সেতুর পাড়ের বৃদ্ধ লোক
প্রখ্যাত মার্কিন কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৯৩০ সালে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় লেখেন “ The old man at the bridge” নামক ছোটগল্পটি। গল্পটি ভাবানুবাদ করেছেন নুসরাত সুলতানা।।
বেশ ধুলি ধুসারিত পোশাক আর স্টিলের চশমা পরা এক বৃদ্ধ রাস্তার ধারে বসেছিল। নদী পারাপারের জন্য ভাসমান পন্টন সেতু ছিল এবং মালবাহী গাড়ি, ট্রাক, নারী, পুরুষ ও শিশুরা নদী পার হচ্ছিল। নদীর ঢালু তীর থেকে সেতুর মাথা অব্দি খচ্চর টানা টালমাটাল গাড়িগুলোকে সৈন্যরা চাকা ঠেলে উঠতে সাহায্য করছিল। গোড়ালি পর্যন্ত ধুলায় আচ্ছন্ন কঠোর শ্রমশীল কৃষকের দল আর ট্রাক গুলি ঠেলে সামনে এগুনোর জন্য জড়ো হচ্ছিল। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি একচুল না নড়ে বসে রইল।
আমার কাজ হল সেতু পার হয়ে সেতুর মুখ ও পিছনটা পর্যবেক্ষণ করে শত্রু কদ্দুর এগুলো তা বোঝার চেষ্টা করা। কাজ সেরে আমি সেতুর ওপর ফিরে এলাম। সেতুর ওপর তখন মালবাহী গাড়ি তেমন ছিল না আর পায়ে হাঁটা লোকজনও বেশ কমে এসেছিল। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি তখনও সেখানে ছিল।
“আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” প্রশ্ন করলাম।
বুড়ো লোকটি হাসল এবং উত্তরে বলল “স্যান কার্লোস থেকে”
বৃদ্ধ ওই শহরের বাসিন্দা বলে নিজের শহরের উল্লেখ করায় খুশি হয়ে উঠল আর হাসলো।
“ আমি পশুগুলোর দেখাশোনা করছিলাম”
“ওহ” বলছিলাম আমি যদিও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
“হ্যাঁ” বুড়ো মানুষটি বলে চললো- “জানেন আমি পশুগুলির দেখাভালের জন্য রয়ে গেলাম। আমিই শেষ ব্যক্তি যে স্যান কার্লোস ছেঁড়ে এসেছে।”
তাকে দেখতে মোটেও কোন রাখাল বা পশুপালকের মতো লাগছিল না। আমি তার কালো ধুলিমলিন পোশাক আর ধূলিধুসর মুখ, স্টিলের চশমা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলাম “কী ধরনের পশু?”
“নানান জাতের” উত্তরে তিনি মাথা নেড়ে বললেন “আমাকে সব ফেলে আসতে হয়েছে”।
আমি আফ্রিকার গ্রামাঞ্চলের মতো দেখতে এব্রো ডেল্টা আর সেতুর দিকে লক্ষ্য রাখছিলাম এবং মনে মনে ভাবছিলাম প্রতিপক্ষের দেখা পেতে আর কত দেরি। সেই সাথে প্রতিপক্ষের প্রথম আওয়াজ যা শত্রুর সম্মুখীন হওয়ার রহস্যময় ঘটনার ইঙ্গিত দেবে, ঠাউর করতে কান পেতেছিলাম। বুড়ো লোকটি তখনও সেখানে ছিল।
“কি ধরনের প্রাণি ছিল?” জানতে চাইলাম।
“সব মিলিয়ে তিনটি প্রাণি ছিল।” তিনি ব্যাখ্যা করলেন “দুটি ছাগল ও একটি বেড়াল আর চার জোড়া কবুতরও ছিল।”
“এবং আপনি সব ফেলে এসেছেন?” প্রশ্ন করলাম আমি।
“হ্যাঁ, গোলান্দাজ বাহিনীর জন্য।“ গোলান্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন।
“আপনার পরিবার নেই?” সেতুর শেষ প্রান্তে সর্বশেষ কিছু মালগাড়ি নদীর ঢালে নেমে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করছে তা দেখতে দেখতে জানতে চাইলাম।
“না।” তিনি বলে চললেন “কেবল যেসব জীবজন্তুর কথা বললাম তা ছাড়া কেউ নেই। বেড়ালটা অবশ্য ভালই থাকবে। বিড়াল নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে পারে। কিন্তু বাকিগুলির কী হবে জানি না।”
“আপনার মতাদর্শ কী?” জানতে চাইলাম।
“আমার কোন মতাদর্শ নেই।” তিনি বললেন “আমি ছিয়াত্তর বয়েসের একজন বুড়ো মানুষ। বারো কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছি মাত্র আর এখন আমার মনে হচ্ছে আমি আর চলতে পারব না।”
“এখানে থামাটা ভাল হবে না।” আমি বললাম “আর একটু যেতে পারলেই টরটসাগামী ট্রাক পাবেন রাস্তার ওপর।”
“ আমি একটু জিরিয়ে নিতে চাই।“ বৃদ্ধ বললেন “ আর তারপর যাবো।ট্রাক গুলী কোথায় যায়?
“বার্সিলোনার দিকে।”
“ওখানে আমি কাউকে চিনি না।” তিনি বললেন “কিন্তু অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ।”
বুড়ো মানুষটি শূন্য, ক্লান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, আর তারপর আমাকে বলার জন্য নয় নিজের দুর্ভাবনা কারোর সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্যই যেন বলল “বেড়ালটা ভালই থাকবে আমি নিশ্চিত। বেড়ালটাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু বাকিগুলো! আচ্ছা, অন্যদের ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?
“কেন ওরাও ঠিক সামলে নেবে।”
“আপনার তাই মনে হয়?”
“ কেন নয়!” মালগাড়ির শূন্য দূরবর্তী তীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললাম আমি।
“কিন্তু যে গোলান্দাজ বাহিনীর জন্য আমাকে চলে আসতে হলো তাদের সাথে থেকে এগুলো কি করবে?”
“কবুতরে খাঁচা কি খুলে রেখে এসেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে তো উড়েই যাবে।”
“অবশ্যই উড়ে যাবে। কিন্তু অন্যগুলো। এদের কথা না ভাবাই ভাল।” তিনি বললেন।
“আপনার যদি জিরোনো হয়ে থাকে তাহলে এবার উঠবো।” আমি তর্ক করে বললাম “উঠুন আর হাঁটার চেষ্টা করুন।”
“ধন্যবাদ।” বলে উঠে দাঁড়ালেন, এপাশ ওপাশ দুলতে দুলতে আবার পিছনের ধুলোর ওপর বসে পড়লেন।
“আমি পশুগুলো দেখভাল করতাম।” নিরাশ ভঙ্গিতে আপন মনেই বললেন “আমি তো কেবল পশুগুলোর দেখাশোনা করতাম।”
উনাকে নিয়ে কিছু আর করার ছিল না। ইস্টার সানডের দিন আর ওদিকে ফাসিস্টরা এব্রোর দিকে এগিয়ে আসছিল। তমাচ্ছন্ন দিন হওয়ায় ঝুঁকে পড়া আকাশের ছাদে আজ তাদের বিমান দেখা যাচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে কি বেড়ালটা নিজের দেখভাল করতে জানে সেটাই বুড়ো মানুষটির একমাত্র সৌভাগ্য ছিল।