November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর জন্য নোংরা নিয়ম বানানো কি সমাজ বন্ধ করবে?

প্রিয়া দেব।। বয়স যখন সাড়ে তিন তখন আমি প্রথম চাইল্ড মলেস্টেশনের শিকার, সালটা তখন কতোই বা? ২০০২ কিংবা ২০০৩। তখনো নারীর জীবনে অত আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। সন্ধ্যার আগে বেশিরভাগ মেয়েকে বাড়ি ফিরতে হতো, মা বাবা যাকেই পাত্র হিসেবে আনতো, মেয়েরা হাসিমুখ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়তো, পছন্দ বা প্রেম করে বিয়ে করা তখন ভয়ানক ব্যাপার, নিজের পছন্দে বিয়ে করা মেয়েরা ছিলো ভয়ানক খারাপ উদাহরণ, যে মেয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে, বিয়ে হচ্ছে না তাকে নিয়ে চলতো ভীষণ সব কুৎসিত আলোচনা। মেয়েদের চাকরি বলতে বড় জোর স্কুল টিচার হওয়ার অপশন ছিল,আর পরিবার পরিকল্পনাতে চাকরি করা মেয়েদের দেখা হতো ভীষণ খারাপ চোখে।

১৮ বছর পরে সমাজ ব্যবস্থা কিছু আধুনিক হলেও পুরোপুরি বদলায় নি। এখন প্রশ্ন হতে পারে কেন আমি সেসব গল্প বলছি। বলছি কারণ তখন রাস্তাঘাটে মেয়েদের সহজে দেখা মিলতো না। কেউ নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হলে কাপড় দায়ী বলে শেয়ালের শোরগোল উঠতো না। কিন্তু তারপরও আমি তিন বছর বয়সে মলেস্ট হয়েছি। কাছের আত্মীয়র দ্বারাই হয়েছি।

একটু বড় হবার পর যখন সে ঘটনা যখন বুঝতে পেরেছি ততোদিনে আমার পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার অস্বাভাবিক জীবন শুরু তখন থেকে। বড় হতে হতে দেখেছি, একটু বড় হলেই মেয়েদের কেউ খেলার মাঠে পাঠাতো না, কারণ মেয়ের উপর লোকের নজর পড়তে পারে, সহশিক্ষা মেয়েকে বিগড়ে দিতে পারে, মেয়েদের যত কম লোক দেখবে ততো মেয়ের মান মর্যাদা বাড়বে, কিন্তু সেই মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য একের পর এক পাত্রপক্ষের সামনে মা বাবা ভোগ্যপন্য হিসেবে সাজাতে কার্পণ্য করতেন না। কারণ তখন মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। সমাজের সংজ্ঞা হিসেবে যে মেয়ে কম কথা বলে, আস্তে হাঁটে, গলা উঁচু করে কথা বলে না, বড়দের সব কথা মেনে চলে, পরপুরুষ যাকে দেখেনি, সে মেয়ে ভালো, বরপক্ষের কাছে তাদের চাহিদা বেশি। আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়া মেয়েগুলো ভীষণ খারাপ। সমাজে এরা কোনো সমস্যায় পড়লে সমাজের লোকেরা বলতেন বেশি পড়াশুনা করলে, চাকরি করলে মেয়েদের এরকম হবেই।

এরপর সমাজে পরিবর্তন আসলো, বরপক্ষের লোকেরা পড়াশুনা জানা মেয়েদের প্রাধান্য দেওয়া শুরু করলেন, কারণ শিক্ষিত মেয়ে ঘরের শোভা বর্ধন করে। এখানেও নারীর পরিচয় শোভাবর্ধক আসবাব হিসেবে। নারী সেখানেও মানুষ নয়, শুধুই আসবাব, শিক্ষিত মেয়ে ঘরের কাজ করছে তা দেখতেও শান্তি, পদার্থবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া মেয়েটা রান্নাঘরে বাড়ির সবার জন্য খাবার তৈরি করছে সে খাবারের শান্তিই অন্যরকম। সমাজ খুব সহজে এখানে একটা জিনিস দেখাতে চেয়েছে, সেটা হলো একটা মেয়েকে শিক্ষিত করেও কী করে তার গন্ডি রান্নাঘরে আটকে রাখতে পেরেছে সেই চমৎকার দৃশ্য।

