November 3, 2024
কলাম

বহু ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-জাতীয়তার সম্মিলনই সভ্যতা

মাসকাওয়াথ আহসান।। কয়েকদিন ধরেই ভাষা বিতর্কের একটা আবহ চারপাশে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে মারা গেছেন লেখক মুশতাক। চারিদিকে প্রতিবাদের ঝড়; কেউ অশুভের বিরুদ্ধে শুভর প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানাচ্ছে; কেউ বাক স্বাধীনতার দাবিতে মিছিল করছে; কেউবা জান ও জবানের স্বাধীনতা চাইছে। কেউ গায়েবানা জানাজার ডাক দিচ্ছে। কেউ খাটিয়া মিছিল করছে। কেউ শহীদ মিনারে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টবিরোধী গান ও পথনাটক-কার্টুন প্রদর্শনী আয়োজন করছে। মিছিলের সব মুখ- সব ভাষা-সব দেহভঙ্গী কিংবা আন্দোলনের সব পদ্ধতি কখনো এক হয় না। লক্ষ্যটাই আসল; অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

গান্ধীজী সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন; ভাসানী লংমার্চ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, অন্যায়ের প্রতিবাদে দৌড়াও; না পারলে হাঁটো; সেটাও সম্ভব না হলে মাটিতে পা ঠোকো।

ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন মানেই; প্রথমে সেই আন্দোলনের ডাক সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো; কার্যকর ভাষা যোগাযোগ স্থাপন; যে ভাষা সবাই বুঝতে পারবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে কারণে পাকিস্তান শাহীর নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙ্গালিকে তোমরা আর ‘দাবায়ে রাখতে” পারবা না। উনি প্রমিত ভাষার দাবিয়ে বা আটকে না বলে ‘দাবায়ে’ বললেন; জনমানুষের সবার কাছে এই বার্তা পৌঁছানোর জন্য। তাদের বুকের গভীরে মুক্তির তুফান তুলতে। এই ‘তুফান’ শব্দটি গণমানুষের; আর বুদবুদের মাঝে বসবাসবাসকারী লিভিং রুমের পলিটিক্যাল লিপ সার্ভিস নির্ভর মধ্যবিত্ত একে “ঝড়” বলে।

এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে যারা ধুলোপথ হেঁটে জীবনের নানা হাঁটাপথের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন; তারা জানেন সাধারণ মানুষ ‘দাবায়ে’, ‘জান’, ‘জবান’, ‘তুফান’ এইরকম শব্দ ব্যবহার করেন তাদের যাপিত জীবনে। তারা ন্যায়বিচারের মতো কঠিন শব্দের অর্থ বোঝেন না; ‘ইনসাফ’ শব্দটাই তারা বোঝেন। ‘নফস’ বা ‘রিপু’র তাড়না দমনের উপদেশ মুরুব্বীরা শিশুকাল থেকে দেন বলে, নফসিয়াত বা রিপুতাড়িত অপশাসন গ্রাম-বাংলার ভাষারীতিতে শত বর্ষ ধরে মিশে থাকা শব্দ। নাফস হচ্ছে মনের সেই স্পিরিট যা মানুষকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক কাজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আত্মা ও শরীরের মাঝের সেতুটি হচ্ছে নফস।

অতীতে শাসকেরা তাদের নিজ নিজ ভাষা চর্চা করেছেন এই বাংলায়। তাদের কারো ভাষা ছিল সংস্কৃত, কারো আরবি, কারো ফার্সি, কারো উর্দু, কারো হিন্দি, কারো ইংরেজি, কারো ফরাসি, কারো পর্তুগীজ। সহজিয়া বাংলা শব্দের সঙ্গে এই বিদেশি ভাষাগুলোর শব্দ সহজেই মিশে গেছে; নানা নদীর জল যেমন গিয়ে সমুদ্রে মেশে। সে কারণে অন্য ভাষাগুলো নদী হয়ে রয়ে গেলেও বাংলা হয়ে উঠেছে ভাষা সাগর। ক্রমে ক্রমে নানা ভাষার শব্দ সম্ভারের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে এই ভাষা।

