শিউলি, আমার লজ্জা লাগে!
সুমাইয়া আলম।। জন্মের পর থেকেই মেয়ে বাবা-মায়ের আমানত, বিয়ের পরে স্বামীর আমানত- এই বাক্যটা একটু বুঝতে শেখার পর থেকেই আমি অহরহ শুনতাম। কখনো বা মা আমাকে বলছেন, কখনো পাড়ার কাকিমা’রা একসাথে গল্প করতে বসে বলতো, কখনো বা দাদী-নানী তার নাতনীদের শুনাতো। আমরা একটু বুঝতে শেখার পর থেকেই নিউরনে এই তথ্য রেখে দেই যে “তুমি মেয়ে, তুমি অন্যের ওপর নির্ভর করো”।
একবার শুনলাম গ্রামের বাজারে পুলিশ এসে দুই মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। তাদের অপরাধ বেটা ছেলের মধ্যে বাজার করতে আসা, স্বামী থাকা সত্ত্বেও। সে গল্প আবার সব পুরুষ লোকে পান খেয়ে পিক ফেলতে ফেলতে বা বিড়ি টানতে টানতে যে জানেনা তাকে জানাচ্ছে। যাই হোক, এ কিন্তু মহা এক পাপ। মেয়েমানুষ বাসায় ঘোমটা টেনে বসে থাকবে হাট শেষে বাজারের আশায়, কারণ তাদের মাছ-মাংস কিংবা তরকারির ভালো বা মন্দ বোঝার ক্ষমতা কই!ছোটবেলা থেকে বাপ-মায়ের সংসারই তোমার সংসার এবং বিয়ের পরে স্বামীর সংসারই তোমার সংসার। অথচ এই দুই সংসার থেকে মেয়েদের যদি ভালো ব্যবহার করা হয়, তখন সেটাকে আমরা বলি “লক্ষী কপালের মেয়ে”। এবং অন্য মেয়েরা বা কাকিমা’রা তা নিয়ে মাথা কুটতে থাকে, বলে- আহারে, এমন কপাল কজন ছেমড়ির হয়।
ভাবখানা এমন সব মেয়েই তো দুঃখ সহ্য করে, ওর কপালটা এমন সুখের হলো। অথচ এই দুই সংসারে একটু ভালো খাওয়াদাওয়া বা জামা-কাপড় কিংবা গহনাগাটি ছাড়া মেয়েদের আসলে কিছুই নেই। এমনকি স্বামীর সংসারের অভাবে সেসব গহনাগাটিও মাঝেমধ্যে গচ্চা দিতে হয়। দিনশেষে মেয়েটার হাতে না থাকে স্বাধীনভাবে কাউকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা, না থাকে নিজের জন্য কিছু করার ক্ষমতা।
পাড়ার এক কাকার বউ মরার পরে সে নিঃস্ব হয়ে গেল, কারণ তাকে দেখভাল করার মতো কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা সবাই বড় হয়ে গেছে, ছোট যে একটা মেয়ে স্কুলে পড়ে সে তার পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। দুদিন হলো বউ মরেছে, সবাই উঠে পড়ে লাগে লোকটার আরেকটা বিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ সে জোয়ান এখনো, বয়স মাত্র ৫২। এ বয়সে বিয়ে না করলে তাকে অফিসে যাওয়ার সময় সবকিছু গোছগাছ করে দেবে কে? ঠিক সময়মতো অফিস থেকে ফিরলে এক গ্লাস পানি ঢেলে দেবে কে? বাসার ১৪ বেলার রান্না করবে কে? আহারে! অমুক ভাই কাজের লোকের হাতের রান্না আবার খেতে পারেনা। এমন কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে কম দেখা যায়না পুরুষ বা মহিলাদের। অথচ আমি খুব ছোট থাকতে একজন মেয়েকে দেখলাম তার স্বামী রেখে পালিয়েছে। তখন আপার বয়স ১৫/১৮ বছর হবে। গ্রামে মেয়েদের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়। আপা তার এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে এসে বাপের বাড়িতে ভাইদের সাথে উঠলো। ভাইয়ের বৌ তারে উঠতে বসতে খোঁটা। কেনই বা দেবেনা, বিয়ের পরে বাপের বাড়ি আসতে হবে নায়রে।বছরে দুই দিন এসে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ থাকার পর হাসিমুখে আবার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যেতে হবে। বাবার বাড়িতে বিয়াইত্তা মেয়ের আবার কীসের ঠাই! বাপের আমানত এখন স্বামীর আমানত হয়ে গেছে। আরেকজনের আমানতের দায়ভার বাপের বাড়ির লোকজন কেনই বা নেবে? যাই হোক যা বলছিলাম, তো আপার ওই বাচ্চা বয়সে সবাই বুঝাইলো স্বামীর ঘর তো বছর খানেক করছোই। আল্লাহ সুনার টুকরো একখান ছাওয়াল দেছে তোমারে। ছাওয়ালের আশায় মানুষ বিয়ে করে, তা তোমার কোল জুড়ে আইছে, তোমার আর দ্বিতীয় বিয়ে কী দরকার?
