বেগম রোকেয়াও যখন নোংরা মন্তব্যের শিকার
শামস্ আবীরুজ্জামান সিয়াম।। রোকেয়া দিবসে স্বনামধন্য পত্রিকার কমেন্টবাক্সে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ একাংশের মন্তব্য এই “মহিলা নাস্তিক, একে সম্মান করার কিচ্ছু দেখিনা” বলে চারদিকে হৈ হৈ রব তোলা ভাব। কারণ তিনি লিখেছিলেন,”আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে……”
আদতে কি তিনি ভুল কিছু লিখেছিলেন?
বিংশ শতাব্দীতে এদেশের মুসলমানদের কাণ্ডারি হুজুরের কাছ থেকে “মেয়েরা আসলে তেঁতুলের মতো এবং মেয়েদের বিবিএ,এমবিএ পড়ানোর কোনো দরকার নেই, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়লেই হলো” টাইপ কথা আসে এবং তা চারিদিকে ধর্মের বাণী বলে প্রচলিত হয়। যখন এই তেতুল থিওরী, পাভলবের কুকুর থিওরি- রেপ জাস্টিফিকেশন থেকে শুরু করে মুনজারিন শাহিদের অক্সফোর্ড কেন যাওয়া হারাম তর্কে যা প্রচার করা হয়, তারপরও কি বলতে বাকি রাখে নারীদের দমায়ে রাখতে, রেপ জাস্টিফিকেশন দাঁড় করাতে বা পড়ালেখায় বাধা তৈরি করতে ধর্মের নামে এইসব বাণী স্বরচিত মিসোজিনি ছাড়া কিছুই নয়!
এই যে যারা আজকে এখানে এসে কমেন্ট করছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং তারা বেগম রোকেয়াকে জারজ বলে গালি দিচ্ছেন, তারা কি জানেন না বিংশ শতাব্দীতে বসে উনি যে ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছেন আর বাংলায় টাইপ করতে পারতেসেন এইটাও শুধুমাত্র বেগম রোকেয়ার কারণে!
তৎকালীন গারদে বাধা সমাজব্যবস্থায় মুসলিম নারীদের উর্দু ব্যতীত আর কোনো ভাষা শিক্ষার “অনুমতি” ছিলনা, ইংরেজি তো দূরে থাক বাংলা পর্যন্ত না; শুধুমাত্র লুকিয়ে বাংলা পড়ায় যেখানে নিজের বোন করিমুন্নেসাকে রক্ষণশীল বাবার তোপের মুখে পড়ে তরুণ বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল, সেই সমাজ ব্যবস্থার পরবর্তী অংশ হয়ে ফেসবুকে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি চর্চা করে কিংবা বিবিএ, এমবিএ পড়তে পেরে কি একটুও কৃতজ্ঞ হতে ইচ্ছে করে না সেই মানুষটার প্রতি যে সেই মূর্খ উগ্র সমাজব্যবস্থায় একাই লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন!
আধুনিক সমাজে সব উত্তরোত্তর সুযোগ সুবিধা ভোগ করে যখন তার জন্য সংগ্রামকারী মানুষের চরিত্র আপনারা প্রশ্নবিদ্ধ করেন তখন একটা কথাই মনে পড়ে; কিছু মানুষ ধর্মেও থাকে জিরাফেও থাকে, কিন্তু কিছু মানুষ সরাসরি চিড়িয়াখানায় থাকে।
আদতে কিছুই বদলায়নি, বেগম রোকেয়ার সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত খুব একটা বদল আসেনি মননে। বদল এসেছে শুধুমাত্র নারী অবজেক্টিফাইয়িং ট্রাম্প কার্ডে। এই কয়েকদিন আগের নারীর পাব্লিক প্লেসে সিগারেট খাওয়ার ভাইরাল ভিডিওর কথাই বলুন, যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল “এখানে তো বাকিরা বসেও সিগারেট খাচ্ছে, তাদেরকে তুলে দিচ্ছেন না কেন?” তখন প্রতিউত্তর ছিল “আপনি তো মেয়ে, আপনার জন্য পাড়ার মেয়েরা নষ্ট হবে” আর পাশাপাশি পেতে হয় রেপ থ্রেটও। ভাবতেই অবাক লাগে, যেখানে কোনো পুরুষ সিগারেট সেবন করলে সমাজ তাকে বলে স্বাস্থ্য সচেতনতাহীন বলে, সেখানে একজন নারী সিগারেট সেবন করলে তাকে বলাহয় “চরিত্রহীন।” জানেন কেন?
কারণ এই “চরিত্র” বস্তুটা হচ্ছে নারীদের উপর পুরুষতন্ত্রের ট্রাম্প কার্ড, নারীদের চরিত্র থাকবে ফুলের মতো পবিত্র আর সমাজের বড় অংশ এতে বিশ্বাসী, হয়তো স্বয়ং আপনিও! সুতরাং চরিত্রের প্রশ্ন আসলে সেখানে নারীদের নিস্তার আর নেই।
আবার ধরুন ফেসবুকে অহরহ দেখা যায় কোনো নারীর সাথে কারো মতের অমিল হলে তাকে “পতিতা, বেশ্যা” গালি দেয়া। কারণ এই “পতিতা, বেশ্যা” শব্দগুলা পুরুষতন্ত্রের কার্ড, নারীর যোনীর মধ্যে নারীর সম্মান থাকে মতবাদে বিশ্বাসীদের মুষ্টিবদ্ধ করার বড় হাতিয়ার। অথচ খুব কম লোকই এদের প্রশ্ন করে, নারীর সম্মান কেন তার যোনীতে বসবাস করবে। আবার আরেকটা ট্রাম্প কার্ড ধর্ম, রোকেয়া দিবসে সোশালের উচ্ছিষ্ট কমেন্ট সেকশানে যার জুড়ি মেলা ভার, কাউকে নাস্তিক কিংবা ধর্মবিরোধী বললেই প্রমাণের আর দরকার পড়ে না, তার সকল মতামত তখন অগ্রহণযোগ্য। আর ধর্মের নামে ভুল থিওরী, পাভলবের থিওরী দেয়া মানুষের অভাব নেই।
তাও জানেন আজকের দিনটা একটা বিশেষ দিন। জানেন কেন?
কারণ বেগম রোকেয়া হেরে যাননি। বরং বেগম রোকেয়া তাঁর যুগে পুরুষতন্ত্রের বেড়ি স্পষ্ট করে দেখিয়ে গেছেন এবং যুগের পর যুগ ধরে আজও বেগম রোকেয়া প্রতিনিয়ত চোখে আঙুল দিয়ে পুরুষতন্ত্রের শেকল, বেড়ি আর ট্রাম্প কার্ড দেখিয়ে দিচ্ছেন…..
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]