November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

বাঙালি পুরুষের ফ্যান্টাসি এবং যা কিছুর ভিতরে আমরা থাকি

শাফিনূর শাফিন ।। তিনটা ঘটনা লিখে রাখতে ইচ্ছে করছে । কোনোটার সাথে কোনোটা সংযুক্ত না; কিন্তু দলীয়, ধর্মীয় এবং সাহিত্যের নামে যেসব হিপোক্রেসি দেখি তার সুবাদে লেখা ।

১. আমি সর্বশেষ যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তা ছিল ১৯-২০ ডিসেম্বর ২০১৯ সাল। ট্রেনে যে বগিতে সিট ছিল, তা মোটামুটি ভর্তি ছিল আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের নিয়ে। কোনো একটা সম্মেলনে যোগ দিতে সবাই যাচ্ছে ঢাকায়। আমার বগিতে ছিলেন নারী কর্মী বেশি। তারা গান গাইছিলেন, বেশ হাসি ঠাট্টা খুনসুটির মধ্যে দিয়ে যাত্রা চলছিল। হঠাৎ শুনি এক নারী কর্মী আরেক পুরুষ কর্মীর সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন। কী ব্যাপার বোঝার চেষ্টা করতেই বুঝলাম কথা কাটাকাটির সূত্রপাত নারী বলে নারী কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তুচ্ছ করে দেখার চেষ্টা সেই ভদ্রমহিলা মেনে নিতে পারেননি। শুনি নারীটি বলছেন, “আওয়ামী লীগের ৩০% কর্মী নারী, মাঠে ময়দানে আন্দোলনে আমাদের ভূমিকা কম না। অথচ দলের ভিতরেই আমাদের যোগ্যতা মাপা হয় না!” আমার তখন মনে হলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই এক জায়গায় বেশ একতা আছে।  সে ডান বাম ধর্মীয় যে দলই হোক না কেন নারীদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদ বা কাজের সুযোগ পুরুষের পাশাপাশি দিতে নারাজ সব দলই। যাও বা হাতে গোনা দুএকজন সুযোগ পান উপরের স্তরে পৌঁছে কাজ করার, সেখানেও তাদের কাজের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ চাপ অনেক বেশি থাকে। আর তা কোট-আনকোট নারী হবার সুবাদেই।

২. আমি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি। সবখানেই ‘স্পষ্টবাদী’- এই তকমা জুটেছে। একই কারণে কেউ কেউ অপছন্দ করেছে, কারো বিরাগভাজন হয়েছি কিংবা কেউ কেউ খুবই পছন্দ করেছে। একবার একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমার এক ছাত্রী নাড়ু বানিয়ে আনলো আমার জন্য। আমি নিজে খেলাম, অন্য কলিগদেরও দিলাম। অন্য এক বিভাগ থেকে এক কলিগ ঢুকলেন তখন রুমে। তাকেও নাড়ু সাধলাম। তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন, “পূজার নাড়ু নাকি? হিন্দু বানাইসে? খাবো না।” তো আমিও বাটি ফিরিয়ে নিতে নিতে বললাম, “দুর্গাপূজার ছুটি তো কাটান। ওই সময় তো হিন্দুদের পূজার কথা খেয়াল থাকে না!” উনি কিছু বলেন নাই। কিন্তু আমি উনার বিরাগভাজন হয়েছিলাম নিঃসন্দেহে।

৩. আমার প্রগতিশীল এক বন্ধু (এখন আর বন্ধুত্ব নেই) পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললেই অন্য ছেলেদের দিকে খুবই ইংগিতপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলতো, “পাহাড়ে যাবো, পাহাড়ি মুরগী খাবো।” তো আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “পাহাড়ি মুরগী অনেক শক্ত হবে না?” সে হাসতে হাসতে বললো, “নরম শক্ত আমরা বুঝবো। তোমরা তো খাইতে পারবা না!” অনেক পরে আমার আরেক ছেলে বন্ধু এই কথার মানে বুঝিয়েছিল, এই মুরগী আদিবাসী মেয়েদের বুঝিয়েছে। সম্প্রতি সাদী শাশ্বত নামের এক ব্যক্তির ভাষ্যমতে তিনি আদিবাসী নারীর প্রতি নিটোল প্রেমের কবিতা লিখেছেন কিন্তু কতিপয় দুষ্টু লোক তার কবিতাকে যৌন লালসা, সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতিতে ফেলার চেষ্টা করছে। আহা! তাই যদি সত্যি হতো!
কবিতাটা নিটোল প্রেমের কবিতা হতো যদি না তাতে একটা দুইটা তিনটা করে পাহাড়ি নানা আদিবাসী নারীর সাথে সঙ্গমের মাধ্যমে কবি তার ক্লান্তি দূর করতে না চাইতেন! মানে একেবারে সুলতান সুলেমান আসছেন আর কি তিনি! উনার কবিতাকে নিছক কবিতা হিসেবে দেখার চেষ্টা করেও পারছি না। কারণ তাহলে আরও অনেক কিছুকে নিছক কথার কথা বলে মানতে হবে। রিপ্রেজেন্টেশানের রাজনীতি বলি, কাশ্মীরের মেয়েদের প্রতি ভারতের নানা অঞ্চলের  বহু পুরুষদের যে আকাঙ্ক্ষা, তাতে যৌন লালসা মিশে থাকে তা উপেক্ষা করার যেমন  উপায় নেই, ঠিক সেরকম একটা সহজ সরল পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করে তার চারপাশের বাকিসব গোত্রের নারীদের কামনা করাও এক ধরণের লালসা ছাড়া আর কিছুই না।
কবিতার নামে, সাহিত্যের নামে, গানের নামে, ওয়াজের নামে যা খুশি তা বলা হয়তো বাক স্বাধীনতা। কিন্তু এই ধরণের বক্তব্য চলমান বহু সাম্প্রদায়িক, মিসোজিনিস্ট, সেক্সিস্ট এবং রেইসিস্ট ভাবনাকে কতটা কীভাবে চালু রাখে তা অবশ্যই ভাবনায় রাখা উচিত। অবশ্য সাহিত্য তো জীবন, সমাজের দর্পণ। বাঙালি পুরুষের পাহাড়, পাহাড়ি মদ, নারী নিয়ে ফ্যান্টাসির বহিঃপ্রকাশই তো ঘটেছে কবিতায়। সেই চিন্তা থেকে এই কবিতা ঠিকই আছে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *