বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ: সত্য-মিথ্যা বনাম প্রতারণার বেদনা
তির্থক আহসান রুবেল।। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে গত বছর সেপ্টেম্বরে শাহাদাত রাসএল এর “আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে” শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ হয়। লেখাটা সম্প্রতি আমার পড়ার সুযোগ ঘটেছে। পড়ে আমার মনে হলো শক্তভাবে দ্বিমত জানানো উচিত। আইনগতভাবে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ কথাটা কীভাবে বা কেন এসেছে তা নিয়ে আলাপ জরুরি।
এই দেশের মোড়ল সমাজের অংশ অসহায় গরীব পরিবারের মেয়েদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে ছুড়ে ফেলে দেয়- এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। ৮০-৯০ দশকের অসংখ্য সিনেমাতেও এমন গল্পের অভাব নেই। আর গ্রামীণফোনের ডিজুস অফারের কথা মনে আছে তো! রাত ১২ থেকে সারারাত আনলিমিটেড আলাপ মাত্র ৫০ পয়সায় না ২ টাকা যেন ছিল। সেই থেকে শুরু, যা চলছে এই ২০২১ সালেও। এখন সবাই সবার সাথে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে প্রেমের ফাঁদে পেলে শারীরিক সম্পর্ক করে ফেলে দিতে পারছে। সম্পর্ক খুব সহজ। মানুষের স্বাভাবিক ভাবনার জায়গাগুলো ভোঁতা হচ্ছে প্রযুক্তির উদার ব্যবহারে।
মানুষের স্বাভাবিক ভাবনা যখন ভোঁতা হচ্ছে, ঠিক তখনই আরো বেশি শানিত হয়ে মাঠে নামছে বিকৃতকাম একটা চক্র। সহজ যোগাযোগের সুযোগে কিংবা মুখোমুখি পরিচয়ে তারা কাউকে দেখে ভাবছে, ‘‘ইসস মাল! যদি একবার…’! তারা নানা রকম নাটক সাজিয়ে প্রেমের গল্প ফাঁদছে। সম্পর্কের একটা জায়গায় শারীরিকভাবে সংযোগও হচ্ছে। তারপর যখন আগ্রহ শেষ, তখন বলছে ‘যা ভাগ’ কিংবা সামনে নানান কারণ দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তখন মেয়েটার আশ্রয়ের জায়গা কোথায়! সবাই বলবে যে, তোমাদের সম্পর্ক ছিল, তুমি স্বেচ্ছায় তার সাথে মিলিত হয়েছো। আজ তাহলে এই অভিযোগ কেন! তোমার অভিযোগ করাটাই অপরাধ। ঠিক এই জায়গাটাতে দাঁড়িয়েই ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ অভিযোগটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা একটা মেয়ের সাথে প্রতারণা শুধু না, তার ব্যাক্তিত্ব এবং বিশ্বাসের জায়গাটিকে অসম্মান করা। কেউ একজন সেই মেয়েটিকে পরবর্তীতে সত্যিকারের ভালবাসতে পারে। কিন্তু মেয়েটি কি বিশ্বাস করবে? মনের অনলে পুড়বে সেই নব্য প্রেমিক।
শারীরিক সম্পর্কের আগে খোলামেলা যদি বলে নেয়া হতো যে, আমি তোমার সাথে বিয়ের সম্পর্কে যেতে পারবো না বা চাই না। তারপর দুজন মানুষ পারস্পরিক আগ্রহে শারীরিক সম্পর্কে গেলে, তা নিয়ে কোনোভাবেই কোনো অভিযোগ গ্রহণ করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু তা না বলে বরং তুমি আমি আমি তুমি বলে মায়ার ফাঁদ পেতে খেলা শেষে রিটায়ার্ডমেন্টের ঘোষণা গর্হিত অপরাধ। আর এই ব্যপারটাকেই সঠিক বিচারে আনতে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ অভিযোগটা সঠিক। ‘এটা প্রতারণা’ কথাটা সত্য। কিন্তু সেটা প্রতারণা মামলায় পড়ে গেলে তা সঠিক বিচারে পড়তো না। মানুষের শারীরিক ক্ষতির যতটা বিচার ব্যবস্থায় আছে, মানসিক ক্ষতির তেমন কোন কিছুই নেই। মনের ক্ষতটা কেউই বোঝে না। যার ক্ষত সে আরো বেশি ধ্বংস হয়ে যায় সেই ক্ষত বাড়তে বাড়তে। কারণ কেউ তাকে বোঝে না। আমরা দাবি করতে পারি, যারা কাউকে ভোগান্তির শিকার করতে মিথ্যে অভিযোগে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ মামলাটি করবে, তারাও জামিন অযোগ্য বিচারের মুখে পড়ুক।
