December 23, 2024
সাহিত্যফিচার ৩স্যাটায়ার

গেরুয়া রঙ দে বাসন্তী

মাসকাওয়াথ আহসান।। জাকির আব্বাস একজন স্বাধীন লোক। ফেসবুকে সে তার স্বাধীনতা চর্চা করে। মোটামুটি লিখতে পারে। ফলে সাদা-কালো-হলুদ পাওয়ার জেনারেল রাণীদের চোখে পড়ে যায়। জাকিরের লম্বা চুল; ভেতরে ক্রিয়েটিভিটির সুপ্ত আগ্নেয়গিরি; কিন্তু “একটি কবিতা তার হলো না কোথাও ছাপা-পেলো না সে প্রতিভার দামটা”। সে সংবিধান ধরে ধরে অসাম্প্রদায়িকতার স্তম্ভ বাস্তবায়ন করে ফেসবুকে।

ধর্ম-নিরপেক্ষতা চর্চার প্রয়োজনে সে ফেসবুকে স্টেটাস দেয়, পূজা আইয়া পড়লো; অহনো কেউ নেমন্তন্ন করলো না।

এই ফেসবুকের স্টেটাসে আকালের সন্ধান দেখে ভটভটি আপা ঢাকা ক্লাবে দাওয়াত দেয়। ঢাকা ক্লাবে আমার একটা পূজোর নেমন্তনের ব্যবস্থা রয়েছে। এসো তোমাকে ভাইফোটা দেবো এঁই আব্বাস।

আব্বাস ঢাকা ক্লাবে ধুতি পরে পৌঁছে যায়। দায়োয়ান বলে, ঢাকা ক্লাবে লুঙ্গি ও ধুতি ডান্স নিষিদ্ধ থালাইভা। আপনে বঙ্গবাজার থিকা একটা প্যান্ট পিইন্দা আসেন।

আব্বাস তার ভটভটি থালাইভাকে ফোন করে। ভটভটি আপা ফোন ধরছেন না। এমন সময় প্রবেশদ্বারে পারবেন আপা উদয় হন, এই দায়োয়ান ওকে ছেড়ে দাও; দেখছো না ও ধর্ম নিরপেক্ষ। মুসলমান হয়েও ধুতি পরে এসেছে সনাতন ধর্মীদের সম্মান জানাতে।

পূজার স্থলে পৌঁছালে ভটভটি আপা বিলেতি আলিঙ্গনে স্নেহ বিনিময় করেন। ঘাবড়ে যায় জাকির। মাতৃগর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার পর; এই প্রথম নারী স্পর্শ। সারাজীবন আব্বাসের দীর্ঘ কবিতা শোনার ভয়ে নারীরা তাকে এড়িয়ে চলেছে।

আজ মাতৃরূপেণ সংস্থিতা ভটভটিদি আবারও আব্বাসকে টেনে নিলেন মাতৃক্রোড়ে। আব্বাস মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, “রেখো মা দাসেরে মনে।”

পারবেন আপা আগে বামদল করতেন; এখন সরকারি দলের ফেসবুক নেত্রী। তিনি চুকচুক করে বলেন, এই চিংকু বামগুলিরে নিয়া আর পারিনা। দেখছো জাকির, পিএম মোদির আগমনের প্রতিবাদে কী রকম অসভ্যতা করছে চিংকু বামগুলো আর ছাগুরা।

ঘাড় গুঁজ করে বসে থাকা একদা বাম; এখন ক্ষমতার ঘাম এক সাংবাদিক রাজ গাজির গান গেয়ে ওঠেন, বামাতিরা তো প্রটোকল বোঝে না; ভারতের পিএম-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমাদের নেত্রী; উনি তো মোদিকে আমন্ত্রণ জানাননি। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলো শ্রীলংকা। কিন্তু রাজাপাকসে দাওয়াত পেয়েছেন প্রটোকল অনুযায়ী। রাষ্ট্রীয় প্রটোকল না বুঝলে সেইসব ছাগু নিয়া কথা কইয়া লাভ আছে।

আব্বাসের মনে হয়, এ জীবন পূর্ণ হলো; ফেসবুকের এতো বড় বড় সেলিব্রেটির কাছে আসতে পেরেছে; তাদের আলিঙ্গন আর প্রজ্ঞার আলোয় দীপিত জাহিদের মনের মধ্যে এক ধরনের রুলিং এলিটের বাতাস এসে যেন লাগে। “নেশা লাগিলো রে; বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলো রে।”

সে আর্তনাদ করে, আল্লার ভীতি দেখিয়ে শাল্লার হিন্দুদের ওপর নির্যাতন করেছে যে স্বাধীন ও হেফাজত; এইরকম সাম্প্রদায়িক স্বাধীন আর কট্টর মামুনের দেশের মানুষ; পাশের দেশের সাম্প্রদায়িকতার সমালোচনা করে কীভাবে; এইটা ঠিক মাথায় আসে না।

অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছাত্র নেতা সনজিত ঘোষণা দিয়েছিলো, মোদির বিরুদ্ধে কোন কথা বললে কলিজা ছিঁড়ে নেবো। এরপর অসাম্প্রদায়িক ছাত্রলীগের জেন্টল পার্ক হামলা চালায় মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের তরুণ-তরুণীর ওপর। অতর্কিত হামলায় তরুণীদের মুখমণ্ডলে আঘাতের রক্ত ফিনকি দিয়ে উঠলে ফেসবুকের নারী অ্যাকটিভিস্টরা বিক্ষুব্ধ হয়, মোদি এদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ যে, তার বিরুদ্ধে একটা মিছিল করার দায়ে তরুণীদের পিটিয়ে আহত করা হচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরেই মোদির বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী; কৈ সেখানে তো নারী নিগ্রহ করেনি মোদির ভক্তরা। তার মানে কী এই বাংলাদেশে মোদির ভারতের চেয়েও বেশি ভক্ত তৈরি হয়েছে!

