November 22, 2024
সম্পাদকীয়

মাননীয় আদালত, রায় পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাই

শারমিন শামস্।। “দেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে” নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না মর্মে নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। দিনাজপুরের নারী রেজিস্ট্রার প্রার্থীর রিট খারিজ করে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানাই, এই রায় বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। জাতিসংঘের সিডো সনদের পরিপন্থী।

আসুন প্রথমে দেখে নিই সংবিধান কী বলছে।

অনুচ্ছেদ ২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

অনুচ্ছেদ ২৮। (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।

(২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।
(৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।
অনুচ্ছেদ ২৯। (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
(২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।

এবার আসি সিডো প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ সরকার এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সনের শেষ দিকে।
সিডো সনদের দ্বিতীয় কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র অঙ্গীকার করছে যে, নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর করা জন্যে রাষ্ট্র নারী পুরুষের সমতার নীতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে, বৈষম্য নিষিদ্ধ করে আইন তৈরি করবে এবং সেইসব আইন বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবে আর প্রচলিত আইনে বা সকল বিধি বিধানে যত বৈষম্য আছে সেগুলি দূর করার জন্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন করবে এবং প্রয়োজনীয় নতুন আইন তৈরি করবে।

এবার দেখা যাক আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে কী বলেছেন। আদালত বলছেন, নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশন থাকেন। মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান হয় মসজিদে। ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারে না এবং তারা নামাজও পড়তে পারে না। সুতরাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।

আদালত আরো বলেছেন, একজন নারী একজন মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রার হতে হলে কিছু কিছু কার্যক্রম করতে হয়। নারী হিসেবে সব জায়গায় যেতে পারবেন কি না। রাত-বিরাতে বিয়ের অনুষ্ঠান হতে পারে। সেখানে যেতে পারবেন না। আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রারদের কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে নারীদের প্রত্যেক মাসে একটি বিশেষ সময় আসে যে সময়টাতে ধর্মীয়ভাবেই নারীরা মসজিদেও যেতে পারেন না। আবার নামাজও পড়তে পারেন না। এরকম সময় যদি কারও বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে তো কোনো নারী যেতে পারবে না। অন্যান্য পাবলিক অফিসে নারীরা যে কাজ করেন, আর ম্যারেজ রেজিস্ট্রার হিসেবে কার্যক্রম আলাদা।

এক্ষেত্রে বলতে চাই, প্রথমত- নারী মাসের নির্দিষ্ট সময়ে ফিজিক্যালি ডিসকোয়ালিফায়েড থাকেন না। যদি পিরিয়ডের কারণে নারীকে ডিসকোয়ালিফায়েড ধরা হয়, তবে সেটি নারীত্বের জন্য অপমান। সে সময়টিতে যদি নারীর রান্না করা খাবার খাওয়া যায়, নারীর সেবা গ্রহণ করা যায়, নারীকে দিয়ে পিরিয়ডের সময় অন্যান্য যাবতীয় পরিশ্রম করানো যায়, তাহলে নারীকে দিয়ে কোনো একটি বিশেষ কাজ না করানোর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত- বাংলাদেশে কোনো মসজিদে বিবাহ পড়ানো হয় না। ফলে পিরিয়ডকালীন মসজিদে প্রবেশ নিয়ে যে তর্ক বিতর্ক- এখানে সেটি ঘটবার কোনো সুযোগ নেই। বাড়িতে, কমিউনিটি সেন্টারে বিবাহ হচ্ছে, প্রয়োজনে আরো হবে, সেক্ষেত্রে কোনো বাধা আসবে বলে মনে করি না।

তৃতীয়ত- আদালত জানিয়েছেন নারী সব জায়গায় যেতে পারেন না। এখানে আমাদের জানার ইচ্ছে রইলো নারী আসলে কোন কোন জায়গায় এবং কেন যেতে পারেন না। যদি নিরাপত্তার ইস্যুটি কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটিকে সমাধানে মনোযোগী হওয়া জরুরি নাকি এই একবিংশ শতকে নারীকে আটকে রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাওয়া বাস্তবসম্মত!

পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই নারী ইমাম ও নারী কাজী আছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন। নারী ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে নারী ও পুরুষ সকলেই নামাজ পড়ছেন। অজস্র বিবাহের রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে এই কাজীদের দ্বারা। তাহলে বাংলাদেশে নারীর এই কাজে বাধা কোথায়? কেন বাংলাদেশের নারীকে এই কাজ করতে আটকানো হবে, যেখানে সংবিধান নারী ও পুরুষে কোনো বৈষম্য করতে অনুমোদন দেয় না!

প্রত্যাশা করি মাননীয় বিজ্ঞ আদালত রায়টি পুনর্বিবেচনা করবেন যাতে নারী একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে জীবন যাপনের সুযোগ পায়, নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার পথ খুলে যায় এবং আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধান সমুন্নত থাকে।

সবাইকে ভালোবাসা।