আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত: পর্ব-০৪
নাইজেরিয়ান নারীবাদী লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও বক্তা চিমামান্দা এনগোজি আদিচের লেখা We should all be feminists বইটি মূলত একটি বক্তৃতা, যা তিনি ২০১২ সালে দিয়েছিলেন। পরে ২০১৪ সালে এটি বই আকারে বেরোয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আতিকুল ইসলাম ইমন। অনুবাদটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর শেষ পর্ব বা পর্ব-৪।।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রথমবার ক্লাস নিতে যাচ্ছিলাম তখন এক চিন্তায় পড়লাম। আমি পড়ানোর বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হইনি, কারণ আগে থেকেই এ বিষয়ে ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, এবং যা পড়াবো তা উপভোগও করছিলাম। কিন্তু আসলে চিন্তায় পড়েছিলাম যে, আমি কী পরবো। কারণ আমি চেয়েছিলাম সবাই আমাকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করুক।
আমি এটা জানতাম কারণ আমি একজন নারী। আমাকে নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করতে হবে আগে। আমি চিন্তায় ছিলাম, যদি আমাকে বেশি নারীসুলভ দেখায় তাহলে আমাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে না। আমি আসলে চেয়েছিলাম উজ্জ্বল লিপগ্লস আর স্কার্ট পরে যেতে, কিন্তু শেষপর্যন্ত এসব না পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি সেদিন খুবই গুরুগম্ভীর, খুবই পুরুষসুলভ বিশ্রী এক স্যুট পরেছিলাম।
এ বিষয়টির দুঃখজনক সত্যটি হলো যে, যখন ব্যাপারটি ‘দেখার’ বিষয় হয়, তখন আমরা পুরুষদের মানদণ্ড ও আদর্শ হিসেবে ধরে নেই। আমাদের অনেকেই মনে করে একজন নারীকে দেখতে যত কম নারীসুলভ লাগবে, তাকে ততো বেশি গুরুত্ব দেবে সবাই। একজন পুরুষ যখন ব্যবসায়িক মিটিংয়ে যায় তখন সে কী পরলে তাকে সবাই বেশি গুরুত্ব দেবে এটা নিয়ে ভাবে না, কিন্তু একজন নারী এটাই ভাবে।
আমি এখন ভাবি ওই বিশ্রী স্যুটটি যদি সেদিন না পরতাম তাহলে ভালো হতো। ওই সময় যদি আমার এখন যেমন আত্মবিশ্বাস আছে তা থাকতো— তাহলে আমার ক্লাস থেকে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি উপকৃত হতো। কারণ আমি তাহলে আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম এবং আরও পূর্ন ও সত্যিকারভাবে—নিজে যা তাই হতে পারতাম।
আমি আমার নারীত্বের জন্য আর কৈফিয়ত দেব না বলে ঠিক করেছি। এবং আমি আমার সকল নারীত্বকে সম্মান করতে চাই। কারণ আমি তার যোগ্য। আমি রাজনীতি ও ইতিহাস পছন্দ করি, এবং আমি সবচেয়ে খুশি হই যখন আইডিয়া নিয়ে কোনো বিতর্ক করতে পারি। আমি মেয়েসুলভ। আমি সুখী মেয়েসুলভ একজন মানুষ। আমি হাই হিল পছন্দ করি এবং লিপস্টিক পরি। নারী ও পুরুষ উভয়ের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া দারুন ব্যাপার (যদিও সত্যি কথা বলতে আমি স্টাইলিশ নারীদের কাছ থেকে প্রশংসা বেশি পছন্দ করি) কিন্তু আমি প্রায়ই এমন কাপড় পরি যেগুলো পুরুষরা পছন্দ করে না বা বুঝতে পারে না। আমি এগুলো পরি কারণ আমি এসব কাপড় পছন্দ করি, এগুলো আমার ভালো লাগে। আমার জীবনের পছন্দ-অপছন্দ ঠিক করতে ‘পুরুষের দৃষ্টি’ জরুরি কিছু নয় মোটেও।
জেন্ডার নিয়ে কথাবার্তা বলা সহজ নয়। এ নিয়ে কথাবার্তা মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, প্রায়ই বিরক্ত হয়। পুরুষ ও নারী উভয়ই জেন্ডার নিয়ে আলোচনা করতে অনীহা দেখায় বা জেন্ডার বিষয়ক সমস্যাগুলো দ্রুত খারিজ করে দেয়। কারণ যা চলছে তা পরিবর্তন করার ভাবনাটি সবসময়ই অস্বস্তিকর।
