September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর মনের ভুবনে পুরুষ কি আদৌ প্রবেশ করে?

অনন্যা গোস্বামী।। গত নারী দিবসে নিজেকে একমুঠো কাঁচের চুড়ি কিনে দিয়েছিলাম। খালা পরিয়ে দিয়েছিলেন সযত্নে। দাম নিয়ে একটুও বিতণ্ডা করিনি। তিনি যা চেয়েছিলেন, তাই-ই দিয়েছি। একটা দিন নাহয় দশ-বিশ টাকা বেশিই পেলেন খেটে খাওয়া মানুষটা।

গত ভালোবাসা দিবসে একটা টিপের পাতা কিনে দিয়েছিলাম নিজেকে। আর পয়লা ফাল্গুনে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম ঝরেপড়া পলাশ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে জ্বর ছিল খুব। এক পাতা প্যারাসিটামল নিজেই কিনেছিলাম।

সবই নিজেই নিজেকে দিই। আর কেউ দেয় না। আর কেউ দেওয়ার নেই, দেখার নেই। অন্তত কোনো পুরুষ না। না বাবা, না ভাই, না ছেলে, না স্বামী, না কোনো প্রেমিক বা বন্ধু।

এক পুরুষকে  দীর্ঘদিন অর্থে, বন্ধুত্বে, সঙ্গদানে ভরিয়ে রেখেছিলাম। এক মাসের চাকরির বেতনের টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম শখের গিটার কেনার জন্য। প্রায় দশ বছরে সে আমাকে একটা দশ টাকার টিপের পাতাও কিনে দেয়নি।

কোনো এক প্রেমপ্রত্যাশীকে, যে নাকি মানুষকে খুব বোঝে এবং বিশেষত নারীর জন্য তার ভাবনা ও প্রচেষ্টার গভীরতা ব্যাপক, তাকে বলেছিলাম, আমাকে দেওয়ার বা আমার জন্য করার মতো কিছুই নেই।  তবে তার আবেগের ও মগজের আবহাওয়া বোঝার জন্য আবদার করেছিলাম, নিজে পছন্দ করে একমুঠো কাঁচের চুড়ি কিনে দিতে।  সে দেয়নি। সে দেবেও না। কারণ সে ভুলে গেছে। সে মাথায়ই নেয়নি।

এক পুরুষকে বলেছিলাম, রাতে দরজা-জানালা লাগিয়ে পূর্ণগতিতে পাখা চালিয়ে রাখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। শীত লাগে, নিঃশ্বাস নিতে পারি না। সে বলেছিল, এটা নাকি আমার মানসিক সমস্যা। হিস্টাসিন খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। সেই পুরুষটির জীবনে ৮ বছর যুক্ত ছিলাম। তার জামা, জুতা, গেঞ্জি, মোজা, জাঙ্গিয়া, চুল-চিরুনি, অফিসের ফাইল, বাজারের থলি, সামাজিক- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি সবখানটা জুড়ে ছিলাম। কিন্তু সে আমার জগতঘরের ঘুলঘুলিতেও কোনোদিন উঁকি দেয়নি। আমি তার ব্রণ, ব্ল্যাকহেডস তুলে দিতাম। প্যানপ্যানও করতাম। কিন্তু সে আমার হাতে ভাতের মাড়ের ফোসকা দেখেনি কোনোদিন। মধ্যরাতে জ্বরাক্রান্ত আমি বমি করে টলমল পায়ে বাথরুম থেকে ঘরে ঢুকে দেখেছি সে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে হা করে নাক ডেকে। আমি তার মাথাব্যথার মলম মালিশ করে দিয়েছি কতো অসংখ্যবার। সে আমার হাত কেটে জীবাণু সংক্রমণ হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে সেটা দেখতে পেয়ে আমাকে অসাবধান ও বোধশক্তিহীন বলে গালমন্দ করার পর মলম এনে দিয়ে বলেছে, মেখে নাও। আমি তার রোজকার পোষাক ধুয়ে ইস্ত্রি করতে দিয়েছি। সে কোনোদিন জানেনি, আজ সকালে কোন রঙের পোশাক পরে আমি বেরোলাম।

সে অনেক গল্প। সেই পুরুষ আর এখন আমার ভুবনে কোথাও নেই। আমি তার জীবনে ছিলাম ৮ বছর। সে আমার জীবনে ছিল না একটা মুহূর্তও।

