বিজ্ঞাপনে নারীকে নিয়ে আর কত স্টেরিওটাইপ কাজ করা?
মেহেরুন নূর রহমান।। আমরা সকলেই জানি ব্যবসায় সফলতার জন্য অপরিহার্য বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন এমন একটি বিষয় যা একজন সম্ভাব্য গ্রাহকের ক্রয়ের ইচ্ছাকে সিদ্ধান্তে পরিনত করতে সাহায্য করে। এমনকি কার্যকর একটি বিজ্ঞাপন গ্রাহকের ভেতর এমন অনেক পণ্য কেনার আগ্রহ তৈরি করতে পারে যেটা সম্পর্কে তারা হয়তো অবহিত ছিল না কিংবা সে পণ্যটি হয়ত তাদের কেনার তালিকায় ছিল না।
সুতরাং হৃদয়গ্রাহী, আগ্রহ উদ্দীপক, কার্যকর বিজ্ঞাপন তৈরি করার ইচ্ছা সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর এই আগ্রহ জাগানিয়া বিজ্ঞাপন তৈরির বড় একটি হাতিয়ার হলো নারী। নানাভাবে, নানা ঢঙে, নানা রঙে, কারণে অকারণে নারীকে ব্যবহার করাই যেন এখন বিজ্ঞাপন সাফল্যের মূলমন্ত্র। নারীকে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেন, উপস্থাপন করেন, ঠিক আছে; কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় এই উপস্থাপনের ধরণে।
বিজ্ঞাপনে নারীর ব্যবহারের কিছু স্টেরিওটাইপস দেখা যায়। একটি স্টেরিওটাইপ হলো ঘরোয়া নারী। এখানে নারী ঘরের কাজে পটু, রান্নায় পটু, ঘর পরিষ্কারে পটু, কাপড় কাচায় পটু, বাথরুম ধোয়ায় পটু, ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরুষদের উপস্থিতি আগে তো একদমই ছিল না এ ধরনের বিজ্ঞাপনে, এখন বোধকরি কিছু কিছু এ ধরনের বিজ্ঞাপনে পুরুষদের দেখা যায়।
আরেকটি স্টেরিওটাইপ হলো, যৌনবস্তু হিসেবে নারীকে উপস্থাপন করা। দারুন শারীরিক গঠনের সংক্ষিপ্ত পোশাক পরা এসব নারীদের একমাত্র কাজ হলো পুরুষদের প্রলুব্ধ করা। অনেক সময় এরা সাইড কিক হিসেবেও বিজ্ঞাপনে উপস্থিত হয়। যেসব বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থিতির কোন দরকারই নাই সেখানেও নারীকে জোর করে ঢোকানো হয় শুধুমাত্র যৌন আবেদন তৈরির জন্য।
আরেক ধরনের নারীর দেখা মেলে বিজ্ঞাপনে যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে নিখুঁত, আরাধ্য। এরা হেঁটে গেলে বাতাস বইতে থাকে, গান বাজতে থাকে, পুরুষরা মাথা ঘুরে পরে যায় আর এরা অবহেলায় চারিদিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবলীলায় চলে চলে যায়। আহা! বাস্তবে এরকম কিছু নারীর দেখা পেলেও চোখ শান্তি পেত।
ইদানিং নারীরা জব করছে, শুধুমাত্র ঘরের কাজে আটকে নেই। সুতরাং এসব নারীকেও বিজ্ঞাপনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা ঘরে বাইরে সব জায়গায় ব্যস্ত। অফিসে কাজ করছে, বাসায় বাচ্চার ন্যাপি বদলাচ্ছে, রান্নাবান্না করছে। কেন যে এসব নারীর কোনো সাহায্যকারী থাকে না বা কেন তাদের স্বামীরা তাদের কোন কাজেই আসে না সেও একটা আলোচনার বিষয় বটে। সেটা না হয় অন্য কোন সময় করা যাবে।
আসলে আমি লিখতে চাচ্ছিলাম বিজ্ঞাপনে নারীর সৌন্দর্যকে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে। কিন্তু ধান ভানতে গিয়ে খানিকটা শিবের গীতও গাওয়া হয়ে গেলো আর কি।
