November 2, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

‘‘ফেমিনিজমের অনেক ধরণ আছে, এটাই এর সৌন্দর্য’’- কমলা ভাসিন

কমলা  ভাসিন একজন নারীবাদি। ভারতের নাগরিক। তিনি একজন উন্নয়নকর্মী, কবি, লেখক ও সমাজ বিজ্ঞানী। ২০০২ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে কর্মরত ছিলেন। পরে  চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান সাঙ্গাত চালু করেন। এ প্রতিষ্ঠান নারীবাদি তত্ত্ব ও নারীবাদিদের কাজকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে কাজ করে। বঞ্চিত, আদিবাসী, শ্রমিক শ্রেণীর নারীদের মধ্যে পোস্টার, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ায়। ১৯৭০ সাল থেকে জেন্ডার, শিক্ষা ও মানষের বিকাশ নিয়ে কমলা ভাসিনের কাজের শুরু। ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং এর দক্ষিণ এশিয়ার সমন্বয়কারী তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন দলগত কাজের মাধ্যমে নারীবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। কমলা ভাসিন রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ফেলোশিপ নিয়ে পশ্চিম জার্মানির মুয়েনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফেলোশিপ শেষে বাড হনেফের জার্মান ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজ এর ওরিয়েন্টেশন কেন্দ্রে প্রায় এক বছর শিক্ষাদান করেন। এরপর ভারতে ফিরে সেখানকার শিক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করেন। নারীবাদি অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে কাজের সুবাদে প্রায়ই বাংলাদেশে আসেন কমলা। সম্প্রতি একটি উন্নয়ন সংস্থান আমন্ত্রণে আবারো এসেছিলেন। কাজের ফাঁকে অবসরে তার আড্ডা জমেছিল পুরনো বন্ধু বাংলাদেশি নারীবাদি অ্যাকটিভিস্ট নাহিদ সুলতানার সাথে। সে সময় ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের প্রতিনিধি হয়ে কমলা ভাসিনের একটি সাক্ষাৎকার নেন নাহিদ সুলতানা। কমলা ও নাহিদের সেই অন্তরঙ্গ কথামালা এখানে তুলে ধরা হল। প্রসঙ্গত,  কমলার সাথে কথাবার্তা হয় ইংরেজিতে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সেটি বাংলায় উপস্থাপন করা হল।  

 

নাহিদ সুলতানা: কমলা, তোমার কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন-  আচ্ছা তুমি আমারে বলবা, তুমি কেন ফেমিনিস্ট?

কমলা ভাসিন: আমি ফেমিনিস্ট এই জন্য যে, জন্ম থেকেই আমি নারী পুরুষে বৈষম্য দেখে আসছি। না, সে অর্থে আমার পরিবার কখনও বৈষম্য করেনি। কিন্তু আমার আশেপাশে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশিদের ভেতর আমি এই বৈষম্য দেখেছি। তাই ঠিক এভাবে বলা যাবে না যে আমি নিজে বৈষম্যের শিকার হয়েছি বলেই নারীবাদি হয়েছি। হ্যাঁ, অনেকেই পিতৃতন্ত্রের হাতে নির্যাতিত বঞ্চিত হয়ে নারীবাদি হয়, ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থেকেই হয়। তবে আমার বিষয়টা হল, আমি অন্যদের জীবনে লিঙ্গ বৈষম্য দেখে নারীবাদি হয়ে উঠেছি। সব পরিবারেই বৈষম্য আছে কম বেশি।

জাতিসংঘে যখন কাজ করতাম, তখন জেন্ডার নিয়ে কাজ করেছি। এই কাজের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে নিজেকে নারীবাদি হিসেবে খুঁজে পেয়েছি। আবিস্কার করেছি।  এখনো খুঁজি।

নাহিদ: কমলা, তুমি তো জানো, নারীবাদের নানা ধরণ আছে, না? নানা মত ও পথ আছে, তাইতো? ধারা আছে। তুমি এটিকে কীভাবে দেখ? তুমি কোন ধারায় বিশ্বাসী? আসলে কি তুমি মনে কর এইসব ধারা টারা থাকা দরকার?

কমলা: হ্যাঁ, নারীবাদের অনেক ধরণ আছে, ধারা আছে। আলাদা মত ও পথ আছে। কিন্তু দেখ, সব মত কিংবা পথই শেষ পর্যন্ত একটি কথা বলে, সেটি হল সমতা।  বৈষম্যহীন সমঅধিকার। যদি আমার কথা বল, আমি একজন স্যোশাল ফেমিনিস্ট। আমি র‌্যাডিকেল নই। কিন্তু আমি তাদের বাতিল করিনা। বরং অ্যাকনলেজ করি। আমি বলি- একজন নারীর নারীবাদি না হয়ে তো উপায় নাই। ধর কেউ তার ক্লিভেজ দেখাচ্ছে। সেটাকেই সে প্রতিবাদ হিসেবে মনে করছে। এটা তার চয়েস। ফেমিনিজমের সৌন্দর্য  এখানেই যে এটির অনেক ধরণ আছে। কৌশল আছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে চয়েস বা কৌশলটা যেন পলিটিক্যালি কারেক্ট হয়।

কারণ নারীবাদ তো কোন একজনের না। যেমন ধরো সিমোন দ্য বেভ্যোর। কোন মেয়ে হয়তো তার নামই শোনে নাই। কিন্তু সে ফেমিনিস্ট। সিমোনের নাম শোনেনি বলে তুমি তাকে খারিজ করে দিতে পারো না। কোনটাকেই খারিজ করা যায় না। নারীবাদিরা যে যেভাবেই বলুক, তাদের সবার উদ্দেশ্য তো একটাই- পুরুষতন্ত্রকে আঘাত করা এবং বদলানো। যে যেভাবে তা চর্চা করুক। কেউ ছেঁড়া প্যান্ট পরে করে। আমি দোপাট্টা পরে করি। এটাই তো মজা।

মনে রেখ, নারীবাদ এমন একটা জিনিস যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। কারণ হল, পিতৃতন্ত্রও তার খোলস পাল্টাচ্ছে অবিরাম। তার কৌশল বদলাচ্ছে। এক এক দেশে এক এক রকম পিতৃতন্ত্র। নারীবাদও তাই নিজেকে বদলায়। এটাই নারীবাদের বিউটি। একজন নারীবাদি কখনও একজন নারীর স্বার্থে কাজ করে না। সব নারীর স্বার্থই সে দেখে।

নাহিদ: তোমার এই কথায় মনে হল, হিজাব পরে নারীবাদি হচ্ছে অনেকে। হিজাব পরে নারীবাদ চর্চাকে তুমি কীভাবে দেখ?

কমলা: হুম, সেটাই তো বলছিলাম। নারীবাদ নানা ধরণে আছে। তোমার কোন অধিকার নাই বলার অন্য কেউ কোন পোশাকে নারীবাদ চর্চা করছে। তোমাকেও কারুর বলার অধিকার নাই।

নাহিদ: আচ্ছা, ফেমিনিজম নিয়ে এই যে এত ভুল প্রচার, মিথ্যাচার হয়, নারীবাদিদের সম্পর্কে নানান ভুল কথা বলা হয়। এর কারণ কী বলে তুমি মনে কর?

কমলা: শোন, আমি ৫০ বছর ধরে নারীবাদের কথা বলি। আমাকে ওরা খারাপ বলে। তুমি ২০ বছর ধরে বল। তোমাকে খারাপ বলে। যে মেয়েটা আজ বলা শুরু করল, তাকেও খারাপ বলে। তো এর কারণটা কী? কারণ হল তুমি চেঞ্জটা চাচ্ছো। তুমি যে পরিবর্তন চাও, সেটা পিতৃতন্ত্র চায় না। মোল্লারা কিংবা ধর্মগুরুরা চায়না। এই তো গত বছরই তো ভারতে পূজারিরা মন্দিরে পূজা করলেন নারীবাদিদের পেত্নি বলে ডেকে।  তারা আমাদের নিয়ে কত ভুল কথা প্রচার করে। এই যেমন নারীবাদি মানেই সিগারেট খায়, যত্রতত্র সেক্স করে, ডিভোর্স দেয়, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ চায় ইত্যাদি। এখন এসব বলে কারণ ওরা আমাদের মুখ থেকে সত্যটা গ্রহণ করতে চায় না। তাই আমি সবসময় বলি, এখন পুরুষের জন্যও কাজ করাটা জরুরি। নারী পিছিয়ে ছিল,  এখনও পিছিয়ে আছে, ঠিক।  কিন্তু পুরুষও আসলে পিছিয়ে আছে। মনে রেখ, পুরুষ আসলে ধর্ষণ করে না বা এসিড মারে না। ধর্ষণ করে সিস্টেম। এসিড মারে এই সমাজ ব্যবস্থা। পিতৃতন্ত্র। ধর, ঘরের মধ্যে ভায়োলেন্স করছে কোন পুরুষ। যখন আমরা তাকে মন্দ বলি, তখন অন্য পুরুষের গায়ে লাগে। সে ব্যক্তিগতভাবে নেয় বিষয়টা। ভাবে, আমাকেও বুঝি বলছে! এই বোঝার ভুুল থেকেই নারীবাদিরা ভুল বোঝার শিকার।

নাহিদ: এই ভুল বোঝাবুঝির কোন শেষ হচ্ছে না কেন?

