November 1, 2024
বয়ঃসন্ধি-Adolescenceফিচার ৩

সন্তানকে যেভাবে নারীবাদের আদর্শ শেখাবেন

বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছেন  কারিন আশরাফ ।।

নারীবাদ এবং নারীর জন্য সমতা অর্জনের যাত্রায় আমরা বহুদূর এসেছি নিশ্চয়ই, কিন্তু এখনো করার বাকি অনেক কিছু। সামাজিক বাধাগুলোকে মোকাবেলা করার  অন্যতম উপায় হলো প্রজন্মান্তর ধরে চলে আসা প্রথাগুলোকে ভাঙা আর নারীবাদকে নিত্যদিনকার জীবনের স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হিসেবে গড়ে তোলা। আর সেজন্য ছোট বয়স থেকেই ঠিকভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের শিশুদের সাথে কথা বলা দরকার।

আমরা অনেক সময়ই শিশুদের অসাবধানে জেন্ডারভিত্তিক সামাজিক ভূমিকা শেখাই, তা হতে পারে নীল আর গোলাপি রঙের ওপর লিঙ্গ আরোপ করে, খেলনাকে ‘মেয়েদের খেলনা’ বা ‘ছেলেদের খেলনা’ বলে বা কেরিয়ারকে জেন্ডার দিয়ে চিহ্নিত করে – যা তাদের মনকে বাক্সবন্দী করে ফেলে।

সন্তানকে আত্মপরিচয় অন্বেষণের স্বাধীনতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাতকে ঝেড়ে ফেলেই নারীবাদকে আমরা জীবনের স্বাভাবিক একটা বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে পারি।

আমাদের মেয়ে আর বিশেষত ছেলেশিশুদের জানাতে হবে নারীবাদ কী, আর কেন এখনো নারীদের সমঅধিকার পেতে লড়াই করে যেতে হচ্ছে।

আমরা চাই আমাদের মেয়েরা যা অর্জন করতে চায় তা অর্জন করতে স্বাধীন আর সাহসী হয়ে উঠুক। আমরা চাই আমাদের ছেলেরা পুরুষতন্ত্র উৎপাটনের সংগ্রামে আমাদের সহযোদ্ধা হয়ে উঠুক। কিন্তু কীভাবে?

কথা বলুন

যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক রীতিনীতি  এবং সংস্কারের কারণে আপনার সন্তান আপনার বা তার নিজের অজান্তেই লিঙ্গবৈষম্যের মুখোমুখি হতে পারে।

‘পুতুল মেয়েদের জন্য আর গাড়ি ছেলেদের জন্য’ এমন একটা ধারণা আজও টিকে আছে। স্কুলে গার্হস্থ্য অর্থনীতিকে এখনো মেয়েদের বিষয় হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ছেলেদেরও ঘরের কাজ (যেমন – রান্না আর সেলাই) এ দক্ষতা অর্জন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

শারীরিক শিক্ষায় কোনগুলো মেয়েদের খেলা আর কোনগুলো ছেলেদের খেলা তার একটা অলিখিত নিয়ম দেখা যায়। বাস্তবেও পুরুষদের ফুটবলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যার আঁচ স্কুলের পিটি ক্লাসেও লাগে।

আমাদের সন্তানেরা বাইরের জগতে বা অনলাইনে যাই দেখে বা জানে, তা তাদের বিভিন্ন পক্ষপাত আর বিশ্বাস গঠনে অবচেতনভাবে ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের সময় নিয়ে এসব ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ছেলেমেয়ে উভয়েই যে পছন্দমতো যেকোনো কাজ করতে সক্ষম, প্রতিযোগিতামূলক খেলায় যে তারা সবাই অংশ নিতে পারে, আর খেলনার যে কোনো জেন্ডার থাকে না – তা জোর দিয়ে বোঝানো খুব জরুরি।

অন্যদিকে, ছেলেদের নিজের আবেগ-অনুভূতির ব্যাপারে স্বচ্ছ আর অকুণ্ঠচিত্ত হতে উৎসাহ দিতে হবে। মন খারাপ হলে কাঁদা কোন লজ্জার ব্যাপার নয়। তাই ছেলেরা কাঁদলে তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যাবে না।

আপনার সন্তান বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে মিশলেই ধরে নেবেন না সেখানে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। এতে ‘‘ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না’’ এই ধারণাটা আরো শক্ত হয়। অন্যের জীবনটা সত্যিকার অর্থে কেমন, তা উপলব্ধি করার যথার্থ উপায় হল ছেলেমেয়েদের পরস্পরের সাথে সময় কাটানো। সচেতন বাবা মা হিসেবে বাচ্চাদের বন্ধুত্ব করা শেখান। ছেলেকে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে টিজ করাটা হাস্যরসের জন্য ভালো মনে হলেও এর মাধ্যমে আপনি তাকে শেখাচ্ছেন যে, একজন নারীর সাথে কেবল রোমান্টিক সম্পর্কই সম্ভব। তাছাড়াও তার ওপর আপনি একটি যৌন অরিয়েন্টেশন চাপিয়ে দিচ্ছেন তার অমতেই।

আপনার মেয়েদের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করুন যেন তারা তাদের সব উদ্বেগ আপনার কাছে শেয়ার করতে পারে। তাদের সাথে থাকুন, সমর্থন জানান। তাদের মিথ্যা আশা দেবেন না যে, নারীবাদের লড়াই শেষ হয়ে এসেছে। বরং প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তারা যেন সমৃদ্ধ মানুষ হয়ে উঠতে পারে, লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনতে কাজ করতে পারে সেজন্য তাদের ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যান।