কিছু মানুষ প্রশ্ন করে, “শব্দটি নারীবাদী কেন? নিজেকে একজন মানবাধিকারে বিশ্বাসী বা এরকম কিছু বলো না কেন?” কারণ এটা হবে অসততা। নারীবাদ অবশ্যই মানবাধিকারের একটি অংশ–কিন্তু এ জন্য অস্পষ্টভাবে মানবাধিকার শব্দটির ব্যবহার জেন্ডারভিত্তিক সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলোকে অস্বীকার করার শামিল।
জেন্ডার যে শত শত বছর ধরে সুনির্দিষ্টভাবে নারীদের সমস্যা সৃষ্টি করে, সেই নারীদের বাদ দেওয়ার জন্য একটি ছলনা হবে এটি। জেন্ডার সমস্যা যে নারীকে লক্ষ্য করে তা অস্বীকার করাও হবে এর মাধ্যমে। জেন্ডারের সমস্যাগুলো মানুষ হওয়ার কারণে ভুগতে হয় না, বরং মেয়েমানুষ হওয়ার কারণে ভুগতে হয়। শত বছর ধরে এই পৃথিবী মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করেছে, এবং পরে এক ভাগকে অন্য ভাগটিকে নিপীড়ন করেছে। সমস্যার সমাধানটি আসবে তা স্বীকার করার মধ্যমে, এটিই হবে ন্যায়সঙ্গত হবে।
কিছু পুরুষ নারীবাদের ধারনাকে তাদের জন্য হুমকি মনে করে। আমার মনে হয় এটি নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা মনে করে। কারণ ছেলেদের যেভাবে বড় করা হয় তাতে তারা স্বভাবতই দায়িত্বশীল ভূমিকায় থাকে, নারীবাদের কারণে এটি খর্ব হওয়ার ভয় হয় তাদের।
অন্য পুরুষরা হয়ত বলবে, “ঠিক আছে, এটা দারুণ, কিন্তু আমি এভাবে ভাবি না। আমি এমনকি জেন্ডার নিয়েও ভাবি না”।
হয়তো না।
এবং এটি হলো সমস্যার একটি অংশ, অনেক পুরুষ সক্রিয়ভাবে জেন্ডার নিয়ে ভাবে না এবং জেন্ডার বিষয়টি খেয়ালও করে না। এসব পুরুষরা বলে, যেমন আমার বন্ধু লুইস বলত, “আগে হয়তো বিষয়গুলো খারাপ ছিল কিন্তু এখন সবকিছু ঠিক আছে”। এসব পুরুষরা পরিবর্তনের জন্য কোনো কাজও করে না। আপনি যদি একজন পুরুষ হন, এবং কোনো রেস্টুরেন্টে যান, ও সেখানে যদি ওয়েটার শুধু আপনাকে অভ্যর্থনা জানায় তাহলে আপনি কি ওয়েটারকে বলার প্রয়োজন মনে করেন যে, “আপনি কেন তাকে (সাথের নারী) অভ্যর্থনা জানালেন না?“ পুরুষদের এই সমস্ত আপাতদৃষ্টিতে ছোট বিষয়গুলোতে কথা বলা দরকার।
কারণ জেন্ডার নিয়ে আলাপ অস্বস্তিকর হতে পারে। এ সংক্রান্ত আলোচনা শেষ করার সহজ উপায়ও আছে।
কিছু লোক বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞান ও বানরের কথা নিয়ে আসবে, নারী বানর কীভাবে পুরুষ বানরের সামনে মাথা নত করতো- ইত্যাদি। কিন্তু মূল কথাটি হলো: আমরা বানর নই, বানর গাছে গাছে চরে বেড়ায় আর কেঁচো খায়। আমরা তা করি না।
কিছু লোক বলবে, “আসলে দরিদ্র পুরুষের জীবন খুব কঠিন”। হ্যাঁ, তাদের জীবন কঠিন।
কিন্তু এই আলাপটি এসব বিষয়ে নয়। জেন্ডার ও শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য আছে। দরিদ্র পুরুষদের সম্পদ না থাকার অসুবিধা থাকলেও তাদের পুরুষ হওয়ার সুবিধাটুকু অন্তত আছে। আমি কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে নিপীড়ন ও একে অপরের প্রতি কীভাবে অন্ধ হতে পারে সে সম্পর্কে জেনেছি। আমি একবার জেন্ডার নিয়ে কথা বলছিলাম, এবং এক পুরুষ আমাকে বললো, “আপনাকে একজন নারী হিসেবে থাকতে হবে কেন? একজন মানুষ হিসেবে কেন নয়?” এ ধরনের প্রশ্ন হলো কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাকে নীরব করে দেওয়ার এক উপায়। অবশ্যই আমি একজন মানুষ, কিন্তু এই পৃথিবীতে আমার প্রতি এমন কিছু বিশেষ ঘটনা ঘটে- যা আমি একজন নারী হওয়ার কারণেই শুধু ঘটে থাকে। যাই হোক, ওই একই পুরুষ প্রায়ই তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ বলে তার বিরূপ অভিজ্ঞতাগুলো বলে থাকেন। (এগুলো সম্পর্কে আমি বলতে পারতাম, “আপনার অভিজ্ঞতাগুলো কেন একজন পুরুষ বা মানুষ হিসেবে দেখছেন না? একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নিজেকে দেখছেন কেন?”)
