যান্ড সেনিটাইজারসহ কত হাইজেনিক বিষয়াবলি আমরা মানছি। ধর্ষণের বিষয়টাও ঠিক তেমনই। এটা থেকে রেহাই পেতে আমাদের পরিকল্পনাগুলো করা উচিত আগে থেকে। অর্থাৎ পরিবার থেকেই শিক্ষা দেয়া উচিত, নেয়া উচিত।
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। যার প্রতিকারের প্রতিষেধক রয়েছে একমাত্র এবং একমাত্র পরিবারের হাতেই। ফলে প্রতিটা পরিবারের উচিত সন্তানকে এ বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দেয়া।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]