November 23, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

হত্যার হুমকি, তবু ধর্ষণের শিকার নারীদের ভরসার নাম মুকওয়েগে

শাহান আহমদ।। ডেনিস মুকওয়েগে। তার বাবা ছিলেন একজন পেন্টিকোস্টাল মিনিস্টার (প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ প্রধান)। সেই সুবাদে বাবা যখন রোগীদের দেখতে এবং তাদের জন্য প্রার্থনা করতে যেতেন, তখন অনেক সময় তাকেও সঙ্গে নিতেন। কঙ্গোর বুকাভু’তে বড় হতে হতে আশেপাশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি মনে মনে ঠিক করেন, শুধুমাত্র প্রার্থনায় কাজ হবে না, বড় হয়ে তাকে এসব মানুষদের সাহায্যও করতে হবে।

ডেনিস মুকওয়েগের জন্ম ১৯৫৫ সালের পহেলা মার্চ, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর বুকাভু অঞ্চলে। ডেনিস মুকওয়েগে কঙ্গোতে নারী, মেয়ে এবং শিশুদের জন্য এমন একটি নাম, যার কাছে পৌঁছাতে পারলে নিরাপত্তা এবং বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। শত-সহস্র নারীকে যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, তাদের উপর নির্যাতন, ধর্ষণ- এসবের বিরুদ্ধে ডেনিস মুকওয়েগে কঠিন এক সংগ্রামে লিপ্ত। এ কাজে জড়িত থাকায় তাকে বার বার হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। একজন নোবেল বিজয়ী হয়েও নিজ দেশে নিরাপদ নয় ডেনিস মুকওয়েগে।

প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডিতে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করার পর নিজ দেশে এসেই ডাক্তারি পেশায় কাজ শুরু করেন মুকওয়েগে। কঙ্গোর দক্ষিণ কিভু অঞ্চলের লামেরা নামক শহরের একটি হাসপাতালে প্রথম কর্মক্ষেত্র হিসেবে ডাক্তারি শুরু করেন তিনি। ওই হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর অবাক হয়ে যান মুকওয়েগে। প্রতিবছর হাসপাতালে এত বিশাল সংখ্যক নারীর মৃত্যু দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিষয়ক সমস্যাজনিত। এবং সেখানে আসা রোগীদের একটি বড় অংশ ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার নারী। প্রতি বছর এত বড় সংখ্যক নারীর মৃত্যু দেখে তিনি একজন স্ত্রীরোগ বিষয়ক ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও উৎসাহ বোধ করেন। আর এই উৎসাহ বা এই বোধের ফলে তিনি যে কাজ শুরু করেন, তা তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এবং দৃষ্টান্তপূর্ণ এক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।

তিনি স্ত্রীরোগ এবং প্রসূতিবিদ্যা বিষয়ক পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সে পাড়ি জমান। ফ্রান্স থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষে কঙ্গোতে ফিরে এসে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন মুকওয়েগে। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে কঙ্গোর সহিংসতায় ‘লামেরা’ ছিলো কেন্দ্রস্থল। ১৯৯৬ সালের বিভিন্ন সহিংসতায় লামেরা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সাথে যে হাসপাতালে তিনি কাজ করতেন সেটিও ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। সে সময়ের অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ এবং নারীদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে সেই সময়টি কঙ্গোর জন্য নিকৃষ্টতম এক অধ্যায়ে পরিণত হয়। ওই সময়ে ধর্ষণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। তখনকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় সৈন্যদের ভোগ লালসা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ রুয়ান্ডার হুতু বিদ্রোহী গুষ্টির তৎপরতায় কঙ্গো হয়ে উঠে নারীদের জন্য এক নরক।

এরকম এক খারাপ সময়ে নারীর প্রতি আশার আলো হয়ে দেখা দেন মুকওয়েগে এবং তার পানজি হাসপাতাল। চারপাশে নারীর প্রতি এত এত সহিংসতা এবং নির্যাতন দেখে মুকওয়েগে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে উত্তর বুকাভোতে ১৯৯৯ সালে ‘পানজি’ নামে নতুন একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন। খুব অল্প দিনেই পানজি নামকরা এক হাসপাতালে পরিণত হয়। বিশেষ করে স্ত্রীরোগ এবং প্রসূতি বিভাগের জন্য পানজি’র নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মুকওয়েগে এবং তার সহকর্মীরা পুরো দেশ থেকে যুদ্ধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার নারী ও মেয়েদের উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাসপাতালে নিয়ে আসতে থাকেন।

পানজি হাসপাতালেই তৈরি করেন বিশেষায়িত বিভাগ, যেখানে ধর্ষণের শিকার নারী এবং মেয়েদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯৯ থেকে মুকওয়েগে এবং তার সহকর্মীরা ৫০ হাজারের উপরে নারী এবং শিশুদের চিকিৎসা দেন। শুধু কঙ্গোতে তৎপরতায় তার কাজ সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং কিভাবে দেশটিতে নারীদের প্রতি সহিংসতা কমানো যায় তা নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে সোচ্চার হওয়ার নিয়মিত তাগিদ দেন। তিনি তার দেশের নির্যাতিত নারীদের পক্ষে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া তুলে ধরেন। তার দেশের নারী নির্যাতকদের অবশ্য এসব পছন্দ হয়নি। ফলে ২০১২ সালে তার উপর আততায়ীর হামলা হয়। ওই হামলায় তিনি কোনক্রমে বেঁচে গেলেও তার বাড়ির দারোয়ানের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পরেই তিনি দেশত্যাগ করেন। কিন্তু বেশিদিন দেশ ছেড়ে থাকতে পারেননি, পরের বছরই আবার ফিরে আসেন নিজ দেশে।

মুকওয়েগে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এখন পর্যন্ত বহু সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পুরস্কার, একই বছরে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য অলফ পুরস্কার, ২০১৪ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শ্যাখরভ প্রাইজ ফর ফ্রিডম অব থটসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। তারমধ্যে ২০১৮ সালে তাকে নোবেল কমিটি ‘নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারীদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বন্ধে কাজের জন্য’ শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে। কিন্তু এত এত বিশ্বখ্যাত স্বীকৃতিও তার রাস্তাকে সহজ করতে পারেনি। ২০১৯ সালে উত্তর কঙ্গোতে সহিংসতার নিন্দা ও শান্তি রক্ষায় সেখানে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করায় তাকে আবারো হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

মুকওয়েগে তার কাজের জন্য কঙ্গো তথা সারা বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীর জন্য একটি ভরসার নামে পরিণত হয়েছেন। তার পানজি হাসপাতাল সহিংসতার শিকার নারীদের এক আশ্রয়স্থল। কঙ্গোর নারীরা জানেন তাদের জীবনে পানজি হাসপাতালের গুরুত্ব কতখানি। তাই বুকাভো অঞ্চলের কর্মজীবী নারীরা তাদের আয় থেকে একটি অংশ হাসপাতালের ফান্ডে দান করেন।

সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাইতে ডেনিস মুকওয়েগে ফের একবার হত্যার হুমকি পান। এবার শত শত নারী, ডাক্তার এবং নার্সরা আন্দোলনে তার পক্ষে রাস্তায় নামেন। তারা মুকওয়েগের নিরাপত্তা জোরদার এবং হুমকির পিছনে যারা আছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবী জানিয়ে আন্দোলনে নামেন।