ক্রাইম
শাহাজাদী বেগম ।।
মা বলত, শুভংকরের ফাঁকি!
আমি বলি, অ্যান অর্গানাইজড ক্রাইম কমিটেড বাই দ্য প্যাট্রিয়ার্কি। ইট সিস্টেম্যাটিকেলি কমপেলস উইমেন টু লিভ আ প্যাসিভ লাইফ। ইট কিলস হাফ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’স পটেনশিয়ালস, বিলিয়ন্স অব ড্রিমস অ্যান্ড মিলিয়নস অব গ্রিন লাইভস।
মা বলত, আমার ভাল লাগে ছুটে বেড়াতে। মাঠে ঘাটে, তেপান্তরে। শরতে কাশের বনে হুটপুটি খেতে, পুকুরে ঝাঁপাতে, পাড়াময় টইটই করে ঘুরতে। ঝুম বৃষ্টিতে তালপুকুরে ডুব দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে কী এক অদ্ভুত ভাললাগা। আর ইচ্ছে করে ঐ দূরের রেললাইনটার কাছে যেতে। রাখাল প্রায়ই নড়ুন হাতে ফিরত। বলত যখন ডাউন পড়ে, তখন আনেকগুলো বড় পেরেকের গোলমাথার দিকটা রেললাইনের উপরে কিছু দূরে দূরে সাজিয়ে রাখে। রেলগাড়ি চলে যাবার পর সেসব নড়ুন হয়ে যায়। কী দারুন লাগে ভাবতে। রেললাইনটা ভীষন উঁচু! কী আছে ওপাড়ে? কিছুই এখান থেকে দেখা যায় না। ইচ্ছেগুলো বাড়ে, গোল মাথাওয়ালা পেরেক কুড়িয়ে রাখি। মনে হয় কাউকে পেলে তার হাত ধরে কাশবনের ভেতরে দিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ঠিক পৌছে যাব রেললাইনে। ওপাশটা ভারি দেখতে ইচ্ছে করে।
আমি বলি, একটা ইট পেলে পাঁচিলটা ছুঁতে পারতাম। কী আছে ওপাশে, জানার ভীষন ইচ্ছে। একটা সূর্যমুখী মাঝে মাঝে মাথাচারা দেয় পাঁচিলের উপর থেকে। তবে কি সূর্যমুখীর ক্ষেত! দিগন্তজোড়া কেবল হলুদ আর হলুদ! নাকি সবুজ ধানক্ষেত? মাঝে মাঝে মনে হয় ওপাশে আছে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা ছোট্ট এক নদী। আমি কান পাতি, কুলু কুলু শব্দটা যদি শোনা যায়!
মা’র কিশোরীমনে অনেক প্রশ্ন। আচ্ছা রেলগাড়িটা কোথায় যায়? কোন ইষ্টিশনে শুরু আর কোথায়ই বা তার শেষ? একটা গাড়িই কি যাওয়া আসা করে নাকি দুদিক থেকে দুটো গাড়ি আসে? দুটো গাড়ি হলে কোনো একটা যায়গায় তাদের দেখা হবার কথা। তখন যদি ওদের মাঝে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়? হয়না নিশ্চয়, হলে তো আর গাড়ি চলতো না। আচ্ছা রেলগাড়িতে চড়তে কেমন লাগে? ‘‘বিয়ের পরে বরের সাথে চড়বে, এ নিয়ে আর কোন কথা নয়”, ব্যাস যেমনটি বড়রা বলে।
আমি ভাবি, বন্ধুরা মিলে কতবার ট্র্যাকিংয়ে গেছে! পাহাড় সমুদ্র দেখা হয়নি কিছুই, একসাথে দেখব বলে।
মা বলত, হাত ধরার আগে শরীর ধরেছিল, জানিস। ভয়ে আমি কাঁটা হয়ে ছিলাম! ডেল কার্নেগীর বই দিয়েছিল। অথচ আমি তখন শরত-বিভূতিতে ডুবে আছি। আচ্ছা, নিদেনপক্ষে একটা মেমসাহেব দিতে পারত, বল? পাশের বাসার বৌদির কাছ থেকে ‘বেগম’ চেয়ে পড়তাম। একদিন তার উপরে ‘ওজিফা’ রেখে বলল ওটাতেই নাকি সত্যিকারের মুক্তি! কি ভীষন আরোপিত দিন যাপন!
ওটা শীৎকার নাকি চিৎকার ছিল বুঝতে পারিনি মা, বিশ্বাস কর। ডাকসাইটে উকিলের নগ্ন শরীর, ভুর ভুর করে বলা অশ্লীল শব্দ গোলাপের পাপড়িগুলোকে মাড়িয়ে যাচ্ছিল! উপরে ওঠাটাই কর্তৃত্ব- কী বীভৎস সে দৃশ্য! আমি শুধু অবাক হয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, তবে যে সিনেমাতে দেখায়……
তালপুকুরে অন্ধকার রাতে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকিরা জ্বলে। মনে হত আকাশের তারাগুলো যেন খসে খসে পড়ছে। আমি চুপিচুপি জানালা খুলে তাকিয়ে থাকতাম। কাউকে সাথে পেলে ঐ তারাগুলো একদিন গায়ে মাখবো। সেই অন্ধকার আমি দেখেছিলাম বুড়ি। ঘরের আলো নিভিয়ে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেত। কোঁকানোর শব্দে আমার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিত। অন্ধকারে আমি কিছুই ঠাহর করতে পারতাম না। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যেত। পাছে রক্তের স্বাদ জিভে লাগে, ভয়ে ঠোঁট ভেজাতাম না।
তার সবকিছু আলোতেই চাই। এতটুকু আড়াল নেই, অসহ্য নগ্নতা! বিবমিষায় বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত আমি।
জানিস বুড়ি, আমারও চাকরি হয়েছিল প্রাইমারি স্কুলে। ঠিক তখনই চাবিটা হাতে দিয়ে বলল, ঘরের বউ বাইরে যাবার দরকার নেই, সংসার ধর্মই মেয়েদের বড় ধর্ম। সেই ধর্মের রসায়নে মাতৃত্বের মহিমা আর কর্তব্যের অতল গহ্বরে আমার আমিটা চিরতরে হারিয়ে গেল।
আমি দাঁতের সাথে দাঁত পিষি, হোয়াট আ সাব-অর্ডিনেট লাইফ! দ্য ব্লাডি প্যাট্রিয়ার্কি!