তো উপরে যে সব স্টেরিওটাইপসের কথা উল্লেখ করলাম সেখানে একটা কমন বিষয় আছে। সব ক্ষেত্রেই নারীরা কিন্তু দারুন ফর্সা, ঝলমলে। বয়সের ছাপ নেই , মুখে কোন ভাঁজ নেই, একেবারে নিখুঁত। আমরা সবাই সুন্দর থাকতে চাই, সুন্দর দেখতে চাই। সুতরাং বিজ্ঞাপনে নারীকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের চেষ্টাকে আমি দোষ বলতে চাই না, কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের প্রথাগত সৌন্দর্যের বর্ণনায়। সমাজের আরোপিত সৌন্দর্য্যের সজ্ঞায়। যার ফলাফল আমরা বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখতে পাই। এ সমাজে ফর্সা মানে সুন্দর। এ সমাজে ৩৬-২৫-৩৬ মানে সুন্দর। অল্প বয়স মানে সুন্দর। আপনি কালো, আপনি অসুন্দর, আপনি খানিক মোটা, আপনি অসুন্দর, মুখে বয়সের ভাঁজ, আপনি অসুন্দর। এ সমস্যা কিন্তু দেশে বিদেশে সব জায়গায়।
বিজ্ঞাপনে আমরা যা দেখি তা এ সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। দুঃখজনক হলেও আমরা এক ভয়ংকর বর্ণবাদী সমাজে বাস করি। আর করি বলেই চামড়া ফর্সাকারী পণ্যগুলো এ দেশে রমরমা ব্যবসা করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় “কালো, তবু সুন্দর” জাতীয় অশ্লীল ফিচার ছাপা হয় যা আমাদের স্বাভাবিক লাগে।
বিদেশে থেকে দেখছি কত সহজে আমাদের দেশের মানুষেরা কালো মানুষদের কাইল্লা, কাউল্লা, নিগ্রো এসব বলে ডাকে অবলীলায়। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। দেশে ছেলের মায়েরা ছেলে যেমন তেমন, কিন্তু ছেলের বৌ হতে হবে ফর্সা- এই চিন্তায় পাগল হয়ে যায়। কালো মেয়ের মা বাবার মুখ অন্ধকার হয় দুর্ভাবনায়। মায়ের দিনরাত চিন্তা থাকে কি করে মেয়ের গায়ের রং ফর্সা করা যায়। আর মেয়েগুলোও দুধ হলুদ উপটান রূপটান ব্যবহারে থাকে ভীষণ উৎসাহী।
ফর্সা রঙের প্রতি মোহ ছাড়াও আমাদের দেশে আছে ভয়াবহ এইজিজম (ageism) বা বয়সবাদ।বয়স বাড়লে, মুখে খানিক বয়সের ভাঁজ পড়লেই নারী বিব্রত হতে থাকে, নিজেকে অসুন্দর ভাবতে থাকে। কারণ সমাজের ভাবনাটাই এরকম। কুড়িতেই বুড়ি এ দেশেরই প্রবাদ।
স্বাস্থ্যকর, সজীব, উজ্জ্বল ত্বকের জন্য চেষ্টায় দোষ নেই বরং ভালো। কিন্তু চেষ্টাটা যদি ফর্সা হবার জন্য বা বয়স লুকানোর পায়তারা হয় তবে তা হীনমন্যতারই পরিচয় বহন করে। এ বোধ আমাদের দেশের মেয়েদের/নারীদের কবে হবে কে জানে। গায়ের রং সাদা কালো যাই হোক না কেন, বয়স আপনার যাই হোক না কেন, স্বাস্থ্যকর ত্বক যে কারো সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে তোলে। ঠিক যেমন সুস্থ- সুগঠিত শরীর আপনাকে করে তুলতে পারে দারুণ আকর্ষণীয় যে কোন বয়েসেই। সুগঠিত শরীর বলতে আমি কিন্তু ৩৬-২৫-৩৬ বোঝাচ্ছি না। ফ্ল্যাট চেস্ট নিয়েও আপনি সুন্দর হতে পারেন। তেমনি বয়সের ভাঁজ নিয়েও যে কেউ হতে পারে সুন্দর।
আমাদের ফর্সা হবার, দাগহীন/ভাঁজহীন হবার, বয়স লুকানোর এই উদগ্র আর কদর্য আগ্রহের কারণেই আমাদের বিজ্ঞাপনে আমরা কখনো কোনো কালো মেয়েকে দেখতে পাই না। বয়স্ক নারীদের ব্যবহার কম হয় কিংবা হলেও সেই নারীর ত্বক থাকে বলিরেখাবিহীন ঝকঝকে। বিজ্ঞাপনেকায়দা করেই যে কমবয়সী ফর্সা (বা আর্টিফিশিয়ালী ফর্সা করা) নারীরা শুধুমাত্র যে সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্ব করছে তা না, কিছু কিছু বিজ্ঞাপনে সরাসরি বলা হচ্ছে গায়ের রং ফর্সা হলেই আপনি সুন্দর, এবং ফর্সা হলেই পুরুষদের আগ্রহ পাওয়া থেকে শুরু করে জীবনে সকল সফলতা অর্জন করা যায়।
তো সমাজের প্রতিবিম্ব এ ধরণের বিজ্ঞাপন পরোক্ষভাবে মানুষদের উপর নানারকম ভয়াবহ প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। একটা দুষ্ট চক্রের মত সমাজে ফর্সা মানেই সুন্দর, কিংবা বয়স হলেই নারীরা ফেলনা, অসুন্দর এই ধারণাকে পোক্ত করছে। এসব কারণেই কালো বলে হীনমন্যতায় ভোগা মেয়েরা দাগবিহীন নিখুঁত সুন্দরী হতে চায়, এবং তাদের ফর্সা হবার অবসেশন এমন পর্যায়ে চলে যায় যে ত্বকের জন্য ক্ষতিকর বস্তু দিয়ে তৈরি জিনিস জেনেশুনে ব্যবহার করতে পিছু পা হয় না। আর বয়স বেড়ে গেলে আত্মবিশ্বাস হারানো, নিজেকে অসুন্দর ভাবা নারীরা হাজার হাজার টাকা পার্লারে খরচ করে নিজেকে জোর করে তরুণী দেখানোর জন্য। বাইরের দেশে জিরো ফিগার কিংবা পারফেক্ট ৩৬-২৫-৩৬ মডেলদের কারণে কিশোরীরা না খেয়ে খেয়ে অ্যানরেক্সিয়াতে ভোগে, বাচ্চা মেয়েরাও ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করতে চায়, আর বয়স বাড়লেই প্লাস্টিক সার্জারির দিকে ঝুকে পরে বহু নারী।
যুগ পাল্টাচ্ছে, মানুষ আধুনিক হচ্ছে কিন্তু আমার কেন যেন শুধু পিছিয়ে পড়ছি। বিজ্ঞাপন সংস্থায় দেশের শিক্ষিত, আধুনিক ছেলেমেয়েরা জব করে বলেই জানি। তাদের বলছি, আর কত স্টেরিওটাইপ আইডিয়া নিয়ে কাজ করা? বদলান না কাজের ধরণ। বাইরের দেশে কিন্তু বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো চ্যালেঞ্জিং সব আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে। প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করেছে প্রথাগত ধ্যানধারণার উপর। তারা জিরো সাইজ হবার বিরুদ্ধে কথা বলছে। মোটা, কালো, ট্রান্সজেন্ডারসহ বিভিন্ন বয়সের নারীদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা বলছে বলিরেখা সুন্দর। মানুষদের ভাবতে শেখাচ্ছে তুমি যেমন তেমনই সুন্দর। সাধারণ জনগণকে উস্কে দিচ্ছে ভিন্নধারায় চিন্তা করতে, আরো বেশি মানবিক হতে, মানুষ হতে।
দেশের বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর প্রতি আহবান আর একটু দায়িত্বশীল হোন। যুক্তি দিয়ে কনভিন্স করুন আপনাদের ক্লায়েন্টদের। সাহায্য করুন না এ দেশের মানুষদের মান্ধাতা আমলের মানসিকতা বদলাবার! চেষ্টা করুন বোঝাতে- গায়ের রং যাই হোক না কেন না কেন, বয়স যাই হোক না কেন, যে কেউ সুন্দর হতে পারে, শুধু দরকার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। গায়ের রং কালো মানেই কেউ করুণার পাত্র নয়। প্রত্যেক বয়সের নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, তাই মুখে বয়সের বলিরেখা পড়লেই কেউ অসুন্দর নয়। যে যার মত আপন সৌন্দর্যে ঝলমল করতে পারে দারুন আত্মবিশ্বাসে।
মেয়েদের/নারীদের বলছি, পড়ালেখা করুন, শিক্ষিত হন, বাড়িয়ে তুলুন নিজের আত্মবিশ্বাস; তাহলেই বুঝতে পারবেন গায়ের রং ফর্সা করার, কিংবা জোর করে বয়েস কমিয়ে ফেলবার ইচ্ছাটা কত ঊন ভাবনা এবং কত অদরকারি। কত জরুরি, ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে জীবনে করবার এবং ভাববার। সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন, স্মার্ট হোন, শিক্ষিত হন, স্বনির্ভর হোন, এগিয়ে যান আত্মপ্রত্যয় নিয়ে; দেখবেন পৃথিবী লুটিয়ে পড়ছে আপনার পায়ের কাছে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]