তাই এই আলোচনাটি জেন্ডার নিয়ে। কিছু লোক বলবে, “ওহ, কিন্তু নারীদের হাতে সত্যিকারের ক্ষমতা রয়েছে: তলদেশের ক্ষমতা”। (যেসকল নারী তার যৌনতা ব্যবহার করে পুরুষদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে তাদের জন্য এই কথাটি নাইজেরিয়ায় ব্যবহার হয়ে থাকে)। কিন্তু তলদেশের ক্ষমতা আসলে কোনো ক্ষমতাই নয়। কারণ তলদেশের ক্ষমতা সম্বলিত নারী আসলে ক্ষমতাবান নন, অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষমতায় টোকা দেওয়ার জন্য তার কাছে শুধু একটি উপায় আছে, এই যা। যদি ওই পুরুষ অসুস্থ হয়ে যায় বা তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় অথবা যদি সে সাময়িক অক্ষম হয়ে যায় তবে তলদেশের ক্ষমতা সম্পন্ন নারীটির কী হবে?
কিছু লোক বলবে, একজন নারী পুরুষের অধীন কারণ এটি আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু সংস্কৃতি নিয়মিত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। আমার ১৫ বছর বয়েসি দুই জমজ ভাইঝি আছে। তারা যদি একশো বছর আগে জন্মাতো তবে তাদের জন্মের সাথে সাথেই দূরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো। কারণ শত বছর আগে ইগবো সংস্কৃতিতে জমজ বাচ্চার জন্মকে কুফল হিসেবে মানা হতো। আজ কিন্তু ওই চর্চাটি সমস্ত ইগবো মানুষের কাছে অকল্পনীয়।
সংস্কৃতির মূল বিষয়টি কী? চূড়ান্ত বিচারে সংস্কৃতি মানুষের সংরক্ষণশীলতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কাজ করে। আমার পরিবারে আমিই সেই শিশু, যে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পূর্বসূরিদের ভূমি এবং আমরা কারা এসব গল্পে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলাম। আমার ভাইরা আমার মতো এসব বিষয়ে অতো আগ্রহী ছিল না। কিন্তু আমি সংস্কৃতিতে অংশ নিতে পারিনি, কারণ ইগবো সংস্কৃতিতে পুরুষদের সুবিধা দেওয়া হয় এবং যেখানে প্রধান পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই সভায় শুধুমাত্র পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অংশ নিতে পারে। তাই আমি এসব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও, সভায় অংশ নিতে পারতাম না। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে পারতাম না। কারণ আমি একজন নারী।
সংস্কৃতি মানুষ তৈরি করে না। মানুষ সংস্কৃতি তৈরি করে। যদি নারীর প্রতি পূর্ণ মানবিকতা আমাদের সংস্কৃতি না হয়, তবে আমরা এখন এটিকে আমাদের সংস্কৃতি বানাতে পারি এবং তা করা আবশ্যক।
আমি প্রায়ই আমার বন্ধু ওকোলোমোর কথা ভাবি। ওই বিমান দুর্ঘটনায় সে সহ যারা প্রাণ হারিয়েছেন তারা যেন শান্তিতে থাকেন। আমরা যারা ওকোলোমোকে ভালোবাসি তারা সবসময় তাকে স্মরণ করব। বহু বছর আগের ওইদিন সে যখন আমাকে ‘নারীবাদী’ বলেছিল, সে আসলে ঠিকই বলেছিল। আমি একজন নারীবাদী।
এবং এত বছর আগে, যখন আমি শব্দটির অর্থ জানার জন্য ডিকশনারি খুলেছিলাম, সেখানে বলা হয়েছে: নারীবাদী: একজন ব্যক্তি যিনি লিঙ্গসমুহের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমতায় বিশ্বাস করেন।
আমি গল্প থেকে জেনেছিলাম, আমার দাদীর মা একজন নারীবাদী ছিলেন। তিনি যে লোকটিকে বিয়ে করতে চাননি তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে যাকে তিনি পছন্দ করতেন তাকেই বিয়ে করেছিলেন। যখনই তার মনে হয়েছিল তিনি নারী হওয়ার কারণে জমির অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে তখনই তিনি আপত্তি করেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন এবং কথা বলেছিলেন।
তিনি ‘নারীবাদী’ শব্দটিও জানতেন না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে তিনি নারীবাদী ছিলেন না। আমাদের আরও অনেককে এই শব্দটি নিজেদের জন্য বলে দাবি করা উচিত। আমার চেনা সবচেয়ে সেরা নারীবাদী হলো আমার ভাই কেইন, সেও একজন দয়াশীল, সুদর্শন এবং খুবই পুরুষালী যুবক। আমার নিজস্ব নারীবাদী’র সংজ্ঞাটি হলো—একজন নারী বা পুরুষ যে বলবে, ‘হ্যাঁ, জেন্ডার নিয়ে আজকের দিনেও সমস্যা রয়েছে, এবং আমাদের অবশ্যই এটি ঠিক করতে হবে। আমাদের অবশ্যই আরও ভালো করতে হবে’।
নারী এবং পুরুষ আমাদের সবাইকেই আরও ভালো করতে হবে।
সমাপ্ত