কথা বলতে পারেন আয় বৈষম্য আর #মিটু আন্দোলন নিয়ে। তবে যত্ন নিয়ে #মিটুর ব্যাপারে কথা বলুন, যাতে আপনার সন্তানের নিষ্পাপ মনে ভয় না ঢুকে যায়। সমাজে নারীরা যে অবহেলিত, তা আপনার মেয়েদের জানান। কিন্তু তাদের মধ্যে ভয় বা দুশ্চিন্তার সঞ্চার যাতে না ঘটে, সেদিকেও খেয়াল রাখুন।

বিস্তারিত বিবরণ ছোটদের বলার দরকার নেই। শুধু তাদের বোঝান যে এই অন্যায় অসমতাকে বদলাতে হবে – আর তার জন্য মেয়েদের পাশাপাশি দরকার ছেলেদের সাহায্যও।

ইন্টারঅ্যাক্টিভ এবং কল্পনাপ্রবণ খেলা খেলুন

ছোটরা খেলার মাধ্যমে সবচেয়ে ভালোভাবে শেখে। প্লেগ্রুপ-নার্সারিগুলোতে রান্নাবাটি, ট্রেন, ডলহাউজ আর লেগো খেলায় শিশুরা নিজেদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে। এসব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আপনার বাসায় নানারকম খেলা খেলতে পারেন, যেখানে একটা কল্পিত ঘটনা চলতে থাকবে আপনার বাচ্চার মনমতো।

খেলায় শিশুদের নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে দিন, এতে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে। আপনার ছেলে যদি পুতুল খেলা খেলতে চায়, তাকে খেলতে দিন। আপনার মেয়ে যদি ডায়নোসরের কালেকশন বানাতে চায়, তাকে নিরুৎসাহিত করবেন না।

তাদের পছন্দমতো বেছে নেবার সুযোগ সীমিত করে ফেললে একে তো শিশুর চিন্তাশক্তির বিকাশ ব্যাহত হবে, সাথে সাথে সে এমন একটা বার্তা পাবে যে, শুধু তাদের জেন্ডারের কারণে অনেক কিছুই পছন্দ করার অনুমতি তাদের নেই।

উদাহরণ তৈরি করুন নিজেই

পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সবারই উচিত সক্রিয়ভাবে নিজেদের কথা, আচরণ আর কাজে নারীবাদের আদর্শের প্রতিফলন ঘটানো৷

সবাইকে পরিবারের দায়িত্ব পালনে সম্পৃক্ত করুন। শিশু যখন দেখবে ঘরের নারী পুরুষ উভয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চাদের দেখভাল করা, স্কুলে আনা নেয়া করা, রাত্রে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি কাজে অংশ নিচ্ছে, সে শিখবে পরিবার হলো একটা পূর্ণাঙ্গ ইউনিট – সেখানে সবাই সমান। পরবর্তীতে বড় হয়ে তার আচরণে এর প্রতিফলন ঘটবে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে।

বই আর টেলিভিশন অনুষ্ঠান

বিখ্যাত-অখ্যাত সফল নারীদের অনুপ্রেরণাদায়ক জীবনের গল্প নিয়ে রচিত বই “গুডনাইট স্টোরিস ফর রেবেল গার্লস” একটা অসাধারণ রিসোর্স হতে পারে নারীবিষয়ক ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য। শিরোনামটা শুনে মেয়েদের জন্য মনে হলেও ছেলেদেরকেও এসব গল্প শোনানো গুরুত্বপূর্ণ।

নারী সবসময় বিপন্ন আর তাকে বীরের মতো উদ্ধার করে পুরুষ – এই ট্রোপের বাইরেও যেসব মিডিয়া আছে তা যেন আপনার সন্তানের কাছে সহজলভ্য হয়, তা নিশ্চিত করুন। এ ধরণের কিছু উদাহরণ হলো ছোটদের জন্য রোল্ড ডালের ‘’মাটিল্ডা’’ – যেখানে মেধাবী এক ছোট্ট মেয়ে ভীষণ বদরাগী হেডটিচারকে ধরাশায়ী করে ফেলে, আর একটু বড় বাচ্চাদের জন্য ফিলিপ পুলম্যানের ‘হিজ ডার্ক ম্যাটেরিয়ালস’ যা মূল চরিত্র লিরাকে এক অদম্য হিরোইন হিসেবে ফুটিয়ে তোলে।

আরেকটা উদাহরণ হিসেবে ক্রিস কলফারের কথা টানা যেতে পারে। তিনি প্রচলিত রূপকথার গল্পগুলোকে দৃঢ়চেতা, স্বাবলম্বী এবং অবিচল নারীদের গল্প হিসেবে নতুন করে লিখেছেন।

চেষ্টা করুন টেলিভিশন শো, সিনেমা, গেমিং সবখানেই আপনার শিশুর কাছে সেকেলে ‘পুরুষ নারীকে বাঁচায়’ প্লটের বাইরে থাকা বৈচিত্র্যময় কন্টেন্ট পৌঁছে দিতে। সিনেমার চরিত্রগুলো পুরুষ না নারী, তা যেন শিশুদের জন্য তেমন কোনো বড় ব্যাপার না হয়। নারীরা পৃথিবী জয় করছে দেখে যেন তারা অবাক না হয়, তাদের কাছে যেন ব্যাপারটা হয় খুব স্বাভাবিক।
কারণ বাস্তবে আমরা নারীরা তা-ই করে আসছি, আর ভবিষ্যতেও করতে থাকব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *