November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পুরুষ: অনুভূতিশূন্য উপার্জনক্ষম এক প্রাণি, যার কাজ কর্তৃত্ব করা

কায়সুল খান।। পুরুষতন্ত্র হল এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যার অধীনে পুরুষই সমাজে কর্তৃত্ব স্থাপনের অধিকার লাভ করে। সামাজিক তো বটেই একই সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সম্পদ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় এবং নারী ও শিশুর উপর কর্তৃত্ব লাভ করে। সমাজের অলিখিত নিয়মে এখানে পরিবারের মাঝেও পিতা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক হয়। নারী ও শিশুদের বক্তব্যের মূল্য থাকে না। বাংলাদেশে তেমনই একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বর্তমান। সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের অজান্তে কিংবা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিণত হয়েছি পিতৃতন্ত্রের দাসে।

পুরুষতন্ত্র পুরুষকে তার পৌরুষ দিয়ে বিচার করতে শেখায়। পুরুষ হবে শক্ত, বলিষ্ঠ, কর্মঠ, উপার্জন করা যার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। অন্যদিকে নারী হবে কোমল, তার আবেগ থাকবে, সে কাঁদবে। সমাজে নারীর দায়িত্ব হল তার প্রভু বা স্বামীর সেবা করা, শিশু জন্ম দেওয়া, তাকে লালন-পালন করা। জগৎ-সংসার নিয়ে নারীকে না ভাবলেও চলবে। অথচ নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ। উভয়েরই অনুভূতি আছে। পুরুষের যেমন আবেগ আছে, ভালোবাসার বোধ আছে, মানবিক গুণাবলীবহুল একজন ভালো ও সৎ মানুষ হওয়ার অধিকার আছে, তেমনি নারীরও তার মেধা ও কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়ে জগতের তাবৎ কাজ করতে পারার অধিকার রয়েছে।

বাংলাদেশের পরিবার ব্যবস্থা তথা সমাজ আমাদের মগজে শিশুকাল থেকেই পুরুষতান্ত্রিকতার বিষ ঢুকিয়ে দিতে থাকে। পরিবারের ছেলে শিশুর প্রতি মা-বাবার মনোভাবের প্রতি মেয়ে শিশুর প্রতি মনোভাবের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শিশুকাল থেকেই ছেলেকে পুরুষালি করে তোলা হয়। ছেলে শিশুকে ফুটবল-ক্রিকেট শেখার প্রতি আগ্রহী করা হয়। অন্যদিকে মেয়েকে শেখানো হয় পুতুল খেলা কিংবা রান্নাবাটি। এতে ছেলে শিশুর মাঝে মেয়ে শিশুটির প্রতি এক ধরণের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে। সে ভাবতে শেখে মেয়েদের কাজ ঘরের মাঝেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে সে যেহেতু ছেলে তাই তাকে শক্তপোক্ত কাজ করতে হবে। ছেলেদের শক্তপোক্ত কাজ করা দোষের কিছু না কিন্তু যখন একটি ছেলে শিশুকে এক রকম কাজের জন্য গড়ে তোলা হয় এবং মেয়েটিকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ঘরকেন্দ্রিক কাজের জন্য অভ্যস্ত করা হয় তখনই বৈষম্য ঘটে।

পুরুষতন্ত্র পুরুষকে এক মিথ্যা গরিমা নিয়ে বড় হতে শেখায়। শারীরিক শক্তির গরিমা, মেধার গরিমা, পৌরুষের গরিমা কিংবা ক্ষমতার গরিমা। প্রাকৃতিকভাবে গড়পড়তা একজন পুরুষের চেয়ে নারী অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হয় এটা সত্য কিন্তু মেধা, দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা কিংবা নেতৃত্বগুণ কোনো দিক থেকেই নারী পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। অথচ পুরুষতন্ত্রের বিষ আমাদের পুরুষদের মাঝে এই মিথ্যা ধারণা নিয়ে বড় হতে শেখায়, জীবনযাপন করতে শেখায়। কল্পনার জগতের শ্রেষ্ঠত্ব পেতে শেখায় মানুষকে, হয়ে উঠতে বলে শোষক।

