অন্ধকার-বর্বরতার দিকে দ্রুত ধাবমান আমাদের কক্সবাজার
আবরার শাহ ।। বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার। কাগজে-কলমে না, মুখে মুখে বহুল চর্চিত ও প্রচলিত।দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য। প্রতি বছর দেশের অভ্যন্তরীণ লাখ লাখ পর্যটক হুমড়ি খেয়ে পড়েন কক্সবাজারে। যদিও পর্যটকদের জন্য ন্যূনতম সুবিধাটুকুও নেই এখানে। এক সমুদ্র সৈকত ছাড়া ঘুরে বেড়ানোর কিংবা সময় কাটানোর বিকল্প কোন সুবিধাও নেই। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ইতিবাচক ব্যবহার বহু দূরের কথা বরঞ্চ প্রকৃতির অকৃত্রিম দান কক্সবাজারকে কতভাবে নষ্ট করা যায়, বিকৃত ও ধ্বংস করা যায় তার অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাবেন এখানে।
পুরো শহরটি হোটেল, মোটেল, কটেজের ভারে পরিত্যক্ত প্রায়। ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা পুরো শহরের। সমুদ্র সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকেই মাঝারি উচ্চতার সর্পিলাকার যে পাহাড় শ্রেণি দেখা যেতো আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগেও, তার কোনো চিহ্নই আজ আর অবশিষ্ট নেই। বিচের মূল পয়েন্ট সংলগ্ন সেই পাহাড় শ্রেণিগুলো হোটেল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মে প্রায় নেই বললেই চলে। অল্প যে কয়েকটি পাহাড় আছে সেগুলোও অবৈধ দখলদারদের ভোগ-দখলে ও মাটিখেকো ভূমিদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে।
কক্সবাজারের প্রধান এবং একমাত্র আকর্ষণ সমুদ্র সৈকতের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। নিরবচ্ছিন্ন সৈকতের কিছু কিছু পয়েন্টে এমনভাবে হেটেল বানানো হয়েছে যে স্বয়ং সমুদ্রেরই শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুকে ব্যথা হয়। সারা শহরের যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়। পর্যটকদের নিরাপত্তার বালাই নেই কোথাও। হোটেল-মোটেলওয়ালা থেকে শুরু করে অটোরিক্সা-টমটমওয়ালাদের কাছে হয়রানির শিকার হওয়া তো নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিচে স্নান শেষে কিংবা স্নানরত অবস্থায় একটু জিরিয়ে নেবেন, সেই সুযোগও নেই। আছে ভাড়ায় চালিত কুৎসিত দর্শনের তিন চাকার বাইকের দৌরাত্ম, মৌসুমি ফটোগ্রাফারদের টানাটানি, অসহায় ঘোড়ার পিঠে চাপার জোর-জবরদস্তি আর যুগলদের দিকে তাক করে থাকা পাপারাজ্জিদের সদাসতর্ক ওঁৎ পেতে থাকা ক্যামেরার লেন্স। যদিও বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
সমুদ্র-স্নান শেষে বার্মিজ মার্কেটে টুকটাক কেনাকাটা ও ফিশ ওয়ার্ল্ডে উঁকিঝুঁকি মারা শেষে স্বাস্থ্যকর সময় কাটানোর কোন উপায়ই আপনি খুঁজে পাবেন না এখানে। কৃত্রিম বিনোদনের কোন ব্যবস্থায়ই নেই পুরো শহরে। বিকেল বেলা সবুজ প্রাঙ্গণে একটু হাঁটতে বেরোবেন, খোলা পার্কে ফুসফুস ভরে নির্মল বায়ু নেবেন সে সুযোগ কই? রাতে সঙ্গী-সাথী বা প্রিয়জনের সাথে বসে দেশি কিংবা বিদেশি সিনেমা উপভোগ করবেন সেই সুবিধাটুকুই বা কই?
উচ্চবিত্ত পর্যটকদের জন্য অবশ্য বিনোদনের সকল উপভোগ্য উপকরণের পসরা সাজিয়ে বসে আছে কক্সবাজার। আছে পাঁচ তারকা মানের কিছু হোটেল এবং অসাধারণ মানের কিছু ইকো রিসোর্ট, যেখানে আপনি আপনার ইচ্ছেমতো আনন্দ করতে পারবেন। এদের বেশিরভাগেরই আবার নিজস্ব এক টুকরো বিচও রয়েছে। সুতরাং উচ্চবিত্তের কক্সবাজার দর্শন আনন্দময়ই হওয়ার কথা।
তাই আমি দেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পর্যটকদের কথা বিবেচনা করছি, যাদের সমুদ্র দর্শন আদতে এক সমুদ্র দর্শনেই সীমাবদ্ধ থাকে। বছর দু’য়েক আগে অবশ্য শহরের কলাতলী পয়েন্ট থেকে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিমি মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধন করা হয়েছে, যে সড়কের প্রায় পুরোটা জুড়ে একপাশে সবুজ সর্পিল উঁচু-নিচু ধ্যানস্থ পাহাড় শ্রেণি ও অন্য পাশে প্রাণবন্ত গাঢ নীল জলরাশির গর্জন আছড়ে পড়ে। এক অপার্থিব মোহ-মায়ার মেলবন্ধন রচিত হয়েছে পুরো সড়ক জুড়ে। মেরিন ড্রাইভ দর্শন পর্যটকদের এতদিনের একঘেয়েমিতে কিছুটা প্রশান্তির সুবাতাস যেন। তবে ভ্রু কুঁচকানোর কারণ হলো মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে হাজার হাজার পর্যটন ব্যবসায়ির হাজারো বিলবোর্ডে ও সীমানা পিলারের বর্বরদশা। সড়কের দুই পাশকে পরিকল্পিতভাবে পর্যটন-বান্ধব করার কোন সরাসরি বেসরকারি উদ্যোগই চোখে পড়ে না। হয়তো মূল শহরের মত আগামী কয়েক বছর পরই এই অনিন্দ্য সুন্দর সড়কটিও হোটেল-মোটেলের চাপে পিষ্ট হবে।
অথচ প্রকৃতি কী উদারভাবেই না সাজিয়েছে কক্সবাজারকে। কী নেই এখানে? পাহাড়, সমুদ্র, বাঘখালী নদী, পাহাড় বিধৌত সর্পিনী মাতামুহুরীর এরকম বৈচিত্র্যময় আয়োজন কয়টা দেশের কয়টা শহরেই বা আছে?