যুগ পাল্টেছে, কিন্তু নারী ভোগ্যপন্য হিসেবেই রয়ে গেছে। এখন চাকুরীজীবী মেয়েদের প্রচুর মর্যাদা বরপক্ষের কাছে, কারণ আর্থসামাজিক বদল ঘটেছে। তারপরো চাকরি করে নারী ঘর সংসার সামলালে তার মূল্য আছে নতুবা নেই। চাকরিজীবী নারীকে বলা হয় “এটাতো তোমার সংসার, তুমিই দেখবে”। মানে চাকরি করে, পুরুষের সমান খাটনি খেটেও সংসারের প্রতিটা কাজ করা নারীর দায়িত্ব, কিন্তু যে সংসারটা পুরুষেরও, সে সংসারের অর্ধেক দায় পুরুষেরা নেন না। সমাজ নিতে দেয় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন নারী বিরাট বিরাট ডিগ্রিধারী হয়েও ঘরে বসে থাকবেন, স্বামীর সংসার দেখবেন, কারণ সেটাই নারীর জন্য মেপে দেওয়া গন্ডি। নারী সে পড়াশুনাকে কাজে লাগাতে চাইলে সেটাকে অন্যায়, অমানবিক প্রমাণে সমাজ উঠেপড়ে লাগে। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতিতে বিশ্বাসী সমাজকে বদলাবেন কী করে বলুন তো?

নারীবাদবিরোধী বিভিন্ন গ্রুপে নারীবাদী নারীকে প্রমাণ করা হয় সমাজের ভিলেন হিসেবে, তারা চান নারীরা বিস্তর পড়াশুনা করে মন দিয়ে সংসার করুক, কুটনামী করুক, গার্লস গ্রুপে স্বামীকে নিয়ে গদগদ পোস্ট দিক। কিন্তু চাকরি করতে গেলে, প্রমোশনে পুরুষকে ছাড়িয়ে গেলে, নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা করলে সমস্যা, কারণ ওতে পুরুষতন্ত্রে আঘাত লাগে। মানে ব্যাপারটা এমন যে আপনি আজন্ম মানুষের দাম না পাওয়া একটা জেন্ডারকে পড়াশুনা করিয়ে বিশ্বাস করালেন সে মানুষ,তারপর হঠাৎ করে বলে দিলেন সে তো মানুষ না, সে শুধুই নারী। যত পড়াশুনা, বইয়ের পাতায় নারীকে মানুষ ভেবে এগোনোর গল্প- এসব শুধু ডিগ্রি বাড়ানোর জন্য, বইয়ের পাতায় বেগম রোকেয়ার প্রবন্ধ যতোই সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে পাশাপাশি সহবস্থান করুক না কেন, দিনশেষে নারী মানেই তার নির্দিষ্ট স্থান সংসারের চার দেয়াল। চা বানিয়ে পরিবেশন করতে করতে টিভিতে পদার্থবিদ্যায় নারীর নোবেল পাওয়া দেখতে দেখতে সে বড়োজোর চ্যানেল পাল্টে সিরিয়াল দেখতে পারে কিন্তু গন্ডি ভাঙার স্বপ্ন সে দেখতে পারবে না।

এমন অবস্থায় আপনি যখন এমন সমাজে বড়ো হচ্ছেন,যেখানে ছেলে মেয়েদের শিক্ষাই দেওয়া হয় নারী মানে ভোগ্যপন্য, নারীর আবদ্ধক্ষেত্র সংসার, নারী মানেই শুধু মা কিংবা বোন, তার বাইরে সব নারী মানেই ভোগের বস্তু, তাদের অ্যাবিউস করা সমাজ থেকেই সমর্থন করে; সেসব নারীকে নির্যাতন করলে ধর্ষণ করলে আঙুল সেই নারীর উপর উঠবে। সমাজ সেই নির্যাতিতা নারীর দিকেই আঙুল তুলবে, খুঁজে দেখবে সে রাত কয়টায় বাইরে গেছিলো, কীরকম কাপড় পরেছিলো।