এই যে হিন্দি ভাষা ও উর্দু ভাষা; এর সামান্য পার্থক্য হচ্ছে; হিন্দি ভাষায় সংস্কৃত ভাষার শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়। আর উর্দুতে আরবি-ফার্সি ভাষার শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কথ্যরূপে ব্যবহারের সময়; উভয় ভাষার একটি যূথবদ্ধতা আছে; সবার কাছে বোধগম্য শব্দগুলো নিয়ে হিন্দি-উর্দুর মাঝামাঝি আমি বলবো হির্দু ভাষাটিই বলিউডের ভাষা; হিন্দি ও উর্দু ভাষী তারুণ্যের ‘কমন ল্যাঙ্গুয়েজ’। উর্দু ভাষায় ফার্সি শব্দ বেশি থাকায়; তা কবিতার ভাষা হবার বেশি উপযোগী; তাই হিন্দি চলচ্চিত্রের সংগীতগুলোর গীতিকবিতা লেখা হয় উর্দু ভাষায়। আবার হিন্দি ভাষায় সংস্কৃত শব্দের যে ব্যবহার; তা নাটক ও চলচ্চিত্রের ভাষায় অলংকার এনে দেয়। তাই উর্দু নাটকের সংলাপে সেই সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। যে ভাষার যা কিছু ভালো; তা আহরণের; কারণ নিজ ভাষাকে সমৃদ্ধ করার আগ্রহ আগামীমনষ্ক মানুষের মনে থাকে।

আবার দীর্ঘকাল ইংরেজি ভাষা ঔপনিবেশিক ভাষা বলে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জার্মান ও চাইনিজ ভাষা নিজেদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সংকুচিত করে ফেলার পর যখন হুঁশ হয়েছে; বিশ্ববানিজ্য যোগাযোগের জন্য একটা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রয়োজন; তখন তারা ইংরেজি ভাষা শিখতে শুরু করেছে। চাইনিজরা এখন ভারতীয়দের চেয়ে ইংরেজিতে বেশি দক্ষ; এটা সাম্প্রতিক জরিপে বেরিয়ে এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতাই হচ্ছে ‘বুদ্ধি’-র সংজ্ঞা। একে অভিযোজন বললে ঠিক হয়; কিন্তু খাপ খাইয়ে নেয়া বললে; বেশিরভাগ পাঠক বুঝবেন।
বুদ্ধিমানরা পরিবর্তনকে ভয় পায় না। আর বোকারা গাল ফুলিয়ে বসে যায়; যে কোন পরিবর্তনে।

একবিংশ শতকে এসে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট, ইসলামিক সুপ্রিমিস্ট, হিন্দু সুপ্রিমিস্টরা ভাষা ও শব্দের মাঝে ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি-দখলদারিত্ব ইত্যাদি আদিম বিষয়গুলো খুঁজতে পারে। কারণ সুপ্রিমিস্ট মানেই আদিম চিন্তার ভোক্তা। শ্রেষ্ঠত্ব শব্দটি হীনমন্যের ভূষণ; ইনফেরিওরের ডিসকোর্স। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের বহিঃপ্রকাশই সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স।

এই যেমন ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের মানুষ; অগ্রসর চিন্তার ভোক্তারা কখনোই সত্যাগ্রহ কিংবা গায়েবানা জানাজা আন্দোলনের মাঝে ধর্ম দেখবে না। কিন্তু ইউরোপের ধার করা রেনেসাঁর ভোক্তা নব্য আধুনিক দক্ষিণ এশীয়রা ঠিকই সত্যাগ্রহের মাঝে হিন্দুত্ববাদ কিংবা গায়েবানা জানাজার মাঝে ইসলামপন্থা খুঁজে পাবে। হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের হিন্দুফোবিয়া বা ইসলামোফোবিয়াটাই দক্ষিণ এশিয়ার নব্য আধুনিকদের কাছে ফ্যাশনেবল ব্যাপার। দক্ষিণ এশিয়ার নিও এলিটদের এই মনোভঙ্গি দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামপন্থা ও হিন্দুত্ববাদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তিলক, পৈতা, দাড়ি, টুপি নিয়ে হাসাহাসি করে এখন দক্ষিণ এশিয়ার নিও এলিটেরা বিচ্ছিন্ন বুদবুদে বসবাসকারী নতুন গোরা সাহেব যেন।

ইনক্লুসিভিটি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহু ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-গোত্র-জাতীয়তার বর্ণিল সম্মিলনই হচ্ছে সভ্য ও সমসাময়িক জীবনচর্যা। এই সহজ বিষয়টি আমরা যেন ভুলে না যাই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]