মেয়েদের চরিত্রবান হওয়ার লড়াই এবং এর সনদপত্র
মিলি স্বপ্নময়ী।। আচ্ছা,বাংলাদেশের বাজারে চরিত্রের কেজি কত করে, কেউ কি জানেন? আমার তো মনে হয়, এইখানে চরিত্র শব্দটি এত সস্তা দরে বিকানো যায় যে যখন তখন যেকোনো মূহুর্তে, যে কেউ যার তার চারিত্রিক সনদপত্র বিতরণ করে দিতে পারেন। কি, বিশ্বাস হচ্ছে না?
এই যেমন ধরেন মুনিয়া মেয়েটি, মাত্র দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট এক মেয়ে মুনিয়া, কতই বা বয়স হয়েছিল তার। অথচ তার চরিত্র হনন করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে দেশের কিছু দালাল মিডিয়া এবং চাটুকার সাংবাদিক। তার সাথে যুক্ত হয়েছে অধিকাংশ আমজনতা, যারা কিনা নারী চরিত্র নিয়ে আলাপ এত বেশি উপভোগ করে যে, এদের নিজেদের জীবনে হয়ত উপভোগ্য বস্তু বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই, তাই নারী-চরিত্র নিয়ে তারা পড়ে থাকে।
আপনাদের কথামতো না হয় ধরেই নিলাম যে, মুনিয়া একটা ‘চরিত্রহীন’ মেয়ে। সে পোশাক বদলানোর মতো করে প্রেমিক বদলাতো। সে অর্থলোভী ছিল, সবই না হয় মেনে নিলাম, তাই বলে কি তার ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত যদি কেউ দাবি করে, সেটা কি অন্যায় হয়ে যাবে? যারা মুনিয়ার ঘটনায় সঠিক তদন্তের জন্যে কথা বলবে, তারাও কি মুনিয়ার মতো চরিত্রহীন হয়ে যাবে?
ধরুন একজন যৌনকর্মী, তার কাজ যৌনতা বিক্রি। কিন্তু আইন অনুযায়ী সেই যৌনকর্মীরও যদি ধর্ষণের শিকার হয়, সেটিরও বিচার হতে হয়। নাকি আপনারা সেটিও বিশ্বাস করেন না? তখন তার খদ্দের সংখ্যা কত ছিল, বিছানায় সে কেমন ছিল, এই নিয়ে আলাপ করতে থাকবেন।
বাপ-মা মরা ছোট এক মেয়ে, যার বড় ভাই আলাদা সংসার নিয়ে ব্যস্ত, বোন নিজের সংসারে ব্যস্ত, সেই রকম দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ের বাস্তব জীবন আমরা কেউই কাছ থেকে দেখিনি, অথচ তার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা যতটা না মাথাব্যথা দেখাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি মাথাব্যথা আমাদের, তার প্রেমিক কয়টা ছিল, সেটাতে। দেশের আইন অনুযায়ী একাধিক প্রেম করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমন ধারা তো কোথাও লেখা নেই। এটা আইনের আওতাধীন কোনো বিষয়ও না, কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করা আইনের আওতাধীন বিষয়, শিক্ষিত আমজনতা এগুলোই ভুলে যায়।
অবশ্য চরিত্র নিয়ে চর্চা এইদেশে নতুন কিছু না। মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতের কথা মনে আছে তো? মুনিয়া যে বয়সে মারা গেলো, নুসরাতও তার কাছাকাছি বয়সের ছিল তখন। তার তো বিলাসী জীবন ছিল না, একাধিক প্রেমিক ছিল না, শিল্পপতির সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল না, কিন্তু নিষ্ঠুরভাবে তাকে যখন আগুনে ঝলসে দেওয়া হলো, একদল লোক, যারা কিনা তারই সহপাঠী ছিল, শিক্ষক ছিল, বন্ধু ছিল, পরিচিত ছিল, তারাও নুসরাতের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। নুসরাত নাকি ছেলেদের সাথে কথা বলতো। মাদ্রাসা ছাত্রী হয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলা নিশ্চয় তাদের কাছে গর্হিত অপরাধ, তা না হলে রাস্তায় তারা কীভাবে নুসরাতের বিরুদ্ধে নামতে পেরেছিল? মানে ছেলেদের সাথে কথা বলা যতটা অপরাধ, আগুনে ঝলসে দেয়া ততো বড় অপরাধ না এইদেশে, তাই সেই হুজুরের পক্ষে তারা আন্দোলন করেছিল। এইবার বোঝেন চারিত্রিক সনদপত্র কত সস্তা এই দেশে।
