দেনমোহর অথবা সম্পত্তির সমানাধিকার
মিলি স্বপ্নময়ী।। মুসলিম বিবাহ রীতি অনুযায়ী, বিয়ে হলো এক ধরনের চুক্তি এবং দেনমোহর হলো বাধ্যতামূলকভাবে অবশ্যই পালনীয় একটা শর্ত। বিয়ের প্রথম রাতের মধ্যেই মোহরানা পরিশোধ করাকে ধর্ম মতে উৎসাহিত করা হয়েছে। পারলে বিয়ের আসরে এক হাতে দেনমোহরের টাকা শোধ করে অন্যহাতে বর কনেকে গ্রহণ করে। বউ তালাক দিলে, ছেড়ে চলে গেলে, পরকীয়া করলে, কোনো অবস্থাতেই দেনমোহর মাফ হয়ে যায়না।
অনেকে অবশ্য মনে করেন যে, বউ যদি স্বেচ্ছায় স্বামীকে তালাক দেয়, তাহলে হয়ত দেনমোহর পরিশোধ করার প্রয়োজন হয়না অথবা দেনমোহর মাফ হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা।যেকোনো আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করলেই এর সত্যতা সম্পর্কে যাচাই করে নিতে পারবেন।
দেনমোহর হলো মুসলিম রীতিতে বিয়েতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শর্ত, যা কোনো অবস্থাতেই বরখেলাপ করার সুযোগ নেই।
ব্যক্তিগতভাবে দেনমোহরের নিয়ম নিয়ে আমার কিছুটা আপত্তি আছে। আমার কাছে মনে হয় যে, বিয়ের আসরে বা তার পরবর্তী সময়ে যেই আর্থিক লেনদেনের বিষয় সামনে চলে আসে, তাতে মূলত একপক্ষ অন্য পক্ষকে কিনে নেয়। যেমন কোরবানির সময় বাজারে গিয়ে দরদাম করে আমরা সবচেয়ে ভালো গরু কিনি, মোটাতাজা গরু কিনি, যেন আরাম করে, আয়েশ করে, সারাবছর ফ্রিজ ভরিয়ে রেখে মাংস খেতে পারি, তেমনি পাত্রীপক্ষ নিজেদের বিভিন্ন কিছু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মোহরানার পরিমাণ বাড়াতে চায়। অপরদিকে পাত্রপক্ষ চেষ্টা করতে থাকে কীভাবে দরদাম কমিয়ে মোহরানা একটা নির্দিষ্ট অংকে নির্ধারণ করা যায়। অনেকক্ষেত্রে তো মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণ করা নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক থেকে শুরু করে কথা কাটাকাটি হয়, তারপর ঝগড়াও লেগে যায়। এইক্ষেত্রে কোরবানির গরু আর বিয়ের কনের মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্তত কোনো তফাত খুঁজে পাইনা।
যে মেয়ে উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, যার নিজের ক্ষমতা এবং যোগ্যতা আছে নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারেও অবদান রাখার, সে কেন লাখ লাখ টাকা দেনমোহর নেবে? মানে সবদিক থেকে পরিপূর্ণ হবার পরেও যে মেয়ে কয়েক লাখ টাকা মোহরানা নিতে চায়, সেই মেয়ে নিজেই কি তার অর্জিত শিক্ষা, যোগ্যতা এবং অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না? নিজেকে অপমান করছে না? অথবা বলা যায় সে চরম লোভী। ভবিষ্যতে কোনো কারণে যদি তার সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে, তবে কয়েক লাখ টাকা দেনমোহর হিসেবে পেলে সেটা আসলে তার মুনাফা হয়ে যায়। মানে একটা বিয়ে করে যদি ১০-২০ লাখ বা আরো বেশি টাকা পাওয়া যায়, তাহলে মন্দ কি, বলেন?