অন্যদিকে হিন্দু ধর্মীয় তীর্থ আদিনাথ মন্দিরের মহেশখালী, বায়ু-বিদ্যুৎ এর কুতুবদিয়া, বৌদ্ধ ধর্মীয় তীর্থের জন্যের বিখ্যাত রামু, রসালো পান-সুপারি, মাথিনের অমর কূপ, জালিয়ার দ্বীপ, ছেঁড়া দ্বীপ, সেন্ট মার্টিনের জন্য বিখ্যাত টেকনাফ, দ্বিতীয় সুন্দরবন খ্যাত পীর সাধক শাহ ওমর (রহঃ) পুণ্য ভূমি চকরিয়াকে কয়জন চেনেন কিংবা কয়জন পর্যটক ভ্রমণে যান? প্রাথমিক কোন পর্যটন সুবিধাও নেই এইসব উপজেলা শহরে। অথচ এক একটি উপজেলাতে কত কত ইতিহাস ও হাজার বছরের ঐতিহ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, নান্দনিক রুচিবোধ গঠন, প্রগতিশীলতার চর্চা ও আন্দোলন, সাহিত্য ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল সমুদ্র-পাহাড়-নদীবেষ্টিত ও হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টানের অপূর্ব মেলবন্ধনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী কক্সবাজার জেলার। কিন্তু কতজন নেতৃস্থানীয় কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবীর জন্ম দিয়েছে এ জেলা? দরিয়া নগরের কবিখ্যাত নুরুল হুদা ও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক ও লেখক শহীদ সাবের ছাড়া আর কেউ আছেন কি? থাকবেনই বা কী করে? জেলা সদরে কোন গণগ্রন্থাগার নেই, সমুদ্র সৈকতের কবি নুরুল হুদা কবিতা চত্বর পড়ে আছে অবহেলায়, মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিতর্ক চর্চা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোন উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম নেই। শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতি চর্চার শক্ত অবকাঠামোগত ভিত্তিও নেই। কয়টা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের হয় এই জেলা থেকে?
উপজেলা সদরগুলোর অবস্থা তো আরো খারাপ। মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয় না যেখানে, যুক্তির নখরে শান দেওয়ার সুযোগ নেই যেখানে, ভিন্ন মত ও পথকে সম্মান জানানো ও সহনশীল আচরণ চর্চা করা হয় না যেখানে সেখানে জেঁকে বসে মৌলবাদীরা, মধ্যযুগীয় বিকলাঙ্গ চিন্তক কিছু লোক। প্রগতিশীলতা সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে, প্রতিক্রিয়াশীলদের ধ্বজা উড়ে পতপত করে। ভিন্নমতকে সেখানে বাঁকা চোখে দেখা হয়, ভিন্ন পথের পথিকের কল্লা যায়, ঐক্যের বদলে অনৈক্যের সুর বাজে, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যকে অস্বীকার করে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন চলে, সুন্দরের টুঁটি চেপে ধরা হয়। কয়েক বছর আগে ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির শহর রামুতে ঘটে যাওয়া নারকীয় সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবলীলাতেই তা প্রমাণ হয়।
অথচ এই শহরে এই জেলায় জন্মানোর কথা ছিল একজন জীবনানন্দের, যিনি সমুদ্র, পাহাড় ও নদীর অপূর্ব সম্মিলনী দেখে অবাক ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে লিখে যেতেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা রূপসী বাংলার কবিতা। জন্মানোর কথা ছিল একজন রবীন্দ্রনাথের, যিনি সমুদ্রের ধারে নেটং পাহাড়ের চূড়ায় বসে রচনা করতেন নতুন দিনের প্রাণহরা রবীন্দ্র-সংগীত। একজন প্রতিবাদী, রোমান্টিক কবি নজরুল জন্মানোর কথা ছিল এই শহরে, যিনি রামুর বৌদ্ধ ধর্মীয় হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে রচনা করতেন নতুন দিনের হাজার বছরের বৌদ্ধ ধর্মীয় গান ও দোহা। এই শহরে একজন মাইকেল জন্মাতে পারতেন, যিনি মাতামুহুরিকে নিয়ে লিখতেন শত শত সনেট। না, এইসব মহৎপ্রাণ মানুষেরা এখানে জন্মান নি, জন্মান না, হয়তো জন্মাবেনও না।
পর্যটন অর্থনীতি, অসাম্প্রদায়িকতার অনন্য উদাহরণ, নান্দনিকতা চর্চার অগ্রদূত, প্রতিবাদ ও প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের আঁতুড়ঘর, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রসহ নানা সৃজনশীল কাজের নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দিন দিন হেলায় সুযোগ হারানো ও মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্বরতার দিকে দ্রুত ধাবমান কক্সবাজারের জন্য একরাশ সমবেদনা ও হতাশা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]