যদিও দিয়েছে সে আমাকে অনেক। আট বছরে শতাধিক শাড়ি যার অধিকাংশই উচ্চ মূল্যসম্পন্ন।

ওসব শাড়ি, প্রতি সপ্তাহে স্টার কাবাবে বিরিয়ানি, ঘরভরা দামি শোপিস তো আমি চাইনি। আমি কী চেয়েছিলাম, তা ঐ পুরুষ বোঝেনি, জানেনি, জানতে চায়ওনি। এই প্রসঙ্গটা তার মাথায়ও আসেনি।  শুধু সে কেন? কোনো পুরুষই কি এটা ভাবে বা জানতে চায়?

ভাববে কেন? প্রয়োজনই তো পড়ে না। ঘরের নারী সে মা, বোন, স্ত্রী, কন্যাসন্তান বা প্রেমিকা যাই হোক, তার হাতের আঙুল, চোখের কোল, কপালের ঘাম এসবের দিকে কখনও কি চোখ যায় পুরুষের? পুরুষ তো ঘরে এলেই ঠান্ডা পানি, গরম চা বা কফি, সাথে পত্রিকা বা টিভির রিমোটটা পেয়ে যায়। কম্পিউটারের মনিটর বা টেলিভিশনে চোখ রেখে আপনমনে নিজের দিনযাপনের আনন্দময় বা নিরানন্দ ঘটনার গল্প করতে শুরু করে দেয়। কে যে এসে ফ্যান বা এসিটা অন করে দিলো, সামনে ফল বা পিঠাটা যে কোথা থেকে এলো তা তার চোখে পড়ে না। তার জন্য পাকোরা  ভাজার পেঁয়াজ কুচি করতে গিয়ে আঙুল কেটে ঘরের নারীটি যে উহ্ করে ওঠে তা কি পুরুষের কানে যায়? তারপর তড়িঘড়ি করে আঙুল মুখে পুরে দিয়ে পুরুষটির পছন্দ ও রুচিমতো খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয় সেই নারীই। পুরুষটি ঐ নারীকে কাছে পেলে তার প্রেম, মমতা, শ্রদ্ধা, আনুগত্য, নির্ভরতা সবই প্রত্যাশা করে এবং পেয়েও যায়। কিন্তু পুরুষ ঐ নারীর মুখের দিকে একবারও তাকায় কি? সেই নারীরও তো অনেক কথা বলার থাকতে পারে। তারও তো কোমর ব্যথা, মন খারাপ, বাসায় ফেরার পথের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা, অফিসের কাজের চাপ, সহকর্মীর দুর্ব্যবহার, কেরিয়ারের টানাপোড়েন, দেশ ও বিশ্বের নানা ঘটনা নিয়ে নিজস্ব ভাবনা, কাছের মানুষদের নিয়ে কথা বা নাহয় অন্তত পাশের বাসার ভাবির নতুন হেয়ার কাট নিয়ে গল্প থাকতে পারে। সে ঐ পুরুষের কথায় তাল দেয়া, তার কাজে হাত দেয়া, তার মনে মন মেলানোর ব্যস্ততায় হয়তো ভুলেই যায় যে তার নিজেরও ভীষণ মন খারাপ ছিল, শরীর খারাপ ছিল, উথাল পাতাল ক্লান্তি ছিল, মেজাজ গরম ছিল। তারও প্রয়োজন ছিল কারও আলিঙ্গন, মাথায় হাতের স্পর্শ বা একটু পাশে বসা। ঐ পুরুষ, যে তার বাবা, ভাই, সন্তান, স্বামী বা প্রেমিক তাকে আর বলা হয়ে ওঠে না, আমাকে দেখো,  আমার দুটো কথা শোনো, আমার সাথে একটু থাকো, নিজেকে একটু আমাকে দাও, একটু আমার হও।

তাই পুরুষেরও কখনোই নারীর হয়ে ওঠা হয় না। নারী পুরুষকে ভালোবাসে, ভয় পায়, সম্মান দেয়; শ্রদ্ধায়, মমতায়, বন্ধুত্বে ভাসিয়ে-ডুবিয়ে রাখে। কিন্তু পুরুষ জানতেও পারে না যে সে কোনোদিনই নারীকে পায় না, পুরুষ নারীকে কখনোই OWN করে না।

 

অনন্যা গোস্বামী: গণমাধ্যমকর্মী ও লেখক