কমলা: কারণ পিতৃতন্ত্র হল বহু পুরোনো, হাজার বছর আগে থেকে গেঁড়ে বসেছে। তোমাকে তোমার কাজটা করে যেতে হবে। থামা যাবে না। তুমিই বল, গত দশ বছরে বাংলাদেশে কী কী পরিবর্তন দেখ? কিছু একটা পরিবর্তন তো আমি স্পষ্ট দেখতে পাই এদেশের মেয়েদের ভেতরে। তুমি ও তোমরা কাজ না করলে কি পরিবর্তন আসত? এখন অনলাইনে নারীবাদ অ্যাক্টিভিজম হচ্ছে। ভুল শুদ্ধ মিলিয়েই হচ্ছে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই তো হবে। ঘরে বসে থাকলে তো হবে না। তোমার কাজ হল এটি চালিয়ে যাওয়া। রাজনীতির ভিতরে ঢুকে চালিয়ে যাওয়া। শেকড়ে ঢুকে চালিয়ে যাওয়া। যত কাজ করবা, তত দ্রুত পরিবর্তন আসবে। আমি কখনও হতাশ হইনা। কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি যে কাজ হচ্ছে। যতটা দেখতে চাই, ততটা হয়তো হচ্ছে না। তবে হবে। মেয়েরা জাগছে।

নাহিদ: দীর্ঘদিন তো কাজ করছ, আমরা আসলে কোথায় পৌঁছেছি?

কমলা: ১৯৯৫ সালে বেইজিং সম্মেলনে বলা হয়েছিল, নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন। আমিও বলি, হ্যাঁ দেখুন। নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন। এটার মানে আসলে কী? মানে হল, এতদিন ধরে আপনারা কেবল একজনের চোখ দিয়ে, মানে পুরুষের চোখে বিশ্ব দেখেছেন। এখন সেই পৃথিবীটাই দুইজনের চোখ দিয়ে দেখুন। এই দেখার শুরু তো হয়েছেই। আরো হবে।

নাহিদ: এখন তো অনেক জায়গায় নারীরা ক্ষমতায় আছে। অনেক বড় বড় পদে। তবু তারাও পিতৃতান্ত্রিক আচরণ করে। এর কারণ কী?

কমলা: দেখো, একজন নারী ক্ষমতায় আছে মানেই এই না যে সে ফেমিনিস্ট। ক্ষমতায় গিয়েও নারী পুরুষতান্ত্রিক আচরণ করতে পারে। আবার একইভাবে যে কোন পুরুষ ফেমিনিস্ট হতে পারে। সবসময় জেন্ডার দিয়ে সব হয়না। শিখতে হয়। চর্চা করতে হয়। সব পুরুষ যেমন রেপ করে না, সব নারীই তেমন দয়ালু হয় না। অথচ আমরা ধরেই নিই নারী মানেই দয়ালু আর সব পুরুষই রেপ করে। বিষয়টা তা না।

নাহিদ: তোমার আজ সময় তো প্রায় শেষ হয়ে এলো, তোমার কাছ থেকে আপাতত শেষ কিছু কথা শুনতে চাই নারীবাদ নিয়ে।

কমলা: ওই যে, যা বলি সবসময়, তাই বলব। পিতৃতন্ত্র একটা বিশ্বাস। বিলিভ সিস্টেম। এটাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। নারী ও পুরুষ দুজনকেই করতে হবে। এখন হয়তো শুধু মেয়েরা করে। কিন্তু ছেলেদেরও করতে হবে। পুরুষ যেদিন পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে শিখবে, সেদিন থেকেই সত্যিকার পরিবর্তন আসা শুরু করবে।

নাহিদ: ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পক্ষ থেকে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কমলা।

কমলা: তোমাকেও ধন্যবাদ। ভালবাসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *