September 20, 2024
কলামফিচার ৩

আফগানিস্তানে তালেবান শাসন: পরিণাম কখনোই ভালো হবে না

মেহেরুন নূর রহমান ।। আফগানিস্তান মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মোড়ে অবস্থিত একটি পাহাড়ী স্থলবেষ্টিত দেশ। আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যার সাথে কোন সমুদ্রাঞ্চল সংযুক্ত নয়। এর পূর্ব ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান এবং উত্তর -পূর্বে চীন অবস্থিত। ২৫২,০৭২ বর্গ মাইলের এই দেশটিতে জনসংখ্যা ৩.৮ কোটি। কাবুল রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। জাতিগতভাবে পশতুন, তাজিক, হাজারা এবং উজবেক নিয়ে গঠিত এই দেশ।

আফগানিস্তান এক অনন্যসাধারণ দেশ তার হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে। দেশটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাম্রাজ্যের বাসস্থান ছিল। প্রাচীন ইরানি জনগণ থেকে শুরু করে এখানে রাজত্ব করে গেছে আকেমিনেড সাম্রাজ্য, মেসিডোনিয়ান সাম্রাজ্য, মৌর্য সাম্রাজ্য এবং ইসলামী সাম্রাজ্য।

৬৪২ খ্রষ্টাব্দে আরব মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের আগমন ঘটে এই দেশে। এই দেশটি যুগে যুগে দেখে গেছে অসংখ্য ক্ষমতা দখলের লড়াই, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ১৩শ শতকে এখানে শাসন করে গেছে চেঙ্গিস খান। ১৬ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে উজবেক খানাত, ইরানি সাফউইদ এবং ভারতের মুগলদের মধ্যে। এখানে শাসন  করেছে বাবর, দুররানি, তৈমুর শাহ, নাদের শাহ, শাহ সুজার মত বাদশাহরা।

এই দেশটিতে ৩টি অ্যাংলো-আফগান (ব্রিটিশ আফগান) যুদ্ধ হয়েছে ১৮৩৯ থেকে ১৯১৯ এর মধ্যে। বিশ শতকের শুরুর দিকে (১৯১৯) এ দেশে ক্ষমতায় আসেন আমানউল্লাহ খান এর মত বাদশাহ যিনি রাওয়ালপিন্ডি চুক্তি স্বাক্ষর করার পর আফগানিস্তানকে একটি সার্বভৌম এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর দেশ এবং জাতির আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে বেশ কিছু সংস্কার চালু করেন। এই সংস্কারের পিছনে একটি মূল শক্তি ছিল মাহমুদ তারজী, যিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী। মাহমুদ তারজী আফগান সাংবাদিকতার জনক হিসেবে পরিচিত। তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতূর্ক এর নেতৃত্বের অনুগামী হয়ে তিনি দেশের আধুনিকীকরণ ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি নারী শিক্ষার প্রবল সমর্থক ছিলেন। বাদশাহ আমানউল্লাহ খান এর আমলে মাহমুদ তারজী’র মত ব্যক্তিত্বদের প্রভাবে আফগানিস্তানে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯২৩ সালে আমানউল্লাহ খান দাসপ্রথা বন্ধ করেন। আমানউল্লাহ খানের স্ত্রী রানী সোরায়া তারজী সেই সময়কালে নারী শিক্ষার জন্য এবং তাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। সে সময় নারীদের ঐতিহ্যবাহী বোরকা বিলুপ্ত করা হয়।

এরকম ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি দেশে তালেবানদের মত গোঁড়া ধর্মীয় বিশ্বাসীদের দলের উত্থান সত্যি বিস্ময়কর।

তালেবানের জন্ম:

১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে, কমিউনিস্ট পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (PDPA) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ দাউদ খানের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে  ক্ষমতা দখল করে যাকে সাপোর্ট করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশে শুরু হয় গৃহ যুদ্ধ সরকার এবং গেরিলা মুজাহিদিন/মাওবাদীদের মধ্যে ।

PDPA এর অন্তর্দ্বন্দের কারণে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করতে এবং শুরু হয় আফগান সোভিয়েত যুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ বছরের এই যুদ্ধে ২ মিলিয়নের বেশি আফগান মারা যায় এবং ৬ মিলিয়ন দেশ ছাড়া হয়।  সোভিয়েত প্রত্যাহারের পরও ১৯৯২ সালে কমিউনিস্ট শাসনের পতন না হওয়া পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। অরে এই  উত্তাল রাজনৌতিক অস্থিরতার মধ্যে ১৯৯৪ সালে গড়ে উঠে তালেবান বাহিনী।

তালেবান, যারা নিজেদের Islamic Emirate of Afghanistan (IEA) বলে উল্লেখ করে, আফগানিস্তানের একটি দেওবন্দী ইসলামী আন্দোলন এবং সামরিক সংগঠন। তালেবান ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের ইসলামী মাদ্রাসা থেকে ছাত্রদের (তালিব) নিয়ে একটি আন্দোলন গড়ে তোলে এবং মিলিশিয়া হিসাবে আবির্ভূত হয়, যাদের সাথে ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সমর্থন। সে বছর কান্দাহার শহরের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় পাদপীঠে আসে, এবং ১৯৯৬ সালে কাবুল থেকে রাব্বানী সরকারকে বিতাড়িত করার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় জেঁকে বসে।

২০০১ সালের অক্টোবরে আমেরিকা আফগানিস্তানে আক্রমণ করে তালেবানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়, যখন তারা ১১ সেপ্টেম্বর হামলার প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে, যিনি তালেবানদের “অতিথি” ছিলেন এবং আল-কায়েদা পরিচালনা করছিলেন।

তালেবানদের পূনরুত্থান:

এপ্রিল ২০২১ এ ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছিলেন যে জোট পহেলা মে থেকে আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করতে সম্মত হয়েছে। ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পরপরই, তালেবান আফগান সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে, দ্রুত আফগান সরকারী বাহিনী পতনের দিকে এগিয়ে যায়। ১৫ আগস্ট, ২০২১ তারিখে, তালেবানরা আবার আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে, রাজধানী কাবুল দখল করে, প্রেসিডেন্ট গনি আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যান। ১৬ আগস্ট ২০২১, সিনিয়র রাজনীতিকদের নেতৃত্বে একটি অনানুষ্ঠানিক সমন্বয় পরিষদ তালেবানদের কাছে আফগানিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

কেন তালেবানদের এই ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে সবার মধ্যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে বিশেষ করে নারী এবং শিশুদের জন্য? এর কারণ লুকিয়ে আছে তালেবানদের অতীত শাসন কালের মধ্যে। আসুন দেখি তাদের পূর্ববর্তী রাজত্বকালে তারা নারীদের সাথে কেমন আচরণ করেছে।

আফগানিস্তানে ক্ষমতায় থাকাকালীন তালেবানরা নারীর প্রতি তাদের অন্যায় এবং সহিংস আচরণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলো। তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল “এরকম পরিবেশ তৈরি করা যেখানে নারীদের সতীত্ব ও পবিত্রতা তাদের মর্যাদার মুখপাত্র হয়ে ওঠে” ।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যখন দলটি ক্ষমতায় ছিল তখন নারীদের কার্যত গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিলো কারণ তাদের কাজ করার বা শিক্ষার সুযোগ ছিল না। আট বছর বয়স থেকে মেয়ে শিশুদের বোরকা পরতে হতো এবং রাস্তায় বের হওয়া, এমনকি একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য একজন পুরুষ আত্মীয়কে সাথে নিতে হতো। উঁচু হিলের জুতো পরার অনুমতি ছিল না, যদি এটি একজন পুরুষকে উত্তেজিত করে সে জন্য। নারীদের প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে কথা বা হাসা নিষিদ্ধ ছিলো।

নারীরা যেন রাস্তা থেকে দৃশ্যমান না হয় সে জন্য সমস্ত প্রথম তলার আবাসিক জানালাগুলি পর্দা অথবা গাঢ় রং দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। সংবাদপত্র, বই, দোকান বা বাড়িতে নারীদের ছবি তোলা, চিত্রগ্রহণ এবং প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিল। “নারী” শব্দটি অন্তর্ভুক্ত এমন স্থানের নামগুলির পরিবর্তন করা হয়। যেমন ” নারীদের বাগান” এর নামকরণ করা হয়েছে “বসন্ত উদ্যান”। নারীদের তাদের অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ির বারান্দায় উপস্থিত হতে নিষেধ করা হয়েছিল। রেডিও, টেলিভিশন বা যেকোনো ধরনের জনসমাগমে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ ছিল।