আমাদের সমাজ ছোট থেকে আমাদেরকে শেখায় পুরুষ লৈঙ্গিকভাবে শক্তিশালী। তার সর্বত্র কর্তৃত্ব ফলানোর অধিকার রয়েছে। নারীর জন্ম পুরুষের জন্য। ফলে আমরা নারীকে হীনভাবে দেখতে শিখি। নারীর প্রতি কর্তৃত্ববাদি আচরণ করতে শিখি। তাদেরকে আমাদের দাস বিবেচনা করি। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে শাসকের ভূমিকায় দেখতে চায়। এই কর্তৃত্ববাদ ফলাতে গিয়ে, নারীর প্রতি শাসনাধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে পুরুষ হয়ে ওঠে শোষক। জীবনের পদে পদে নারীকে শোষণ করতে শুরু করে সে। শিশুকালে ভাই হিসেবে বোনের প্রতি তার আচরণ বন্ধুত্বসুলভ না হয়ে কর্তৃত্বমূলক হয়। প্রেমিক হিসেবে প্রেমিকার প্রতিও সে কর্তৃত্ব ফলাতে চায়। একজন পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ বিয়ের পর পার্টনারের অনুভূতি, আবেগ ইত্যাদির মূল্য দিতে শেখে না। ফলে সাংসারিক জীবনেও তাকে ভোগ করতে হয় অশান্তি।

পুরুষতন্ত্র আমাদেরকে নারীর প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠতে দেয় না। জীবনের অগ্রযাত্রায় নারীর সহযাত্রী হয়ে উঠতে শেখায় না। বরং তাকে প্রতিযোগী ভাবতে শেখায়। অথচ সভ্যতার অগ্রযাত্রায় নারী-পুরুষ উভয়ের সমান ভূমিকা থাকবে সেটিই কাম্য। নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতিযোগী না হয়ে, পরিপূরকের ভূমিকা গ্রহণ করে সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আমাদের সেই অনুভূতি, মনোভাব গড়ে তুলতে শেখায় না বরং পরিণত করে অনুভূতিশূন্য এক প্রাণিতে যার কাজ আয় করা এবং সংসারের নারীদের প্রতি কর্তৃত্ব স্থাপন করা। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে শোষকের ভূমিকায় দেখতে চায়। নারী ও শিশুদের প্রতি সমাজে আমরা যে যৌন সহিংসতা দেখি তার মূলেও রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। পুরুষ মনে করে নারীরা দুর্বল। তার উপর ইচ্ছেমত বল প্রয়োগ করা যায়। নারীকে ভোগ্যপণ্যের মত ব্যবহার করার শিক্ষা দেয় পুরুষতন্ত্র।

একজন মানুষকে প্রকৃত ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হয় মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে। মনুষ্যত্ব, মায়া-মমতা, জীবনবোধ, সহমর্মিতাবোধ, সততা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে। অথচ পুরুষতন্ত্র আমাদেরকে এসবের বদলে পৌরুষ অর্জনের শিক্ষা দেয়। পুরুষের যে মানবিক অনুভূতি আছে। তার যে আবেগ আছে, ভালোবাসার অনুভূতি হয়, কান্না আসে এগুলো স্বীকার করে না পুরুষতন্ত্র। বরং পরিণত হতে বলে অনুভূতিশূন্য এক উপার্জনক্ষম প্রাণিতে।

নারীরাও স্বাধীনভাবে জীবনকে উপভোগ করবে। তার মনের ইচ্ছেগুলো পূরণ করবে। কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না। পুরুষের মানবিক গুণাবলির কারণে পুরুষকে বন্ধুর মত ভাবতে পারবে। নারীরাও দিবা-রাত্রি নির্ভয়ে বাইরে বের হতে পারবে। এর সবই সম্ভব যদি আমাদের মনন থেকে পুরুষতান্ত্রিকতাকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়। আমাদের মাঝে মানবিকতা, সম্মানবোধ, বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা থাকে। কিন্তু পুরুষতন্ত্র আমাদের এই সকল গুণ অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদেরকে পরিণত করছে অমানবিক প্রাণিতে। এর থেকে মুক্তি পেতে আমাদের পুরুষতন্ত্রের শিকল ভাঙতে হবে। এই অভিযানে পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পাশাপাশি দরকার নারীর সাহচার্য ও সহানুভূতি। পুরুষতন্ত্রের শিকল ভাঙার এই অভিযানে আমরা তাদেরকে আমাদের পাশে পাবো কি?

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]