ছাত্রলীগের জেন্টলপার্ককে দেখা যায়, মেলস্ট্রিপারের মতো বস্ত্র বিসর্জনের তালে তালে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছে; দৃশ্যটি লোমশ তলপেট বের করে মেল বেলি ডান্সের এক কদাকার শিল্প রচনা করে। “যায় যাবে যাক মান; মোদি আমাদের ভগবান” এই ব্রতে পাতলুন হারিয়ে হলেও মোদির কুশ বা পুতুলটিকে পোড়ানোর হাত থেকে বাঁচিয়ে দৌড়ে পগার পার হয়ে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়। ভি আই পি হাসপাতালে প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট শেষে; মোদির কুশটিকে ঢাকা ক্লাবের পূজায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
জনরোল ওঠে, মোদিপ্রতিম এসেছে; মোদি প্রতিম এসেছে; আপারা পুতুলটি কোলে নিয়ে শৈশবে ফিরে যান যেন, ওরে পুতু পুতু, ওরে খুসু খুসু, খিদে পেয়েছে না বাবু, খিদে পেয়েছে; আঁ আঁ আঁ না কাঁদেনা কাঁদেনা; তোমাকে এক্ষুণি সেরেলাক দিচ্ছি; এই বুয়া মোদি বাবুর জন্য একটু সেরেলাক বানাও; বলতেই দৌড়ে আসে বুয়া।

নারী অ্যাকটিভিস্টরা প্রকাশ্যে মোদির ভক্তদের এই বস্ত্রবিসর্জনের সমালোচনা করে। “হ্যাশট্যাগ দেখতে চাইনা জেনিটাল পার্ক”; ট্রেন্ড চলতে থাকে ফেসবুকে।

ভটভটি দি সিঁথির সিঁদুর আঙ্গুলে একটু মাখিয়ে আব্বাসের কপালে তিলক এঁকে দিলে, আব্বাস ‘জয়শ্রীরাম’ বলে ফেসবুকে নারী নিগ্রহে নেমে পড়ে। নারী অ্যাকটিভিস্টদের ছবি শেয়ার করে “ফইন্নির ঘরের ফইন্নি” ডকট্রিনে আকথা-কুকথা লেখে; যাতে ঈর্ষা, ‘যৌবন জ্বালার” কামড়, জীবনব্যাপী নারীসঙ্গহীনতার বেহাগ আর সবশেষে ছিদ্র পিপের মতো অঝোরে খিস্তি ঝরতে থাকে।

এই স্ট্যাটাস দেখে পারবেন, পারতেন ও পারছেন আপারা খিল খিল হাসিতে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে উকুন তোলার সুখে, “জেন্টল পার্কের হামলা”র সমালোচনাকারী আর সে হামলায় প্রতিবাদী তরুণীর মুখে রক্তপাতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশকারী নারীদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছে জাকির; এমন লাস্যে জাকিরকে দশমিনিটের খ্যাতির টক অফ দ্য ঢাকা ক্লাব করে তোলে।

“মোদি পূজাই অসাম্প্রদায়িকতা, মোদির সফরের প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা, তাদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলার হুমকি অসাম্প্রদায়িকতা, মোদির মন্দির পরিদর্শন করে হিন্দুত্ববাদের গেরুয়া পতাকা ওড়ানো আর পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনি প্রচারণার প্রক্সি গ্রাউন্ড হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহারের প্রতিবাদে তরুণীর মুখমন্ডল থেতলে দেয়াটাই অসাম্প্রদায়িকতা।” গাজির গান এই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার পরে আরেকটি ডিসকোর্স নিয়ে আসে। “কিন্তু মোদির আগমনের প্রতিবাদে “সীমান্ত হত্যার বলি ফেলানি স্মরণে” আর “ভারতে গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মানুষ হত্যার” প্রতিবাদে গরু জবাই করে জিয়াফত আর কাঙ্গালি ভোজের আয়োজনটি অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক। এদেরকে চিহ্নিত করুন।”

একদা বামদলে শত্রু চিহ্নিত করার প্রশিক্ষণ নেয়া বর্তমান সরকার সমর্থক সুতরাং মোদি সমর্থকেরা “গরু খাওয়া মহাপাপ; অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক” এই ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

গাজির গানে আব্বাস আরো জানতে পারে, একদলীয় চীন একটি ব্যারাম; কিন্তু একদলীয় বাংলাদেশ খুব আরাম।
মোদি পূজায় শুরু হয় ভজনগীতি-

“হে মোর আসমুদ্রহিমাচল অধিপতি
তুমি আমাদের প্রাণের নৃপতি
চেতনার গেরুয়া রঙ দে বাসন্তী
রঙ দে ওরে রঙ দে ওরে রঙ দে বাসন্তী রে।