November 22, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

ট্রেন

নন্দিতা সিনহা।।

মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে নিনা ছুটে চলেছে। এই মাথাফাটানো যন্ত্রণা থেকে সে যতটা না ছুটছে তারও চেয়ে বেশি ছুটছে আবিরের সেই উক্তিগুলো থেকে। এত জোরে ছুটেও সেগুলোকে পিছু ছাড়াতে পারছে না নিনা। কানে এসে এখনও হাতুড়িমারা যন্ত্রণা দিচ্ছে।

রেলস্টেশনে পৌঁছে দেখতে পেলো ট্রেনটা সবে ছাড়ছে। আরেক দৌড়ে সেকেন্ড ক্লাসের একটি বগিতে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বেশ ফাকা বগিটা। জানালার কাছের একটা সিটে গিয়ে বসল। রাত ন’টার মত হবে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, না বেরিয়ে সে পারে নি। আবিরের কথাগুলো নিরন্তর কানে বেজে চলেছে, “কী করেছ তুমি বলতে পারো, আমার সুখের জন্য তুমি কিছুই করো নি।” নিনা আবারও জিজ্ঞেস করেছিলো, “কিছুই করিনি আমি!” আবির “না ” বলেছিল।

আবিরের সাথে নিনার বিয়ে হয়েছে সাড়ে চার বছর হতে চলেছে। নিনা সাড়ে চার বছর আগের নিনাকে এখন ঠিকমতো মনেই করতে পারে না। মাঝে মাঝে ফেসবুকের মেমোরিতে আগের লেখা কোনো কবিতা আসলে সে অবাক বিস্ময়ে একাধিকবার পড়ে।  একসময়ের নিজের লেখা কবিতাগুলোকেও আজ চিনতে কষ্ট হয়। লেখাও ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন। নিজেকে এতটাই বদলে ফেলেছে সে। নিজের জন্য তো নয়! অন্যের অভিযোগের সুযোগ না দিতে গিয়ে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। যদিও সে জানতো, পৃথিবীতে সবাইকে খুশি করার সাধ্য কারও নেই। কিন্তু বিয়ের এক বছরের মধ্যেই সে আবিরকে নিজের অজান্তেই প্রচন্ডভাবে ভালোবেসে ফেলেছিল।আর এই সরল ভালোবাসার  ঘোরেই সে একটু একটু করে পরবর্তীতে আবিরের সমস্ত অস্বাভাবিকতাকেও কেন  জানি মেনে নিলো আর নিজেকেও বদলে ফেলেছিল।

এই সাড়ে চার বছরে নিনা চারবারও সূর্যোদয় দেখেনি, পরিবারের মানুষদের একের পর এক খাবার বানাতে গিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। তারপর সারা দুপুর থেকে বিকাল, এরপর সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা বেজে যেতো, রান্নাঘরের কাজ কিছু না কিছু থাকতোই। পড়ন্ত বিকেলে বিছানায় গড়িয়ে বই পড়তে ভালোবাসতো, সেটা বিয়ের পর আর হয়ে ওঠেনি। রাতকে আলোকিত করা চাঁদের আলো তাকে চিরকাল টানলেও বাইরে বা জানালায় দাঁড়িয়ে একরত্তি চাঁদের আলো ছুঁতে পারে নি অনেকদিন অনেক মাস। মুডসুয়িং বলে কিছু আছে বলে আবিরের জানা নেই, যেটাতে প্রচন্ড ভুগতো নিনা। আশেপাশে বুঝতে না পারার মানুষের অভাবে সেটা আরো জমিয়ে ভুগাতো তাকে।সেও প্রচন্ড অভিমানী মেয়ে, অভিমানে কিছু বুঝতেও দিতো না। কিন্তু ভালো সে না বেসে পারে নি আবিরকে, তার নিজ আকাঙ্ক্ষা দিয়ে, নিজের মতো করে সে তাকে ভালোবেসেছিল। আর তা নিঃস্বার্থভাবেই।

আবিরকে ভালোবেসে সে কিছুই চায়নি, প্রকৃত অর্থেই কিছুই না। কিন্তু আবির শ্রম চেয়েছে, সন্তান চেয়েছে। কিন্তু নিনা সবকিছু ছেড়েছুড়েও শুধুমাত্র আবিরকে নিয়েই সুখি থাকতে পারত। এই বিশ্বাসের অযোগ্য পৃথিবীতে আবিরের উপর সমস্ত বিশ্বাস স্থাপন করার প্ররোচনা দিয়েছিল তার নিজ সত্তাও। আর এভাবেই সেই সত্তাকেও সে যেন বিক্রি করে দিয়েছে অজান্তেই। আবির তাকে প্রতি পদে অপমানিত ও অবহেলিত করে গেছে এতদিন যা নিনা নিজেও বুঝতে পারেনি বা চায়নি। নিনা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায়। সে কোনোদিনই আবিরের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয় নি, এমনকি যার তার সাথে আবিরের মেলামেশাতেও। আবিরের উপর অনাবশ্যক অনধিকার কিছু না চাপালেও তার ভালোবাসার উপর নিজের একান্ত এক অধিকার অনুভব করেছিল।