যখন দূর্গন্ধে ভরা সমাজ দেখলো নারীর পোশাককে আঁকড়ে ধরেও নির্যাতনকে জাস্টিফাই করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ নির্যাতনের শিকার তিন বছরের শিশু থেকে শুরু করে বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধাও হচ্ছে, যখন ছোটো ছোটো ছেলেরাও রেহাই পাচ্ছে না, তখন তারা খুঁজলো আর কোন উপায়ে দোষ শেষ পর্যন্ত নারীর উপরই বর্তানো যায়, সে উপায়টাও তারা খুঁজে পেয়েছে বর্তমানে। এবং সে উপায়ের প্রয়োগ সর্বক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, পেভলভের কুত্তার থিওরী দিয়ে দেখানো হচ্ছে যে সকল নারীরা ইচ্ছেমতো পোশাক পরেন সেসব নারীকে দেখে দেবদূত পুরুষেরা উত্তেজিত হয়ে পর্দানশীল নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কারণ ইচ্ছেমতো পোশাক পরা নারীদের ছোঁওয়ার সাধ্য উনাদের নেই। সেখানে ইনিয়ে বিনিয়ে ধর্ষকের দালালেরা নারীকেই আবার দোষ দিচ্ছেন, দিনশেষে নারী মানেই সকল নিয়ম মেনে চলতে হবে, নারী মানেই ধর্মের সব দায় নারীর একার, নারী মানেই অভিযোগের সব তীর তার উপর বর্তাবে, দিনশেষে নারী তো মানুষের দাম পাওয়া কেউ নয়, নারী মানেই অন্য এক প্রজাতি, যাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে, ধর্মের দায় একতরফা মাথায় চাপিয়ে যাকে সমাজে দলিত করা হবে। সমাজবাদীরা আলতো করে ধর্ষককে বকে দিবেন, কিন্তু ধর্ষণের পেছনের কারণ হিসেবে রাখবেন নারীর পোশাককেই। কারণ দোষ তো দিনশেষে নারীকেই দিতে হবে, নারী তো মানুষ না, নারী এ সমাজের পোষা প্রাণি যাকে নিয়ম মেনে চলতে হয়। যতক্ষন অন্য সব পোষা প্রাণির মতো সে প্রভুভক্ত থাকবে, মনোররঞ্জন করবে আর সব নির্দেশ মেনে চলবে ততোদিন নারী মহান, নারী দেবীর আখ্যা পাবে। কিন্তু নিয়ম ভাঙলেই নারী হয়ে যাবে নষ্ট, দুশ্চরিত্রা এবং বেশ্যা।

শুধু শুনতে চমৎকার লাগে বলে ধর্ষণের জন্য সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক অবক্ষয় কিংবা মূল্যেবোধকে জীবনেও দায়ী করবো না। আমি বিশ্বাস করি ধর্ষণের প্রধান দায় বর্তায় সেই সমাজের উপর, যে সমাজ যুগের পর যুগ নারীকে মানুষ ভাবতে পারেনি, যে সমাজের নারীরা নিজেকে মানুষ ভাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেনি সে সমাজের। নইলে মানুষ খুনকে এ সমাজ যখন ভয়াবহ অপরাধ ভাবতে পারে তবে ধর্ষণকে ভাবতে পারেনা কেন? ধর্ষণ সংঘটিত হলে একজন ধর্ষিতার জীবনকে নরক করে তোলে এই সমাজ, আধুনিকতার নিস্ফল বুলি আওড়িয়ে ঠিকই একজন ধর্ষিতাকে প্রতিনিয়ত এক বর্বর জীবন যাপন করতে হয়। সমাজ বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় দোষটা ধর্ষিতার নিজের। এই যে বেঁচে থাকতে একটা মেয়েকে বারবার মরতে হয়, তা কি একটি খুনের থেকে কম ভয়ানক? আমার তো মনে হয়না। এ সমাজ নিজের তৈরি কাঁটাতারে নারীর পা বিঁধলে সেই নারীকেই দোষারোপ করে। মুখে নারী অধিকারের হাজারো বাক্যেবান বলে দিনশেষে নারীর জন্য সিস্টেম বানাতে বসে একমাত্র এই নষ্ট সমাজই।

তাই আমি বিশ্বাস করি ধর্ষকের ফাঁসি দিয়ে কোনো লাভটাই হবেনা, যতদিন না নারী মুক্তি পাচ্ছে, যতদিন না নারীকে মানুষ ভাবা হচ্ছে। যতদিন না নারীর জন্য তৈরি করা নোংরা নিয়ম বানানো এ সমাজ বন্ধ করবে না, ততোদিন কিচ্ছু বদলাবে না।

আমার সাড়ে তিন বছর বয়সে মলেস্টেশনের জন্য দিনের পর দিন আমাকেই আহত করা হয়েছে, রাস্তায় আমি স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে আজো হাঁটতে পারিনা কারণ আমাকে শেখানো হয়েছে দিনশেষে দায়টা নারী হিসেবে আমার। আমি চাই সমাজ বদলাক, আজকের তিন বছরের বাচ্চাটার যেন এমন নোংরা পৃথিবীতে বড় হতে না হয়, সে যেন মানুষের দামটা পায়, তাকে যেনো ভিকটিম ব্লেমিংয়ের সংস্কৃতিতে বাঁচতে না হয়। নারীরা মানুষ হোক, সত্যিকারের মানুষ, সমাজে নারী পুরুষ উভয়েই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের পরিচয়ে এগিয়ে যাক। পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর আর কিছু হতে পারেনা।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]