November 22, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

আমার জীবনে যৌন নিপীড়নের ভয়ানক স্মৃতি ও কিছু কথা

রাকিব খান ।। আমার বয়স ২৩। আমি একজন ছেলে। ঢাকার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে পড়ছি। আমি প্রথমবার যখন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম তখন আমি ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি।

প্রথমবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম এক চাচাতো ভাইয়ের দ্বারা। উনি আমাকে দোকানের বিভিন্ন খাবার, খেলনা জাতীয় জিনিসের প্রলোভন বা এমনিতেই বিভিন্ন কাজের কথা বলে তার রুমে ডেকে নিয়ে যেতেন এবং আমাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতেন৷ আমার মনে আছে উনি ডিভিডি প্লেয়ারে পর্ন ভিডিও চালু করতেন এবং তিনিও আমার সাথে সেরকম করতেন এবং আমাকেও ওরকম করতে বলতেন। এরকমটা উনি সাত/আটবার করেছেন আমার সাথে। আমার দুইবছরের বড় আরেক চাচাতো ভাইয়ের সাথেও উনি এমনটা করেছিলেন এবং সেটা আমাকে বলতেন। বলতেন যে, “ও তো আমাকে এরকম করতে দেয়, তুইও দে”।

দ্বিতীয় যে ব্যক্তি দ্বারা আমি নিপীড়নের শিকার হয়েছিলাম তিনিও আমার চাচাতো ভাই হয়। তিনিও আমার সাথে দুইবার এমন আচরণ করে। আর তৃতীয় যে ব্যক্তির দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়েছিলাম, তিনি সম্পর্কে হয় আমার চাচা। তার দ্বারাও আমি দুইবার এমন অবস্থার শিকার হয়েছিলাম। এই তিনজন ব্যক্তি দ্বারা তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই আমি দশবারের উপরে যৌন নির্যাতনের শিকার হই।

আমার তখন মনে হত, তারা আমার সাথে যে আচরণটি করছে সেটি অত্যন্ত খারাপ কাজ। এসব হয়তো গোপনে এভাবে সবাই করে তাই আমার সাথেও করছে, এরকম মনে হত। আমি ভয় ও লজ্জায় তখন এই ব্যাপারগুলো বাসায় কারো কাছে বলতে পারি নাই। মনে হত যে, বাড়িতে এসব কথা বললে বিশ্বাস করবে না এবং আমাকে উল্টো আরো দোষ দেওয়া হবে এইসব পচা কথা বলার জন্য। আমার এরকমই মনে হত তখন। আর যারা আমার সাথে এসব করত, তাদেরকে না করার বা বাঁধা দেওয়ার কোন উপায় আমার ছিল না। তারা আমাকে ভয়ভীতি দেখাত। আমি অন্য কাউকে বলে দিলে নাকি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না বরং আমাকে আরো মারবে এইসব ভীতি প্রদর্শন করা হত।

আমি আমার ঘটনাগুলো কারো কাছে বলতে পারতাম না। কিন্তু নিজের ভেতর রাখতেও পারছিলাম না। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তি হত। তাই আমি এই ঘটনাগুলো আমার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একজন মেয়ে বন্ধুর কাছে কিছুদিন আগে বলি। বলার পর সে আমাকে জানায়, সে নিজেও ছোটবেলায় তার আপন ফুপাতো ভাইয়ের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলো। তাকে তার সেই নিপীড়নকারী ভাই আমার বন্ধুর ছোট ভাইকে ছাদ থেকে ফেলে দেবার ভয় দেখাত। এসব ভয় দেখিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে মাঝে মধ্যেই হাত দিত এবং তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে এক প্রকার জোর করে। বয়সে ছোট হওয়ায় গায়ের শক্তির জোরে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগই তার ছিল না। আর বাসার কাউকে বলতেও পারত না লজ্জা এবং ভয়ে। এখনো তার মাঝেমধ্যে সেই ঘটনা মনে হলে নিজে খুব মর্মাহত হয়।