একটা মেয়ের আর যৌবন কীসের? শরীরে আবার কী? কীসেরই বা এত চাহিদা? সেও জানালো তার আর বিয়ের দরকার নেই। সে ছেলেকে বুকে ধরে বাকি জীবন কাটায় দেবে।
প্রায়ই দেখা যায় বিয়ের ঘটকালিতে পরহেজগার, নরম স্বাভাবের, স্বামীসেবাপরায়ন গ্রাম্য মেয়ে খুঁজতে। এসব মেয়ে নাকি বিয়ের জন্য পারফেক্ট। দুই কথা শুনায়েও বেশ মজা, উত্তর নেই। দু ঘা পিঠে পড়লেও তালাক দেওয়ার ক্ষমতা নেই। যতই হাঁসফাস করো, স্বামীর ঘর ছাড়া তোমার থাকার জায়গা নেই। দুদিন আগেই আমার পাড়ার এসএসসি পাশ করা এক মেয়ের বিয়ে হলো ঢাকাতে বড়লোক ব্যবসায়ীর সাথে। অথচ তার বড় বোনকে দেখতে এসেছিল।বড়বোন অনার্স পড়ায় তাকে পছন্দ করলো না ছেলেপক্ষ। তাদের কথা- শিক্ষিত মেয়েই যদি বিয়ে করবে তাহলে গ্রামে কেন আসবে? মেয়ে মানুষ এত পড়ালেখা করুক তাদের পছন্দ না। পড়াশুনা করলে মেয়েমানুষ বিগড়ে যায়।তাই তারা ছোট বোনকে পছন্দ করলো। বাপ মা সানন্দে ছোট মেয়েকে ধারদেনা করে বিয়ে দিয়ে দিলো। আর গ্রামের সবাই একজন আরেকজনকে বলতে লাগলো “এত শিক্ষিত হয়ে লাভ কী হইলো, সেই তো বিয়ে হইলো না”। ছোট বোনের হচ্ছে সোনার কপাল ব্লা ব্লা ব্লা। মাস ছয়েক পরে সে মেয়েকে ঢাকা থেকে তালাক দিয়ে পাঠিয়ে দিলো কারণ মেয়ে তাদের সংসার নাকি ভালো করে সামলাতে পারছে না। সে এখন বাড়িতে আসার পরে না পড়াশুনা আর শুরু করছে, না বাইরে তেমন বের হয়। কারণ তাকে তালাক দেওয়া হয়েছে, সেই অপরাধী। সেই পাড়ার মা-কাকীমারা এখন বলতে শুরু করেছে “ওলো মা*গী, সংসার ডাও সামলাতে পারলি না!” মাঠে বাপের অঢেল জমি জমা থাকুক কিংবা স্বামীর ব্যবসার রোজগার ভালো থাকুক, এক মাসে মেয়ে/বৌ এর জন্য এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার টাকাও থাকেনা। কারণ “মাইয়া মানুষের আবার এত সাজনদারী স্বভাব ক্যান, এত খরচা ক্যান” কবার ভেবে দেখেছি আমরা মাসে ১২০ টাকার স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার টাকা আমরা কতটা বড় করে দেখি?
এক আপু ছিলেন পড়ালেখায় অনেক ভালো। SSC এবং HSC’তে সে ভালো রেজাল্ট করলো। চান্সও পেলো রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। তো ওনার বাবার নাম ধরে আশেপাশের লোকজন বলতে লাগলো- অমুক কিন্তু বিয়ে না দিয়ে মাইয়াডারে ভার্সিটিতে পাঠায় কামডা ঠিক করে নাই। মাইয়া মানুষ এর পাংখা বাইধা না রাখলে বিগড়ে যায়।
আমি সেই ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম না মেয়েদের স্বাধীনতায় মানুষের এত ভয় কীসের! আপু এখন ভালো একটা চাকরি করে, বিয়েটা বিসিএস দিয়ে করবে। সবাই বলে আইবুড়ো মাগীর আর বিয়ে হবেনা। এমন বুড়ো মেয়ে বিয়ে করবে কে! মাইয়া মানুষ কচি না হইলে স্বাদ থাকেনা। অবাক হতে হয় একটু বেশি তখনই, যখন দেখা যায় একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে এমনভাবে বলছে। সেদিন আম্মার সাথে দেখলাম একটা আন্টি গল্প করছে। আন্টির সংসারে অনেক অভাব। ঠিকঠাকভাবে চলছেই না। তো আন্টির বাপের বাড়ির অবস্থা অনেক ভালো, সেখান থেকে সিকি অংশ জমিজমাও পেয়েছে। আম্মু বললো, এতই যদি কষ্ট হয় ওখান থেকে কিছু বিক্রি করে কোনো ব্যাবসার কাজে লাগান। সে অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকালো। বললো-এটা তুমি কীভাবে বললে? আমার ভাই, ভাইয়ের বেটা গেলে কত যত্ন করে। হাসিমুখে কথা বলে। তাদের সামনে আমি আমার জমি বলে দাবি করবো? এটা আমি কীভাবে করবো? আমি তাদের বাড়িতে গেলে তো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার কোনোদিন করেনি। ও জমি আমার না, শিউলি, বাপের বাড়ির কোনো সম্পত্তির কথা আমার মুখে নিতেও লজ্জা লাগে।
আমি কোনোভাবেই ক্যালকুলেশন মেলাতে পারলাম না কেন লজ্জা লাগবে! কেনই বা এত লজ্জার ঘনঘটা। কেনই বা এত সংকুচিত হয়ে যাওয়া। মেয়েরা কি ছেলের মতো বাবা-মায়ের একটা অংশ না? আচ্ছা একটা মেয়ে কেন পারেনা ছেলের মতো বাপের ভিটায় বসত করতে? সেফটি ফিল করতে? অধিকার নিয়ে বলতে “আমিও বাবা মায়ের সন্তান”। আর একটা বাবা কিংবা মা মেয়েটাকে একটা স্বাবলম্বী মানুষ হিসাবে সমাজে দাঁড় করাতে বা পরিচয় করাতে এত কেন পিছপা হয়? কীসের এত পিছুটান? কিসের এত বাধা?
সুমাইয়া আলম
থানা-মহাম্মাদপুর, জেলা-মাগুরা