নুসরাতেরও আগে তনুর কথা ভাবেন, দেশের অন্যতম বড় নিরাপদ বেষ্টনীর ভিতর যখন তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হলো, তখন কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল তনু কয়টা মোবাইল সিম ব্যবহার করতো, রাত করে ঘরে ফিরতো এবং থিয়েটার করতো। এমনকি প্রাথমিকভাবে যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছিল তাতে বলা হয়েছিল যে, সে ধর্ষণের শিকার হয়নি, কারণ নিরাপদ বেষ্টনীর ভেতরের উপর-মহলের চাপ বলে কথা। পরে কিন্তু ময়নাতদন্ত অনুযায়ী প্রমাণ হয়েছিল তার ধর্ষণ হবার বিষয়টি।
অথচ সবসময় ভিক্টিমের পক্ষে কথা বলা, লাখের উপর ফলোয়ারওয়ালা তথাকথিত এক নারী সে সময় ফেসবুকে দাবি করেছিলেন তনু নাকি ধর্ষণই হয়নি! তার কথামতো যদি ধরেও নেই, তনু ধর্ষণের শিকার হয়নি, তবে কি তনু খুনও হয়নি? তনু খুনের বিচার কেন হচ্ছে না? অন্তত তার খুনিরা তো কেউ শিল্পপতি না, কীসের চাপ, কীসের ভয় আছে এতে? যখনই কোনো ঘটনা ঘটবে, যখনই কেউ ভিক্টিম হবে, হোক সে নারী অথবা পুরুষ, মানুষ হিসেবে ভিক্টিম যেন নায্য বিচার পায়, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয় সেই দাবি তোলা হলো মানুষ হওয়ার পরিচয়। ভিক্টিম কেমন ছিল, ব্যক্তিগত জীবনে কী করত, এসব নিয়ে আলাপ যদি তোলেন, তার মানে হলো আপনার মধ্যে ঘাপলা আছে। একজন নিকৃষ্ট খুনিকেও আইন যখন অধিকার দেয় আইনি সুযোগ গ্রহণ করার, সেখানে সাধারণ কেউ ভিক্টিম হলে, বিশেষ করে নারী ভিক্টিম হলে, আমরা এত চরিত্র নিয়ে উঠেপড়ে কেন লাগি, কেউ কি বলতে পারেন?
তনু, নুসরাত, মুনিয়াসহ অসংখ্য মেয়ে এইদেশে চরিত্রের দোষে দোষী। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখবেন যে, আমরা প্রায় সব মেয়েরাই কোনো না কোনোভাবে কখন যেন একেক জন তনু, নুসরাত,মুনিয়াসহ নাম না জানা অসংখ্য নারীর মতো চরিত্রহীন হয়ে যাই সমাজের কাছে। এই দেশে মেয়ে হয়ে জন্ম হয়েছে, আর জীবনে কোনো না কোনো পর্যায়ে চরিত্র নিয়ে কথা শোনেনি, এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
মেয়েরা সিগারেট খেলে চরিত্র নষ্ট হয়, হাত কাটা ব্লাউজ পরলে চরিত্র নষ্ট হয়, জিন্স পরলে চরিত্র নষ্ট হয়, কপালে বড় টিপ পরলে চরিত্র নষ্ট হয়, রাজনীতি করলে চরিত্র নষ্ট হয়, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলে চরিত্র নষ্ট হয়, এমনকি ঘরের ভিতরে মেয়েরা যদি হো হো শব্দে হেসে ওঠে তাতেও নাকি চরিত্র নষ্ট হয়।
চরিত্রবান নারী হওয়ার জন্যে এই দেশে মেয়েদের যে অব্যক্ত লড়াই করতে হয় আজীবন, তা যেন নরক যন্ত্রণার চেয়ে কোনো অংশে কম না। চরিত্র রক্ষার সংগ্রাম করে যেই দেশে মেয়েরা টিকে থাকে, সেই দেশে চারিত্রিক সনদপত্র এত সস্তা কেন, এইবার কি ঠিকঠাক বুঝলেন?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]