নারীদের সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি ছিলনা না এমনকি তাদের মাহরামের (পুরুষ সঙ্গী) সাথেও না। নারীদের মাহরাম ছাড়া ট্যাক্সিতে চড়া নিষেধ করা হয়েছিল। কোনো নারী নিয়ম অমান্য করলে বা বাইরে মাহরাম ছাড়া বের হলে তাদের রাস্তায় বা স্টেডিয়াম বা টাউনহলে বেত্রাঘাত করা হতো।

আফগান নারীদের পুরুষদের সাথে একই জায়গায় কাজ/জব নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু মেয়ে নয় সব শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা কাবুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কারণ  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই ছিলেন নারী। নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মসংস্থান নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, তবুও এই কঠিন পরিস্থিতে এবং বাধা নিষেধের কারণে অনেকেই চাকুরী থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়।

বর্তমান তালেবান নেতারা বলছে তারা নারীর অধিকার দেবে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক। পশ্চিমা বিশ্বের ন্যায় নারীকে প্রচার বা বিনোদনের বস্তু নয়, বরং নারীকে তাঁর মূল্য অনুযায়ীই অধিকার দেয়া হবে। নারী তার শিক্ষা, কাজ ও মালিকানার অধিকার পরিপূর্ণভাবে পাবে। শরিয়া আইন এবং এবং নারী অধিকার এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যই এসব নেতাদের নারী অধিকার সম্পর্কিত সকল প্রতিশ্রুতির অসারতা প্রমাণ করে। এ সম্পর্কে ডিটেইলসে না গিয়ে যদি তাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক শিক্ষা, কাজ ও মালিকানার অধিকার এর কথা বলি, তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? খোদ আফগানরা কি তা বিশ্বাস করছে? মন হয় না।

বর্তমানে ওয়াশিংটনে থাকা আফগানিস্তানের সাবেক নারী বিষয়ক মন্ত্রী হোসনা জলিল স্কাই নিউজকে বলেছেন, “তারা নারীদের মৌলিক অধিকার দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত বার্তা দেয় কিন্তু আদতে তাদের কাজ হয় ভিন্ন”। তিনি মনে করেন তালেবানরা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য এসব বলছে এবং আন্তর্জাতিক বাহিনী আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে গেলে নারীর জন্য সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে তালেবানরা সাংবাদিক এবং এনজিও কর্মীদের কাজ সীমাবদ্ধ করবে এবং  সংখ্যালঘুদের উপর তাদের পূর্ববর্তী অত্যাচার বজায় রাখবে।

অতীতে তারা নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বাধা দিয়েছে, অফিসে যেতে বাধা দিয়েছে। সেই ভয়াবহতার ধারাবাহিকতায় বহু আফগান নারী এখন আত্মগোপনে আছেন, বিশেষ করে যারা মানবাধিকার এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। তালেবানরা এই সব নারীদের টার্গেট করছে, ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের খুঁজছে। অনেকে নথিপত্র নষ্ট করে দেখিয়েছে যে তারা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজ করেনি, সেইসাথে নষ্ট করছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটও। এমনকি তারা তাদের ডিজিটাল পায়ের ছাপ ধ্বংস করে আত্মগোপনে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের অনেকেই দেখলাম উল্লসিত তালেবানদের আফগানিস্তানে আবার ফিরে আসা নিয়ে। অনেকেই বলছে এটি আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের ইচ্ছার জয়। পুরুষদের কথা বাদ দিলাম, যে সব নারী আনন্দ উচ্ছাস প্রকাশ করছেন তাদের প্রত্যেকের প্রোফাইলে গিয়ে তো দেখা সম্ভব নয় তবে দুটো মেয়ের প্রোফাইলে গিয়েছিলাম যাদের ফেক আইডি নয়। দুটি মেয়েকে দেখলাম বেশ সাজগোজ করা এবং হিজাববিহীন পোশাক পরা। আবেগাপ্লুত হয়ে এত যে স্ট্যাটাস দিচ্ছে তারা কি একবারও ভাবার চেষ্টা করছে তাদের এখনকার জীবনযাপন তারা আফগানিস্তানের মতো দেশে থেকে করতে পারবে কিনা? কপালে টিপ, চুল খোলা এইসব দেখলে তো তালেবানরা পিটিয়ে গায়ের চামড়া তুলে নেবে!

বলা হচ্ছে আফগানিস্তানের মানুষের ইচ্ছার জয়। তা ভাই কোন মানুষের জয়? সেখানে নারীদের অবস্থান কোথায়? কেউ কি তাদের জিজ্ঞেস করছে তারা কী চায়? অবশ্য তালেবান এবং তালেনাবাদের সমর্থনদানকারী পুরুষদের কাছে নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্যই বা কতটুকু। তারা নিজেদের নারীদের প্রভু মনে করে এবং মনে করে নারীদের জন্য সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তারা রাখে।

ভাবুন একবার আফগান নারীদের জায়গায় নিজেদের। তাদের হিজাবের ধরণ দেখেছেন তো? আপাদমস্তক কাপড়ে মোড়া নিজের স্বাধীন সত্তাহীন পুরুষদের শয্যাসঙ্গী এবং সন্তান উৎপাদনের মেশিন ছাড়া আর কী হবে সে জীবন?

ভাবুন প্রচন্ড গরমে চুল খুলে বারান্দা কিংবা ছাদে দিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। গান শিখতে চাইছেন কিন্তু শেখার কিংবা গাইবার অধিকার নাই। কোথাও বসে বন্ধুদের (ধরে নিন মেয়ে বন্ধুই সব) সাথে বসে গল্প করতে চাচ্ছেন হতে পারে কোনো পার্ক বা রেস্তোরায়, পারবেন না। উচ্চশিক্ষা নিতে পারবেন না বা নিতে দিলেও সেখানে থাকবে হাজার বাধা। আপনি সম্ভাবনাময় ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে। মেধা কোন পুরুষের চেয়ে কম নয় তারপরও আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী কোন কাজ করতে পারবে না কারণ আপনাকে হয়তো পরুষদের  সাথে কাজ করতে হতে পারে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে কোন বয়েসে আপনার বাবা বা ভাইয়ের পছন্দ করা পাত্রকেই আপনার বিয়ে করতে হবে।  মুখ আড়াল করে রাখতে হবে, জোরে হাসা যাবেনা, কথা বলা যাবে না, এক বাইরে যাওয়া যাবে না। কি দুর্বিষহ জীবন!

নিউজে দেখলাম তালেবান দখল করার পর দলে দলে মানুষ এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে যাচ্ছে দেশ ছাড়ার জন্য। এর মধ্যে অসংখ্য নারী আছে যাদের আপাদমস্তক কাপড়ে ঢাকা। অসংখ্য পুরুষ জোব্বা পরা, লম্বা দাড়িওয়ালা। যদি তালেবান শাসন জনগণের মনের ইচ্ছে হয় তবে কেন এইসব মানুষগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দেশ ছাড়তে চাইছে? লেবাসে তো তাদের  প্রচন্ড ধার্মিক বলেই মনে হচ্ছে। তারপরও তারা পালাচ্ছে কারণ তারা জানে তালেবান শাসনের আসল রূপ।

আমি শুধু নারীদের কথা ভাবছি না, পুরুষদের কথাও ভাবছি। ভাবুন তো একবার আপনি আপনার কন্যাকে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছেন না। আপনি গান গাইতে বা শুনতে ভালোবাসেন কিন্তু এস কিছুই করতে পারছেন না। আপনি একজন আর্টিস্ট, ছবি আঁকেন বা স্কাল্পচার তৈরি করেন কিন্তু কিছু করতে পারবেন না। নাটক সিনেমা থিয়েটার এসবের কথা নাহয় বাদই দিলাম। এরকম জীবন ব্যবস্থায় মানুষের সুকুমার কোমল প্রবৃত্তিগুলো নষ্ট হতে বাধ্য। এরকম পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষ হয়ে পরে নিষ্ঠুর তাই দুর্বলের উপর অত্যাচার করতে তাদের বাধে না। এরকম পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন পুরুষের যৌনতা ছাড়া আর কোন বিনোদন নাই তাই বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বৈবাহিক ধর্ষণ জীবনযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে বেড়ে ওঠে।

ব্যক্তিগত জীবনে আপনি ধর্ম পালন করতে চান করুন না কিন্তু কঠিন ধর্মীয় বিধিনিষেধ যদি আমাদের সমাজ এবং  রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তবে তার পরিণাম কখনোই ভালো হয়না যার প্রমাণ আমাদের চারপাশেই আছে। আর এসব ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে অন্যায়ের, জুলুমের শিকার হয় মূলত নারী, শিশু এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। আফগানিস্তন এর জন্য মন থেকে প্রার্থনা কারণ এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা নাই। মানুষ আরো মানবিক হোক, ধর্মকে ব্যক্তিগত রেখে, এর বাইরে গিয়ে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসতে শিখুক এই কামনা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]