এক বছর আগে চুপিসারে ফোনে কারও সাথে আবিরের কথা বলার ধরনে সেই অধিকারের খুঁটি যেন নড়েবড়ে হয়ে গিয়েছিল। আর সেই সামান্য আভাসেই বাথরুমের দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেছে নিনা। কিন্তু যেদিন প্রমাণসহ আবিরের বিশ্বাসঘাতকতার চরম রূপ দেখল, কি নির্দয়ভাবেই না এতদিন আবির তাকে ঠকিয়ে এসেছে! নিনার নিরেট সরল ভালোবাসাকে আবিরের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে যেতে দেখলো, সেই সাথে নিজেকেও। চরম অসহায়বোধ হলো নিনার। এমন অসহায় সে কখনোও বোধ করে নি। সেদিন নিজের কাছে নিজেকেও পায়নি সে।নিজের জন্য তো সে নিজেকে রাখেইনি, দিয়ে দিয়েছে সর্বস্বই। তারপর দিন গেছে রাত গেছে, নিনা কিছু বুঝতে দেয়নি। আবির চিরকালই স্বার্থবাদী, কিন্তু বাইরে ভালোমানুষির এক বলয় সবসময় বজায় রাখত যার দরুন প্রথম আলাপেও অনেকেই সেটা বুঝতে পারত না। নিনা নিজেও সব জেনেবুঝেও এই ছলাকলা বুঝতে না পেরে ভালোবাসা ও ঘৃণার দোটানায় ভুগেছে অনেকদিন।

আজকাল নিনার কষ্ট হতে দেখলে  আবিরের কেমন জানি আনন্দ হয়। অন্ধকারেও নিনার চোখের জল টের পেলে সে আলো জ্বালিয়ে দেখে তার চোখের জলের গড়িয়ে পড়াকে। আবিরের চোখে তখন পুলকানুভূতি স্পষ্ট দেখতে পায় নিনা। আজ সন্ধ্যায় সামান্য কথা কাটাকাটি নিয়ে আবির অবলীলায় বলেই দিলো, “কী করেছো তুমি বলতে পারো, আমার সুখের জন্য তুমি কিছুই করো নি।”
– কিছুই করিনি!
– না।

নিনা মরিয়া হয়ে ভাবতে থাকলো, তাহলে এতদিন সে কার জন্য মন-প্রাণ-সর্বস্ব উজাড় করেছে, কার জন্য নিজেকে হারিয়েছে, কার জন্য প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়েও সকাল থেকে এই রাত অব্দি খেটেছে এই চার দেয়ালের ভালোবাসাহীন ঘরে!

ভাবতে ভাবতে সে কখন ঘর উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে টের পেলো না, যখন হুশ এলো তখন আর সে নিজেকে আটকাতে পারেনি, হাঁটার গতি ক্রমশ বেড়ে গিয়ে ও দৌঁড়াচ্ছে, সেই গতি এই রেল স্টেশন পর্যন্ত।জানালার বাইরে অন্ধকারের বুকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সে এই সাড়ে চার বছরের ভোগান্তি রোমন্থন করছিল। এই ট্রেনের কী নাম কোথায় যাচ্ছে সে কিছুই জানে না, জানার ইচ্ছেও নেই। মায়ের কথা মনে পড়লো, বাড়িতে সারাদিন খেটে দিনশেষে বাবার মুখে আক্ষেপ শুনেছে নিনা মায়ের প্রতি, “কী করেছ সারাদিন!” প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটে, নারীর অবদান কে কবে কোথায় স্বীকার করেছে।

এর মধ্যে পরবর্তী স্টেশনে নতুন যাত্রী উঠলে নিনাকে তার জায়গা ছাড়তে হলো। উঠে দাঁড়িয়ে রইল সে। এই কথাগুলোর তীব্রতা আজ বড্ড বেশি লাগছে, এমনকি মাথাব্যথাটাও সে টের পাচ্ছে না। মাথাটাকে ওজনহীন মনে হতে লাগলো। স্টেশনের পর স্টেশন থামে, তাকে পাশ কাটিয়ে যাত্রীরা সামনে থেকে পেছনে, পেছন থেকে সামনে এগোয়, কেউ কেউ কী যেন বলছেও, কিন্তু তার কানে কিছুই যাচ্ছে না। সে জানে না কোথায় যাচ্ছে, শুধু চাইছে এই ট্রেন যেন না থামুক, পেছনের সমস্ত স্টেশন, শহর, সম্পর্ক, স্বার্থবাদী ভালোবাসা, মিথ্যে প্রতিজ্ঞা, বিষময় বাক্য সবকিছুই দ্রুত পেছনে সরতে থাকুক, চিরতরে হারিয়ে যাক…