November 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মেয়ে তুমি ‘মুখরা’ই হও, ‘বেশ্যা’ও হও, যা ইচ্ছা হও

সুমাইয়া অনন্যা।। “যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা” এই প্রবাদটার কথা মনে আছে না? প্রবাদটার মানে এই যাকে ভালো লাগে না, তার সব নেতিবাচক দিকগুলোই চোখে পড়ে। আর আমাদের দেশে সবখানে ভালো না লাগার জায়গাটা হচ্ছে “নারী”, তার যত কিছুই ভালো হোক, যত কিছুই ভালো করুক, কিছুতেই কারুর ভাল লাগে না। সব দোষ নারীর।

নারী সমাজের গড়ে দেয়া বক্সের মধ্যে সুন্দরী হলে তাকে নিয়ে পরিবারের উদ্বেগ যে কখন কী হয়ে যায়! ‘মেয়ে তুমি ঢেকে রাখো, ঢেকে থাকো, সব সৌন্দর্য স্বামীর জন্য তুলে রাখো।’ আর ঢেকে থেকে কিছু হলেই- ‘বোরকার নিচে কী কী করে বেড়ায় মেয়ে, ছি ছি! এই মেয়ে তো বেশ্যা, কিছু ঘটেছে নাকি? রূপ দেখায়ে নিজে ঘটাইছে এসব। অন্য কারো দোষ আছে নাকি?’

নারী এই বক্স এর বাইরে অসুন্দরী হলে- ‘মেয়ে বিয়ে দেবো কীভাবে? এতো ঘরের বোঝা।’

নারী বেশি শিক্ষিত হলে- ‘মেয়েদের এতো পড়াশোনা করে লাভ কী? বেশি শিক্ষিত মেয়েরা সংসার টিকাইতে পারেনা।’

নারী শিক্ষিত না হলে- ‘নূন্যতম শিক্ষা নেই, বিয়ের সার্টিফিকেট নেই এই মেয়েরে কে বিয়ে করবে? বিয়ে করলেও সোসাইটিতে কীভাবে পরিচয় করাবে তার স্বামী?’

নারী পরকীয়া করলে অবশ্যই নারীর দোষ কিন্তু স্বামী পরকীয়া করলেও নারীর দোষ। ‘জামাই সামলে রাখতে পারো না মেয়ে?’ এইসবের বাইরেও জামাই কিছু করলে তার দায়ও নারীর। ‘জামাইরে আটকে রাখা শিখতে হয় বুঝছো?’

স্বামী বউকে ভালোবাসলে, তারে সাহায্য করলে, একটু আগে বাসায় ফিরলে- ‘সে কি জামাই নাকি? ভেড়া, ভেড়া। বউ পাগল, বউয়ের আঁচলের তলে থাকে। বেটা মানুষ এমন হয়?’

এই যে এতো এতো দোষের ভারে নুয়ে পড়তে পড়তেও আজকের নারীরা যখন সব ছেড়ে ছুড়ে নিজে কিছু করতে চাচ্ছে, কাজ করতে চাচ্ছে তখন কি সুন্দর সুষ্ঠু সুযোগ পাচ্ছে? পরিবেশ পাচ্ছে? আর পেয়েই লাভ কী? পুরুষ ঘর ছাড়লে হয় বাদশা, আর নারী ঘর ছাড়লে হয় বেশ্যা- মুরুব্বিরা তো শুধু শুধু বলে যায়নি!

এর ওর দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে একটা কাজ পেয়ে, কাজে নিজের জায়গা করে নিতে নিতে ততদিনে কত হয়রানি, অ্যাবিউজ, নির্যাতন সহ্য করে, সমাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে যখন সে একা বাঁচতে চাচ্ছে, একা থাকতে চাচ্ছে; নিজের টাকায় থাকছে, খাচ্ছে, পরছে, ঘুরছে তখনও কি সে এইসব দোষ, পাপের দায় থেকে মুক্তি পাচ্ছে?

এতো সহজ? তাই মনে হয়? ওই মুরুব্বীরা তো ভুল বলে যাননি।

কাজে ভালো প্রমোশন পেলে, ফেইস ভ্যালু বাড়লে তখন ‘নিশ্চই বসের সাথে শুয়েছে তাই এই পজিশনে যেতে পেরেছে।’

আর কোনোমতে নিজের চলে যায় টাইপ কাজের ক্যারিয়ার বয়ে গেলে, ফেইস ভ্যালু না থাকলে, তখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মেয়ে একা থাকে কীভাবে? কী করে সে? কে দেয় টাকা? কার রক্ষিতা সে? বাপ- মা খোঁজ রাখেনা? মেয়ে তো বেশ্যা।’ (যতই আইডি ফাইডি থাকুক। লাভ নাই। নীলক্ষেত থেকে এইসব বানায়ে নেয়া যায়, বুঝিনা ভাবছো?)

পুরুষতন্ত্রের এইসব কেচ্ছাকাহিনীর সারাংশ বলতেছি শোনেন। সারাংশ হইলো, সমাজের গড়ে নেয়া বক্সের কারণে যেসব নারী ঠেকে পড়ে ‘বেশ্যা’ হয়ে জীবন যাপন করছে তাদের ছিল্ তো মারাই আছে আগে, আর যারা “বেশ্যা” প্রথায় না থেকেও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে জীবন যাপন করে, সমাজকে থোরাই কেয়ার করে, পুরুষতন্ত্ররে মধ্যাঙ্গুলি দেখায়ে নিজের জীবন যাপন করছে, তারাও হচ্ছে বেশ্যা।

তাহলে কী দাঁড়াইলো? নারী কি চাইলেও এসব দোষ, পাপ, বেশ্যাপনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারছে? যেহেতু নারী হয়ে জন্মাবার দায়, বেশ্যাপনার দায়, মুখরা হবার দায় নারী এড়াতেই পারছে না, তাহলে সে কেন এতো অপচেষ্টা করছে? কেন এসব ভেবে তার নিজের প্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করছে? একটাই জীবন, ছোট্ট একটা জীবন। এতো ভেবে কী হবে? ভেবে কে কী করেছে কবে? তারচেয়ে বরং সমাজের তৈরি করা বক্স খুলে ফেলো মেয়ে, তাদের অপ্রস্তুত করো, অপ্রস্তুত তাদের দেখে খিলখিলিয়ে হাসো, তোমার হাসিতে তাদের চোখে ভয় দেখে আরো হাসো।

মেয়ে তুমি মুখরা হও, মেয়ে তুমি পাপিষ্ঠ হও,

মেয়ে তুমি মারকুটুরি হও, মেয়ে তুমি বেশ্যা হও

আর জীবনকে বয়ে না বেড়িয়ে যাপন করে যাও জীবনের মত!

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

মেয়ে তুমি মুখরাই হও, মেয়ে তুমি বেশ্যাও হও, যা ইচ্ছা হও