ছোটবেলায় পরিবারের সদস্য বা অন্য কারো দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় নি এমন মেয়ের সংখ্যা হয়তো খুব কম বা হাতে গোণা। কিন্তু শুধু মেয়ে না, অনেক ছেলে শিশুও এর শিকার। মাদরাসায় ছেলে শিশু নির্যাতনের খবরও নতুন নয়। এসব তো শুধু প্রকাশিত সংবাদ। অনেকের খবর আমরা জানি না। অনেকে স্বীকার করে না। লোকচক্ষুর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় অনেক ঘটনা।

শিশুরা শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় নিপীড়নকারী তাদের কাছে ঘেসে থাকার সাহস পায়। আসলে তারা সাহস পায় কারণ পুরুষতন্ত্র তাকে বুঝিয়েছে তার ক্ষমতা বেশি নারী বা শিশুর তুলনায়। আবার একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর চাইতে শিশুর বাধা দেবার ক্ষমতা কম এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে নিবারণ করা যায় বলে শিশুদের প্রতি এমন সহিংসতা বেশি হয়।

পরিবার শুনলে খারাপ ভাববে, ভয় বা কীভাবে বলতে হবে ইত্যাদি কারণে অনেক শিশুই এগুলো পরিবারের কাছে বলতে চায় না। আমি নিজেও বলতে পারি নি। অনেকক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নকারী পরিবারের সদস্য হওয়ায় পরিবার জানলেও সামাজিক মর্যাদার ভয়ে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন না। এতে করে শিশুদের মনে আরো নিরাপত্তাহীনতার বোধ ঢুকে যায়। এখন দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ছেলেমেয়েরা বাসাতেই থাকে। এইসব নিপীড়নকারী আরো বেশি সুযোগ নিতে পারে এখন। তাই সচেতন থাকাটা জরুরি।

বাচ্চাদের সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা জরুরি। শিশুরা যাতে যে কোনো কথা প্রথমেই মা-বাবার কাছে নির্ভয়ে বলতে পারে এরকম খোলামেলা একটা সম্পর্ক থাকা উচিত। ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে সন্তানকে ছোট থেকেই বুঝাতে হবে। কীভাবে স্পর্শ করলে আদর করা হচ্ছে আর কীভাবে স্পর্শ করলে যৌন নিপীড়ন হয় তা সন্তানকে শেখাতে হবে। কেউ বাজেভাবে স্পর্শ করলে অথবা কোনো স্পর্শে অস্বস্তি হলে যাতে সাথে সাথে মা-বাবাকে জানায় এরকম কথা শিশুদের জানাতে হবে। নির্যাতনের একমাত্র দায় নিপীড়কের। শিশুদের কোনো দোষ নেই। তাই শিশুদের প্রতি অযথা বকাঝকা, রাগ দেখানো আরও হিতে বিপরীত হতে পারে।

আর নিপীড়নকারী যেই-ই হোক না কেন তার কথা প্রকাশ্যে আনা উচিত। কেননা প্রকাশ্যে না আনলে সেই নিপীড়নকারী আরো অনেকের উপরই নিপীড়ন করবে৷ শিশুদের স্বাভাবিক সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। অনেকে দীর্ঘদিন ছোটবেলার এইসব স্মৃতি বয়ে বেড়ান। ভয়াবহ দুর্বিষহ এইসব স্মৃতি মানুষের মনকে আরো দূর্বল করে তোলে৷ কেউ যদি আপনার কাছে তার এসব নির্যাতনের কথা শেয়ার করেন তাহলে তার কথা মন দিয়ে শুনুন। তাকে সাহস দিন যাতে তিনি ভেঙ্গে না পড়েন। অযথা তাকে ব্যঙ্গ বা হাসাহাসি করবেন না এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির দোষ কখনোই দেবেন না। এতে করে নিপীড়নের শিকার ব্যক্তির মনোবল আরো ভেঙ্গে পড়বে।