দুজন মানুষ পারস্পরিক আগ্রহে শারীরিকভাবে একত্রিত হতেই পারে। সেটা সিঙ্গেল অবস্থাতেও আসতে পারে, আবার কারো সাথে প্রেম চলাকালীন বা বিবাহিত অবস্থাতেও পারে। সেই বিশেষ মূহুর্তটা নানান কারণে আসতে পারে জীবনে। প্রেম-বিয়ে মানে কেউ কারো অধীনস্থ নয়। সেখানে একটা বায়বীয় কমিটমেন্ট হয়ত আছে। কিন্তু বিয়ে মানেই নারী-পুরুষ কেউ কারো হাতের পুতুল নয়। তবে হ্যাঁ, প্রেমের একটা লক্ষ্য থাকে। প্রেমের লক্ষ্য একসাথে বেড়ে ওঠা, এগিয়ে যাওয়া, সংসার, বাচ্চা, বৃদ্ধ হওয়া। যদি প্রেম-ই না থাকে, তাহলে প্রেমের অভিনয় করে খেলা শেষে আরেকজনের স্বপ্নকে নিকৃষ্টতম স্থানে ছুড়ে ফেলাটা অনেক বড় অপরাধ। শুধুমাত্র শারীরিক কারণে প্রেমের মুখোশ ধরে, ‘খেল খতম পয়সা উসুল’ জায়গাটা বর্বর। যদিও আজ পর্যন্ত কোন পুরুষ ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ অভিযোগ করেছে বলে আমার জানা নাই। তবে এটাও যে হচ্ছে না, তা না। ডিগ্রি পাশ প্রেমিক ছেড়ে বিলেত ফেরত বা বিসিএস জামাই অনেকে বেছে নিচ্ছে। তবে পুরুষ তো পুরুষ-ই। সত্যিকারের প্রেমে পড়লে যেমন পাগল হয়ে যায়। তার বিপরীতে বিরহে অন্য কেউ হাত বাড়িয়ে দিলে তাতেও মজে যায়।
শাহাদাত রাসএল সত্যিকারের ধর্ষণ হালকা হয়ে যাওয়া নিয়ে, অভিযোগের আবহটা হাল্কা হয়ে যাওয়া বা বিদ্রুপে পড়ে যাওয়ার যে ঘটনাগুলো বলেছেন, তা সত্য। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, সেখানে যারা বিদ্রুপ করে তারা কতটা সভ্য! তারা সব সময়ই নারীর প্রতি ক্রোধে অন্ধ। তাদের সবখানেই দেখা যাবে, নারীর প্রতি চূড়ান্ত অসম্মান দেখাতে। একজন নির্দোষকে মুক্ত করতে যেমন দশজন অপরাধীকে ছেড়ে দেয়াটা নৈতিকতা, তেমনি একজন অপরাধীকে শাস্তির মুখে ফেলতে সবার সচেতনতা জরুরি।
আপনাদের নিশ্চয়ই ‘বলাৎকার’ কথাটার সাথে পরিচয় আছে। বিগত দিনগুলোতে, আমরা এই কথাটা সবচেয়ে বেশি দেখছি ‘মাদ্রাসা/মক্তব/মসজিদে হুজুর কর্তৃক ছেলে শিশু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। ধর্ষণ আইনে ছেলেদের ধর্ষণ বিষয়ে কিছু বলা নাই। তাই গণমাধ্যম সেটাকে ধর্ষণ না লিখে বলাৎকার লিখছে। সেই হুজুরদের কোন আইনে ধরা হচ্ছে, তা আমার জানা নেই। তাদের আদৌ বিচার হবে কিনা সেটাও জানা নেই।
আমাদের উচিত শক্তভাবে দাবি তোলা ধর্ষণ এবং বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ এর পাশাপাশি বলাৎকার শব্দটা পরিবর্তণ করে সংবিধানে ছেলে/পুরুষ বলাৎকারকেও ধর্ষণ হিসেবে উল্লেখ করার আইন জারির দাবি তোলা। সেই সাথে কাউকে ভোগাতে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণিত হলে সেই নারীকেও জামিন অযোগ্য মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা।
যদিও কথা থেকে যায়, নারী যদি কোনো কারণে সত্যিই ঘটে যাওয়া ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ ঘটনার প্রমাণ করতে না পারে তাহলে কী হবে! তাই আমাদের দায়িত্ব শুরুতেই জাজমেন্টাল না হওয়া। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ মুনিয়া ইস্যুতে আমরা চুপ। গণমাধ্যম এটাকে আড়াল করছে। শোনা যায় শত কোটি টাকার খেলা চলছে গণমাধ্যমকে চুপ রাখতে। পীর-নিজামের দরবারে বাঘের কলিজাওলা ওলি-আল্লাহর তবারকে সবাই চুপ। অথচ মুনিয়া মৃত্যুকালে গর্ভবতী ছিল। এখন আপনি চুপ থাকবেন, প্রতিবাদ করবেন, রাস্তায় নামবেন নাকি অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লিখবেন, সেটি আপনার ব্যাপার।
তির্থক আহসান রুবেল : গণমাধ্যম কর্মী এবং নির্মাতা
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]
শাহাদাত রাসএল এর লেখার লিঙ্ক: