মগজের পরিবর্তন জরুরি
শাকিল মাহমুদ।। আক্ষরিক অর্থে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার কালো করা, মেয়েদের মার্শাল আর্ট শেখা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রতিবাদগুলো নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নয়। বরং নারী নিপীড়কদের এই রাষ্ট্র লালন-পালন করতে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি করেছে – তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
আজকে অনেকেই নারীদের মার্শাল আর্ট শেখার সুপরামর্শ দিচ্ছে; নিঃসন্দেহে স্বীকার করে নিতে হবে, নারীর নিরাপত্তা নারীকেই দিতে হবে। কিন্তু এতে করে ধর্ষণকে আপনি রোধ করে ফেলবেন ভাবলে বড্ড বড় ভুল করবেন। আজকে হয়তো সব ধর্ষককে ধরে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হল। কিন্তু কালকেই যে কেউ ধর্ষণ করবে না তার নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারবেন?
এই যে আজকের পৃথিবী করোনাকে এক প্রকার বশে এনে তাকে নিয়ে চলতে শিখে গেছে। তার মানে তো এই নয় কেউ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে না! আজকেও জানা গেলো অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তার মত দুনিয়ার আনাচে কানাচে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। কিন্তু করোনার থেকে সম্পূর্ণ রেহাই পেতে হলে তাকে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে ভ্যাকসিনের প্রয়োজন। তেমনই ধর্ষণকে সমাজ থেকে বিদেয় করতে হলে আপনার যে একখণ্ড মগজ রয়েছে মাথায়, তার ক্রিয়ার ফলে যে ভাবনার উদয় হয় – তার পরিবর্তন করা কতটা জরুরি, সে সম্পর্কে জানতে হবে।
এই যে সারা বিশ্বের মধ্যে এ বছর জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে ধর্ষণের গড় অনুপাত ৯.৮০। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। এই অনুপাতটা আকস্মিকভাবে এ বছরই ঘটে নি। বরং ধীরে ধীরে আজকের এ অবস্থানে এসেছে। এর পেছনে বরাবরের মতই দায়ী পারিবারিক এবং সামাজিক শিক্ষা, কারিকুলামে নৈতিকতাবোধ তৈরি এবং যৌন শিক্ষার উপর পাঠদানে ব্যবস্থা না থাকা। অর্থাৎ ধর্ষণের বীজ বপন হয় জন্মের পর থেকে, পরিবার এবং সমাজের মাধ্যমে। তা হৃষ্টপুষ্ট করার দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র, শিক্ষার মাধ্যমে। অত্যন্ত রক্ষণশীল আমাদের পরিবার, সমাজ ব্যবস্থা। শিশ্ন বা পেনিস, জরায়ু বা ভ্যাজাইনা, সেক্স , ধর্ষণের মতো শব্দগুলো অভিভাবকরা সন্তানদের সামনে উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না। তারা নিজেরাই যদি এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন, তবে নিজের সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেবেন তারা?
সমাজ, পরিবার কেউই সম্মতি নামক শব্দটির সঙ্গে পরিচিত না। একজন পুরুষ চাইলেই একজন নারীর অনুমতি ব্যতিত শরীরে স্পর্শ করতে পারে না- তার জন্য সম্মতির প্রয়োজন হয়, সে বিষয়টি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই সমাজ, পরিবারের। ফলে ধর্ষণ ঘরে ঘরে, স্বামীর দ্বারা স্ত্রীও ধর্ষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে আপনাকে যদি ধর্ষণ শব্দটি এবং ধর্ষণ নামক অপরাধটিকে সমাজ থেকে মুছে দিতে হয় তাহলে প্রোফাইল পিকচার কালো করা, মেয়েদের মার্শাল আর্ট শেখার সু-পরামর্শের পাশাপাশি এদেশের পারিবারিক ও সামাজিক অবকাঠামো এবং কারিকুলাম শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে হবে। আর সেই কথা বলার জোরটা হতে হবে প্রবল।
একদল প্রোফাইল পিকাচার কালো করে একটি প্রতিবাদ করার যে প্রচলন শুরু করেছে এবং তার প্রেক্ষিতে যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছে তা নিতান্তই বাচ্চা সুলভ। একদিন নারী না থাকলে পৃথিবীর কি অবস্থা হয় তা দেখানোর জন্য প্রোফাইল পিকচার কালো করুন! অদ্ভুত এবং খোঁড়া একই সঙ্গে হাস্যকরও বটে। নারীকে পৃথিবীতে রাখার জন্য তাদের ধর্ষণ করা হয়? পাঁজরের হাড় ভেঙে দেয়া হয়, জিভ, যোনী কেটে ফেলা হয়? পুরুষ চায়ই নারীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। আর আপনারা একদিন গর্তে লুকিয়ে থেকে বোঝাবেন, নারী ছাড়া পৃথিবীর কী অবস্থা হয়! দুখের দিনে বড্ড হাসি পাচ্ছে। ভাইরাল প্রবণতা থেকে বের হয়ে যদি প্রতিবাদই করতে চান তবে আসুন না, শাহবাগে আমরণ অনশন করি! যতদিন ধর্ষকদের চূড়ান্ত শাস্তি না হবে, এদেশের নারীকে পারিবারিক, সামাজিক ভাবে হেয় করার মানসিকতা দূর না হবে, শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী-পুরুষ বৈষম্যমূলক অবস্থার পরিবর্তন না হবে ততদিন চলবে এ অনশন। আসুন না, দেখি – ফুসফুসে কত দম! পুরুষকে জিতিয়ে দিতে চান কেন? সাহস নিয়ে আসুন, প্রয়োজনে লড়ে মরে যান – তবুও আরো দশজন নারীকে জাগিয়ে তুলুন, লড়াইয়ের শক্তি দিয়ে যান।
মার্শাল আর্ট নারীর অবশ্যই অবশ্যই শেখা উচিত। এ পরামর্শদাতাদের সাধুবাদ দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু মার্শাল আর্ট শিখে নারী হয়তো নিজের নিরাপত্তা নিজেই দিতে শিখলো। কিন্তু সমাজে নারী তো সেই অবহেলার, নিপীড়নের বস্তু হিসেবে মগজে থেকেই গেলো! সেটাকে সরানোর পরামর্শ দেবেন না? প্রতিটা নারী মার্শাল আর্ট শিখলো, কিন্তু মগজে যুগে যুগে পোষণ করে রাখার যে সংস্কৃতি সেটা কি মার্শাল আর্ট দিয়ে ফাটিয়ে ফেলতে পারবেন? যদি পারেন তবে শিখুন, শেখান। কিন্তু আদতে মার্শাল আর্ট নারীকে সাময়িক নিরাপত্তা দিলেও চূড়ান্তভাবে নারী পুরুষের, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মগজে ভোগের বস্তুই থেকে যাবে। ফলে, মগজকে পরিষ্কার করতে হবে। সেটা না হলে যতই মার্শাল আর্ট শিখুন না কেনো, কব্জির জোর বাড়িয়ে পুরুষের থুতনিতে ঘুষি বসান না কেনো নারীকে রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
সুতরাং বাচ্চাসুলভ, আবেগী মতামত সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়তো আত্মতৃপ্তি পাবেন, তারুণ্যের জোশে অনেক কথা বলেই নিজেকে সান্তনা দিতে পারবেন। কিন্তু নারী থেকে যাবে ভোগের বস্তু হয়ে এ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]