সমতায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষই নারীবাদী
নন্দিতা সিনহা।। সৃষ্টির আদিকাল থেকে নারী ও পুরুষ মিলে যে সমাজবদ্ধ জীবনের সূচনা করেছিল সেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল আজকের এই উন্নত মানবসভ্যতা। আর সমাজের প্রতি একজন সামাজিক মানুষের এক প্রবল টান, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য বংশানুক্রমিকভাবে আপনা আপনি চলে আসে। আমিও এই সমাজে সাধারণ পরিবেশে সাধারণভাবে বেড়ে উঠেছি, তাই আমিও এর বাইরে ছিলাম না। ভাবলেও অবাক লাগে এই পাঁচ বছর আগে পর্যন্তও কতটা বিশ্বাসী ছিলাম এই সমাজের প্রতি, যে বিশ্বাস ও আনুগত্যের ঘোরে আমার জীবনের এমন চিরসবুজ অধ্যায়ও নিজ হাতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি যা আজ চাইলেও পেতে পারি না। কিন্তু যখন আমার কৈশোরের বিদায়কাল উপস্থিত, সাবালক হলাম, ধীরে ধীরে সমাজ জীবন বুঝতে শুরু করলাম, নিদারুনভাবে আবিস্কার করলাম, এই সমাজ হলো পুরুষবান্ধব। নারী এখানে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেই গন্য নয়। নারী এই সমাজে দিনের পর দিন ভারবাহী পশুর মতো জীবন যাপন করে, নারীর নিজের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর সুখ স্বপ্নগুলোও অবহেলিত হতে হতে একসময় হারিয়ে যায়।
পিতৃতন্ত্র তথা পুরুষতন্ত্র নামক অসম অমানবিক সিস্টেমের যাতাকলে নারীর পিষ্ট হওয়া আমার হৃদয়কে মর্মাহত করেছে দিনের পর দিন। আমিও বুঝতে পারলাম এত দিন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি আমার অন্ধবিশ্বাসকে। হ্যাঁ, অন্ধবিশ্বাসই। অসচেতনতায় কেবল একপাক্ষিক পরিচয়ে অন্যের দেখাদেখি জন্মানো বিশ্বাসটা নিছক একটা অন্ধবিশ্বাসই।
আমি বলছি না যে শুধুমাত্র নারীই শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে, পুরুষকেও হতে হয় অবশ্যই। তবে নারী হওয়ার কারণে নারীর উপর যে শোষণ ও নিপীড়ন চলে পুরুষকে পুরুষ হওয়ার কারণে সেইসব অন্যায় আচরনের মধ্যে পড়তে হয় না।
নারীর এই শোষিত হওয়া ও তার প্রতিকার নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটা সময় পর আমি নারীবাদ শব্দটার সাথে পরিচিত হই। এরপরই কিছুটা পড়াশোনার পর আমি নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবে আবিষ্কার করেছি। নারীবাদী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কারের পূর্বেই অবচেতনে নিজের জীবনের পরিপ্রেক্ষিতেই আমি নারীবাদী হয়েছি।
নারী হিসেবে ও সর্বোপরি মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্য ও অন্যায়ভাবে নারীর শোষিত হওয়ার বিরুদ্ধে চিন্তায় ও মননে সচেতনতাই আমার নারীবাদ। নারীবাদকে সাম্যবাদ বলতেও আমার আপত্তি নেই, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের নির্মম বলির শিকার নারীকে যেভাবে হতে হয়, পুরুষকে সেভাবে হতে হয় না। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিতের পক্ষ নিয়ে আমি নারীবাদ শব্দের প্রয়োগই শ্রেয় মনে করি।
নারীবাদ শুধুমাত্র নারীদের পক্ষেই নয় এমনকি পুরষসহ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ যারা অসহায়ভাবে পুরুষতন্ত্রের দাসে পরিণত হয়েছে তাদের কথা বলে। নারীবাদে বিশ্বাসী হয়ে আমি কখনোই মানুষ হিসেবে আমার ন্যায্যতার অতিরিক্ত কোনো সুযোগ বা সুবিধাপ্রাপ্তির প্রত্যাশী নই।কলেজের ফরম ফিলাপ এর দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর অনেকক্ষণ পর একটামাত্র বসার সিট পাওয়া গেলে আমার ছেলেবন্ধু আমাকে বসতে বললেও আমি বসিনি, কারণ গাড়ি করে কলেজে যাওয়া আমার চেয়ে তপ্তরোদে দীর্ঘ রাস্তা সাইকেলে করে আসা আমার বন্ধুর বসার প্রয়োজনীয়তা বেশী বলে আমার মনে হয়েছে। পরে অবশ্য আমরা কেউই বসি নি, আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তার বসতে যাওয়াটা তার পুরুষত্বের অপমান বলে মনে করেই হয়তো সেও বসতে পারেনি।
কয়েকদিন আগেও জুতো সেলাইয়ের দোকানে অর্ধেক জুতো সেলাইয়ের পর দেখি একজন লোক এসে তাগাদা দিচ্ছেন উনারটা যেন আগে সেলাই করে দেওয়া হয়। আর সেলাই যিনি করছেন তিনি সঙ্গত কারনেই রাজি হন নি, তাকিয়ে দেখি লোকটার ভাড়া করা গাড়িতে দুজন মহিলা ও বাচ্চাসহ বাক্স পেটরা বেধে কোথাও যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমার তেমন তাড়া ছিল না বলে আমি নিজে বলে পরে আসা লোকটারটা আগে সেলাই করিয়েছি। আমাদের মুখে মুখে যে ‘লেডিজ ফার্স্ট’ বলে যে সুবিধাবাদী অযৌক্তিক মিথ প্রচলিত আছে নারীবাদী হিসেবে আমি সেটার আপাদমস্তক বিরোধী।
নারীবাদ শুধুমাত্র নারীর একপাক্ষিক সুবিধা বা কর্তৃত্বের দাবি করে না। সকলক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও প্রয়োজনীয়তাই বিবেচ্য। অন্যকিছু নয়। কেউ কেউ আবার নারীবাদের সমতার পরিপ্রেক্ষিতে বাসের মহিলা সিট রিজার্ভেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন। সেই বিষয়ে বলতে গেলে রাস্তায় চলা ও পাবলিক যানবাহন ব্যবহার করা প্রত্যেক নারীই জানেন রাস্তায় গাড়িতে এই পচা গলা সমাজের কতজন পুরুষের চোখেমুখে ফুটে ওঠা ধর্ষকামকে পাশ কাটিয়ে প্রতিনিয়ত চলতে হয়। এমনকি পাবলিক বাসের ভেতরেও চলে ধর্ষণসহ নানান নিপীড়ন। তাই যতদিন না সমাজের লিঙ্গবৈষম্য বিলোপ হবে, যতদিন না নারী পাবলিক বাসের পুরুষদের মধ্যেও কমফোর্ট ফিল করছে ততদিন নারীর জন্য সিট রিজার্ভেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে।
ফ্রাঙ্কেস্টাইনের দানবের মত পুরো মানবসমাজে জেঁকে বসা পুরুষতন্ত্রের শিকার শুধু নারীই নয়, পুরুষ নিজেও এই পুরুষতন্ত্রের একজন দাস। সংসারের ঘানি একা টানতে টানতেই পরিবারের পুরুষ সদস্যের জীবন একসময় শেষ হয়ে গেলেও এই শ্রমজীবী মানুষটার অনেক আশা-আকাঙ্খা, ইচ্ছে, শখ পূরণ করার সময়টুকুই হয়ে ওঠে না। শ্রম দিয়েই চলেন যতদিন পর্যন্ত শরীরের শেষ শক্তি বিদ্যমান। কিন্তু তারপরও পুরুষতন্ত্রের সমর্থনকারী নারী ও পুরুষের দ্বারা সচেতন ও অসচেতনভাবেও নারীকে অবদমিত করার প্রক্রিয়া আজও প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকটভাবে বিদ্যমান।
হে পুরুষ, আপনি কি জানেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতান্ত্রিক নারী কী কারণে আপনাকে পুত্র, স্বামী, ভাই হিসেবে পেয়ে ধন্য হয়? কারণ আপনি তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর যোগান দেবেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, বৃদ্ধ বয়সে তাদের সেবা করবেন, আপনার ঘাড়ে বসে এরকম নানাবিধ সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে নারীসহ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাকি সদস্যরাও। আর এসব কাজ তারা পুরুষকে যুগের পর যুগ ধরে করতে দেখতেই অভ্যস্ত, সমাজও যেহেতু পুরুষবান্ধব, তাই পুরুষ নিজে একজন দাস হয়েও একাই সমস্ত সংসারের ঘানি টেনে টেনে নারীকে অবদমিত করে করে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে না দিয়ে, নারীকে দাস বানিয়ে নারীর উপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। নারীও এই সিস্টেমে এতটাই আকণ্ঠ ডুবে থাকে যে কখনো কখনো নারী বুঝতেই পারে না তাকে যে সিস্টেমটা মানুষ থেকে একটা ভারবাহী মেশিনে রূপান্তরিত করেছে সেটা আসলে এই পুরুষতন্ত্রই।
নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবতেই আমাদের কেমন যেন একটা দ্বিধা কাজ করে। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষতন্ত্র বংশবিস্তার করে বেঁচে আছে। প্রমাণ চান? ঠিক আছে, যদি আমাদের বলা হয়, ‘একজন মানুষ চেয়ারে বসে বই পড়ছেন’ তাহলে নিসন্দেহেই প্রায় সবাই অবচেতন মনে সেই ‘মানুষ’টার যায়গায় একজন পুরুষকে কল্পনা করেছেন, নারীকে নয়। সমাজের শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষের মানসপটে নারী দ্বিতীয় লিঙ্গের প্রাণি, মানুষ সে আজও হয়ে উঠতে পারে নি। যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাসত্ব করে আসা নারী শুধু শারীরিকভাবেই নয়, এমনকি মানসিকভাবেও এই দাসত্ব সাদরেই গ্রহণ করে।
একমাত্র নারীবাদই পারে নারীকে তার হাজার বছরের কূপমন্ডুকতা থেকে জাগিয়ে তুলতে।নারীবাদ শুধুমাত্র নারীর জন্যই প্রযোজ্য নয়, নারীবাদ নারী-পুরুষ-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের কথা বলে। নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষই একেকজন নারীবাদী। যতদিন না এই সমাজের নারীর নিপীড়ন ও শোষণের সংস্কৃতি বন্ধ হবে, যতদিন নারী পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তার মানবিক অধিকার প্রাপ্ত হয়, যতদিন না এই সমাজে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমতা বিধান হচ্ছে ততদিনই সমাজে নারীবাদের উপযোগিতা থাকবে এবং আমিও ততদিনই নারীবাদে বিশ্বাসী থাকব।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]