এইবার দেনমোহরের একটা উপকারী দিকের কথা বলি। আমাদের দেশে অসংখ্য নারী আছেন, যারা পুরোপুরিভাবে স্বামী বা বাবার পরিবারের উপর নির্ভরশীল। যাদের উঁচু গলায় কথা বলার অধিকার নেই অথবা তাদের কথা বলার ক্ষমতা নেই, যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একেবারেই নেই নয়ত স্বল্পশিক্ষিত বা সামান্য অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা, যাদের বাপের বাড়ি বলেন আর স্বামীর বাড়ি বলেন, লাথি-ঝাটা খেয়ে দিন পার করতে হয়, এসব নারীদের জীবনে দেনমোহরের কিছুটা উপকারীতা আছে।
কোনো কারনে যদি এসব নারীদের বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে হয় অথবা বিচ্ছেদে বাধ্য হয় কোনোভাবে, তাহলে সবার আগে যদি তারা দেনমোহরের টাকা পেয়ে যান, তাহলে খুব বেশি উপকার না হলেও সামান্য কিছু উপকার তারা এইক্ষেত্রে পান। যদিও সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক অবস্থান অনুযায়ী দেনমোহরের পরিমাণে অনেক পার্থক্য দেখা যায়, তাই কারো বিয়ের মোহরানার পরিমাণ যদি দশ বা বিশ লাখ না হয়ে যদি দশ-বিশ হাজার টাকা হয়ে থাকে, সেইক্ষেত্রে একজন নারী ডিভোর্সের পর সারাজীবন এই দশ বা বিশ হাজার টাকা দিয়ে কীভাবে নিজেকে চালাবেন, সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
কারণ যে নারীর শিক্ষা নেই, কথা বলার অধিকার নেই,পরিবারে সম্মান নেই, যাকে পরিবারে বোঝা বলে মনে করা হয়, যার মেরুদণ্ড শুরু থেকেই ভঙ্গুর, তার সারাজীবন এই সামান্য টাকায় কীভাবে চলবে?
তারপর ও এসব ক্ষেত্রে কেউ যদি দেনমোহর পেয়ে যান, তাহলে খুবই সামান্য উপকার হয়। কিন্তু এই সামান্য উপকার প্রাপ্তি আসলে প্রকৃত সমস্যার সমাধান আনেনা।
অনেক মেয়েকেই দেখি জোর গলায় দেনমোহরের পুরো টাকা দাবি করে তার অধিকার বলে। কিন্তু ভুলেও সম্পত্তিতে সমান অধিকার দাবি করেনা। অথচ প্রথম দাবি হওয়া উচিত ছিল সম্পত্তির সমানাধিকার নিয়ে। আমার ভাই যদি আমার বাবা-মায়ের আদরের সন্তান হয়, তাহলে আমি মেয়ে হয়ে কি বানের জলে ভেসে এসেছি? নিশ্চয়ই না? যে অধিকার আমি জন্মসূত্রে পেয়েছি, সেই অধিকার যখন ধর্ম আর রাষ্ট্র দ্বারা খর্ব করা হয়, মোহরানা আমার অধিকার বলা মেয়েরা কিন্তু সেইক্ষেত্রে ভুলেও আওয়াজ তোলেনা, অথচ বিয়ের আসরে ঠিকই কোরবানির গরুর মতো নিজেকে নিলামে তোলে, এতে তাদের আত্মসম্মানে লাগেনা।
আরে যেখানে আপনার নিজের বাপ-ভাই আপনাকে সমান অধিকার দিচ্ছেনা, সম্পত্তিতে সমান ভাগ দিচ্ছেনা, সেখানে পরের বাড়ির ছেলে আর পরের ছেলের বাপ-মায়ের কাছে কীভাবে অধিকারের কথা তোলেন? আগে তো নিজের ঘরে নিজের অধিকার নিয়ে সচেতনতা দেখান, তারপর না হয় মোহরানার অধিকার নিয়ে কথা বলেন।
প্রকৃতপক্ষে মেয়েরা যদি সমানাধিকার পেত, সেটা শিক্ষা, সম্পত্তি, মানুষ হিসেবে অধিকার যে ক্ষেত্রেই বলেন না কেন, তাহলে আর পরনির্ভরশীল হয়ে অন্যের কাছে হাত পেতে দাবি তুলতে হতো না। এমনিতেই যে যার মতো স্বাবলম্বী হয়ে নিজেকে গুছিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারত। এইক্ষেত্রে মানসিকতার পরিবর্তন সবার আগে প্রয়োজন।
আর কেউ যদি ধর্মের নিয়মের কথা তোলেন, তাহলে বলব যে, পৃথিবীর বিকাশের সাথে এমন বহু নিয়মের পরিবর্তন হয়েছে, যা সভ্যতার প্রয়োজনেই করতে হয়েছে। সভ্যভাবে বাঁচার জন্য নিয়মের পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। পরিবর্তন মানেই প্রগতি। আর প্রগতি মানেই সামনে দারুণ কিছু সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়া।
এখন আপনি মানসিকভাবে সেই মান্ধাতার আমলের মতো জেনে বুঝে বা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবেন, নাকি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবেন, তা যার যার বিষয়। কিন্তু যারা এই পরিবর্তন আর প্রগতির কথা বলে, দয়া করে তাদের সাহায্য করতে না পারলেও পিছন থেকে সংঘবদ্ধভাবে টেনে ধরে রাখবেন না। কারন এদের পিছনে টেনে ধরে রাখতে চাইলেও আপনি বা আপনারাই যে পিছিয়ে রয়ে যাচ্ছেন, তা কি ভেবে দেখেছেন কখনো?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]