ভাষার রাজনীতি ও পলিটিক্যাল কারেক্টনেস
অনুপম সেন অমি।। Feminisits Across Generations নামের একটা ফেবু গ্রুপ থেকে এই পোস্টার শেয়ার করা হয়েছে। বন্ধুদের টাইমলাইনে এই পোস্টার খুব শেয়ার হচ্ছে দেখে ভালভাবে বুঝার চেষ্টা করলাম কি ম্যসেজ আছে এতে। যা বুঝলাম, মোটামুটি অনেকেই এই পোস্টারে সাঁটানো বিধিনিষেধগুলোকে খুব আমলে নিয়েছে এবং কেউই এই নিষেধনামাগুলোকে নিজেদের উপর আরোপিত হয়েছে বলে একেবারেই ভাবছে না। ভাবার কথাও না। আমিও যা বুঝি তা হল, যে উদ্দেশ্যে এই পোস্টারের প্রচার তা খুবই মহৎ। এইখানে কোন ফায়দা নেওয়া বা তোলার চিন্তা নাই। মূলত চলমান ধর্ষন-বিরোধী আন্দোলনের সাথে নিজেদের একাত্মতা পোষণ করেই এই পোস্টার করা।
তবে আমি জানি না এই পোস্টার কি এই গ্রুপের বানানো নাকি অন্য কোন সোর্স থেকে এইটা নেওয়া হয়েছে। যদিও আমার লেখার জন্য পোস্টারের সোর্স জানা মোটেও দরকারি না কেননা আমি এই টেক্সটের ভাষা কীভাবে একেবারে ভিন্ন অর্থ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হতে পারে সেই সম্ভাবনাকে এড্রেস করতেই শুধু লিখছি। আমি দেখাতে চাইছি কীভাবে এই পোস্টারের উদারনৈতিক উদ্দেশ্য ও বক্তব্য নিজেই আরেকটা বাইনারি রাজনীতি তৈরি করছে/করতে পারে।
প্রথম নিষেধ: ধর্ষককে এনিম্যাল/মনস্টার বা সাইকো ডাকা যাবে না। ভাল প্রস্তাব। কিন্তু কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ডাকা যাবে না কারণ তারা হতে পারে আমাদেরই একজন। আমাদেরই কেউ। এখন এই চিন্তা নিজেই তো একটা আধিপত্যপরম্পরা (hierarchy) ভেতরে পোষণ/তোষণ করতেছে। ‘আমাদের/তাদের’ বিভাজন তৈরি করছে। করতেছে না কি? এর মানে দাঁড়াইতেছে, এনিম্যাল/মনস্টার বা সাইকো এরা খারাপ আর ‘আমাদের’ এইসব নামে ডাকা অবমাননাকর। এইটারে কি বলবেন? এথনোসেন্ট্রিজম? এইখানে বর্নবাদ নাই কি? ‘অপর’ মনে/তৈরি করার প্রবণতা নাই কি?
খুব খেয়াল করলে হয়তো বুঝি যে এই নিষেধ-বাণী মূলত ‘অপরিকরণ’ ঠেকানোর জন্যেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শব্দের ব্যবহারের মাঝে ‘Other’ করার যে প্রবণতা তা এইখানে সমস্যাজনক হয়ে উঠেছে। পুরো বাক্য পড়লে মনে হয় চিরাচরিত আধিপত্য-পরম্পরাকেই এই বাক্য পুনরুৎপাদন করতেছে। হিউম্যান/এনিম্যাল অথবা মানুষ/মনস্টার এই ধারণা এইখানে ফিরে আসতেছে। এই ‘অপরিকরন’ যে ইচ্ছাকৃত করা হয়েছে তা হয়ত নয়। তবে এইটা বুঝা যায় এই বাইনারি চিন্তা ভাষার ভেতরেই লুকিয়ে আছে। মূলত ভাষার ভেতরে অবস্থান করে যে চিরাচরিত ক্ষমতা-কাঠামোর বোধ সেই কাঠামোকে অস্বীকার করার জন্য যখন কোন নতুন চিন্তা উৎপাদিত হয়, সেই নতুন চিন্তার ভাষাও যে আরেকটি আধিপত্য-রেখা নির্মাণ করতে পারে তা বুঝতে হলে এই টেক্সট উদাহরণ হিশেবে সামনে আনা যেতে পারে।
দ্বিতীয় নিষেধ: ভাল প্রস্তাব। এই ইনক্লুসিভ এপ্রোচ ভাল এতে ‘অপর’ ভাবার প্রয়াস কমে আসে অথবা কোন শ্রেনি সহজেই প্রান্তিক হয়ে পড়ে না। নিদেনপক্ষে আলাপে উঠে আসে। কিন্তু দ্বিতীয় নিষেধ মানলে প্রথম নিষেধের যে পৃথকীকরণ প্রয়াস সেইটারে অবশ্যই প্রশ্ন করা উচিত। নয় কি?
তৃতীয় নিষেধ: ‘ধর্ষিতা’ এবং ‘নির্যাতিত’ বলা বন্ধ করতে হবে। কেন? শব্দ নিজে তো কোন অর্থ বহন করে না। অর্থের অবস্থান তো শব্দের বাইরে। তাহলে ধর্ষিতা এবং নির্যাতিতা শব্দের মধ্যে ‘অপমানত্ব’ কে আরোপ করতেছে? ধর্ষনের শিকার বললেই এই অপমানত্ব ঘুচে যাবে? শব্দের মধ্যে যেহেতু অর্থ নাই তাহলে বুঝতে হবে এই অর্থ সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে উৎপাদিত হইতেছে। যে সমাজ ও পুরষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই অপমানত্ব নারীর অবস্থানের উপর আরোপ করতেছে এইটাকে চ্যালেঞ্জ না করে পুরো শব্দ পরিবর্তন করতে বলা কোন কাজের কাজ না। আবার, যে শব্দ প্রস্তাব করা হচ্ছে “ধর্ষনের/নির্যাতনের শিকার” এই শব্দবন্ধ নিয়া যে প্রশ্ন তোলা হবে না বা এইখানে অপমানত্ব আরোপ হবে না তা কেমনে বলা সম্ভব? কেউ যে শিকারি-শিকার সম্পর্ক এই শব্দবন্ধে খুঁজে পাবে না এবং এইটা নিয়ে আপত্তি তুলবে না তা কি কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি? কোন বিশেষ শব্দ অনুমোদন করতে না পারার রাজনীতিকেও এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা উচিত বলে মনে হয়। শব্দের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়তো ব্যক্তির আইডেন্টিটির ধারনার ফিক্সিটি বদলানো যাবে কিন্তু ট্রমা এবং সার্বিক অপমানত্বের যে অভিজ্ঞতা সেইটা পাল্টানো যাবে কিনা সেই সন্দেহ থেকেই এই আলাপটা তুলেছি।
যাই হোক, আমার মতামত হল এইরকম অথরিটি নিয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করে অন্যকে পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকা/করার চেষ্টা করা নিজেই একটা স্বেচ্ছাচারী প্রয়াসে পর্যবসিত হতে পারে শেষ পর্যন্ত। সেই সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের নারীবাদী চিন্তকদের এবং অন্যান্য তাত্ত্বিক/চিন্তক বর্গের ভাবার সময় এসেছে বলেই মনে করি। কেননা ক্ষমতার রাজনীতিকে বন্ধ/প্রশ্ন করতে গিয়ে নিজেরাই যদি অন্য কোন ক্ষমতা-কাঠামো নির্মাণ করি তা আখেরে ভাল কিছু আনবে না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]