September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

জমিদারি স্বভাবখানা পুরুষ কবে ছাড়বে?

সানজিদা সামরিন।। আগেকার দিনে জমিদারদের যেমন দেখা যেত- আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছেন জমিদারবাবু। ফল চিবাচ্ছেন বা পান করছেন সরাব। পেছনে একজন দাঁড়িয়ে বিশাল পাখা দিয়ে অবিরাম হাওয়া করেই যাচ্ছে। এর মধ্যে দুয়েকজন দাসী ডেকে ফাইফরমাস তো করেই যাচ্ছেন মহামান্য জমিদার। সিনেমায় এমনটাই তো দেখা যায়। তবে এমন চিত্র পাওয়া যাবে নিজের ঘরের ভেতর তাকালেও। পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য পুরুষ ব্যক্তিটির স্বাস্থ্য বা শারীরিক স্থবিরতার কথা সম্মানের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে যদি অন্যদের দিকে তাকাই তাহলে এমন কয়টি পরিবার পাওয়া যাবে যার পুরুষ সদস্যরা নিজের কাজটি অন্তত নিজে করেন?

বর্তমান সময়ে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি হলেও কর্মজীবী নারীর পরিবারে যেসব পুরুষ রয়েছেন তাদের ক’জনই বা ঘরের কাজে হাত লাগান? সহজ কথায়, নারী উপার্জন করা, বিল পরিশোধ, বাজার, বয়োজেষ্ঠ্যদের ডাক্তার দেখানোর মতো বাইরের কাজগুলোয় পুরুষ সদস্যকে সহায়তা করলেও পুরুষ সদস্যকে কি রান্নাঘরে, ঘরের কাজে নারী সদস্যের পাশে দেখা যায় সহজে?

সাদৃশ্য হলো সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মজীবী পুরুষ ও কর্মজীবী নারী সদস্য বেরিয়ে পড়েন। দুজনেই কর্মক্ষেত্রে আট ঘণ্টা কাজ করেন। এরপর? এরপর আর মিল কী আছে? ক’জন পুরুষ রয়েছেন যারা কর্মজীবী নারীর রান্না, ঘরের কাজ যেমন পরিচ্ছন্নতা, কাপড় ধোয়ার মতো কাজগুলোয় সাহায্য করেন? আচ্ছা এবার আসি যারা হোম মেকার বা গৃহিনী তাদের কথায়। বাড়িতে থেকে কাজ করেন বলে তাকে রোজ সবার আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে এবং সবাই ঘুমাতে যাওয়ার পর শুতে যেতে হবে হয়ত এটাই নিয়ম ভাবে সবাই। হয়ত কাজের ধরনের কারণে অমনটা হয়েই যায়। ধরে নিলাম তা স্বাভাবিক। কিন্তু যে প্রসঙ্গে কথা বলছি তা হলো, পুরুষের জমিদারী বা নবাবী স্বভাব ওরফে ‘দাও দাও গোঙানি’। পানি দাও তো, স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছি না, খুঁজে দাও, গোসলে যাব তোয়ালে দাও, শার্টটা ইস্ত্রি করে দাও, মশারিটা টাঙিয়ে দাও, প্যান্টটা ধুয়ে দিও, চা দাও, বইটা দাও, নাক দিয়ে পানি পড়ছে টিস্যু দাও, লাইট জ্বালিয়ে দাও, ফ্যান চালিয়ে দাও ইত্যাদি ইত্যাদি। খাওয়ার পর ক’জন পুরুষ নিজের প্লেটটি নিজে ধুয়েছেন বলতে পারেন? অথবা এখনও অনেক শিক্ষিত ও স্মার্ট পেশাদার পুরুষের পক্ষে ভাবা কঠিন যে রাতে সবার শেষে খাওয়ার পর খাবারের বাটি ফ্রিজে তুলে রাখা ও সর্বশেষ থালাবাসন ধোয়ার কাজটি তারও হতে পারে। এই ‘করে দাও’ মানসিকতার উৎপত্তি আসলে কোথায় বা কোন যুগ থেকে ঠিক জানা নেই। তবে মেয়েরা যদি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেকে স্ট্যাব্লিশ করতে পারে এবং ঘর-বাহির দুটোকেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমানে সামাল দিতে পারে, তাহলে পুরুষের নিজের কাজগুলো করতে অসুবিধা কোথায়? কর্মক্ষেত্রের কাজটুকু ও স্নান ব্যতীত ব্যক্তিগত ও ঘরের প্রয়োজনীয় কাজকে তারা নিজের বলে মনে না করে পরিবারের নারী সদস্যদের ওপর ভর করে থাকেন। এটাও তো অনেকটা অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা।

ছোটবেলায় অনেক কাকু শ্রেণির ভদ্রলোককে দেখেছি জমিদারি হালে চলতে। নিজের সেবায় তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের দিয়ে ঠিক কী কী করাবেন তার একটা অলিখিত ফর্দই থাকতো। খাওয়ার পর মোটা সরের পরতওয়ালা একবাটি দুধ গিলে ঢেকুর তুলতে তুলতে স্ত্রীকে বলতেন, পানি ঢালো হাত ধুই। এরপর কুঁজো হয়ে কন্যারা গামছা এগিয়ে দিতো হাত মোছার জন্য। সেই অর্ধশিক্ষার যুগের বেনামী জমিদারী আচরণ এখনকার উচ্চশিক্ষিত আরামপ্রিয় পুরুষদেরও রপ্ত করা আছে। কিন্তু কেন এই অথর্ব আচরণ? সুস্থ সবল দুটি হাত ও দুটি পা নিয়ে জন্মানোর পরও কেন এই জনম জনমের পরনির্ভরতা? এখন নারীর ঘরের বাইরে সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে বিচরণ সম্ভব হয়েছে কেবল নারীর আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে। তাহলে পুরুষ কেন বদলায় না? হ্যাঁ গুটিকয়েক তো অবশ্যই আত্মনির্ভরশীল সুপুরুষ রয়েছেন যারা মানবিক এবং বরাবরই সম্মানিত। আর বাকিরা? তারা কি বদলাবেন আদৌ? করতে সমর্থ হবেন স্নানের সময় তোয়ালে নেয়া, গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়া ও নিজের জুতাজোড়া মুছে পরার মতো কাজগুলো? নাকি আজীবনই নারীর দিকে হাত পেতে বলবেন-‘দাও!’

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]