প্রতিষ্ঠিত হোক নারীবান্ধব বিচার ব্যবস্থা
অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন ভুঁইয়া।। আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে দেনমোহর মামলা থেকে শুরু করে ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি অথবা যৌন হয়রানিতেও নারীকে বিচার চাইতে এসে কয়েকবার ধর্ষণের শিকার হতে হয়। প্রথমে শারীরিকভাবে, এরপর মেডিকেল রিপোর্ট তৈরিতে, তদন্তের সময়, চার্জশিট তৈরিতে, শুনানির সময়, জবানবন্দিতে, জেরার সময় ইত্যাদি।
নারীর এই বার বার ধর্ষণের শিকার হওয়ার একমাত্র কারণ প্রায় সব কাজেই পুরুষের উপস্থিতি। অথচ আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে নারী ও পুরুষের অধিকার চর্চার বিষয়ে সমতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। আবার অনুচ্ছেদ ১৯(৩) বলেছে, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ২৮(২) নিশ্চয়তা দিয়েছে যে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে।
পাশাপাশি আমাদের সংবিধান কেবল সমতার নিশ্চয়তাই বিধান করেনি, ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তাও দিয়েছে বেশ কিছু অনুচ্ছেদে। তার মধ্যে অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এবং ২৯(৩) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনুচ্ছেদ ২৮(৪) নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, সরকার নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে যেখানে ২৮ অনুচ্ছেদ বাধা হবে না।
অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ২৯(৩) বলেছে, যে শ্রেণির কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেরকম যে কোনো শ্রেণির নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা থেকে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না। সুতরাং একটা বিষয় স্পষ্ট যে ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টিকে অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে পুরুষদের জন্য বিশেষ কোনো আইন নেই, কেবল নারীদের সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই রয়েছে হরেক রকম আইন। যেমন- বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ (সংশোধিত ২০১৭), যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, (সংশোধিত ২০১৮), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত-২০০৩), এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও রয়েছে নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১। নারীকে নিরাপত্তা ও সম্মান দিতে এত আইন তৈরি হলেও বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা তা করতে রীতিমতো ব্যর্থ হচ্ছে। বিচার চাইতে এসে নারীকে প্রতিনিয়ত চোখের জল ফেলতে হচ্ছে, অপমানিত হতে হচ্ছে প্রতি পদে পদে।
Indian Evidence Act, ১৮৭২ এর নতুন সংযোজিত ধারা ৫৩ এর বিধান মতে, যৌন হয়রানি, বিবস্ত্র করা বা চেষ্টা করার জন্য বল প্রয়োগ, গোপন যৌন ক্রিয়া অবলোকন, যোগাযোগের গোপন চেষ্টা ও শান্তি নষ্ট, যৌন আঘাত, যৌন আঘাত করে মৃত্য বা বোধশক্তিহীন করা, সেপারেশন সময়ে স্ত্রীকে যৌন আঘাত, বিশ্বস্ত ব্যক্তি, সরকারি কর্মচারি, জেল বা রিমান্ড হোমে যৌন সঙ্গম, একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক একত্রে যৌন আঘাত, কৃত অপরাধের পুনরাবৃত্তি বা এগুলোর চেষ্টা সংক্রান্ত মামলায় ভিকটিমের সম্মতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে, সেক্ষেত্রে ভিক্টিমের চরিত্র বা অতীত যৌন অভিজ্ঞতা বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রাসঙ্গিক হবে না। ধারা ১৪৬ এ নতুন সংযোজিত অনুশর্তের বিধান মতে, ভিকটিমের সাধারণ অনৈতিক চরিত্র বিষয়ে বা অতীত যৌন অভিজ্ঞতা নিয়ে সাক্ষ্য দেয়া এবং ভিকটিমকে জেরা করা যাবে না।
অথচ আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাই যেখানে বিচারপ্রার্থী নারীকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে সেখানে ওই নারীকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারছে না। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে নারী অধিকার সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও রয়েছে যথেষ্ট। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারীতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙিক্ষত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারিতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। যাই হোক, আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪) অনুযায়ী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীবান্ধব বিচারব্যবস্থা বা আদালত প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]