‘‘কক ইন কন্ট্রোল’’: নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর অস্বস্তি
শুভ সরকার ।। বেশ কয়েক বছর আগে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। একটা বইয়ের বিজ্ঞাপন। অ্যাপলের প্রোডাক্টের যেরকম রিভিউ হয়, সেরকম করে তারা তাদের বইয়ের রিভিউ দিচ্ছিলেন। বিশেষ সে বিজ্ঞাপনে যেমন বলা হচ্ছিলো – এ বইয়ের ব্যাটারি ব্যাকআপ ইনফিনিটি। এ বইকে চার্জ দিতে হয় না কখনো। এই বইয়ের ইন্টারফেসে কোনো ল্যাগ নেই, আপনি যেকোনো সময়ে বইটিকে ব্যবহার করতে পারবেন! আমরা কিন্তু সবসময়েই জানি, একটা হার্ডকপির ব্যাটারি থাকে না, চার্জ দিতে হয় না, যেকোনো সময় সেটিকে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু মজার বিষয় এটাই, পুরোদস্তুর মলাটবদ্ধ বইটিকে একটা গ্যাজেটের ফরম্যাটে পরিচয় করিয়ে দেয়ার এই অভিনব কনসেপ্ট! বলাই বাহুল্য, চমকপ্রদ এই বিজ্ঞাপনের ফলশ্রুতিতে সে বছরে বিশেষ এ বইটির বিক্রি বেড়ে গিয়েছিলো কয়েক গুণ।
হুমায়ূন আহমেদ স্যার একটা কথা বলতেন, মানুষকে হাসানো হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুরূহ কাজ। কারণ, হাসানোর এই প্রক্রিয়া এতটাই সূক্ষ্ম, উপাদান একটু কম হলে কেউই হাসবে না। আবার উপাদান বাড়ালে, বিষয়টা অসহ্য বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। নির্মম সমালোচনার ঝাঁপি খুলে বসবে সবাই। ঠিক সে কারণেই হয়তো এদেশের নির্মাতারা ‘স্যাটায়ার’ বা ‘হিউমার’ জনরা’কে বাদ দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন বরাবর। বিতর্কে কে যেতে চায়? কোন্দলে কে থাকতে চায়? সেজন্যে খেয়াল করলে দেখবেন, এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রেম, সাসপেন্স, থ্রিলার, অ্যাকশন, ইমোশন নিয়ে অগুণতি নির্মাণের বিপরীতে স্যাটায়ার, মেটাফোর, ডার্ক কমেডি, হিউমার নিয়ে নির্মাণ নেই বললেই চলে।
তবুও এই বিশেষ জনরা’য় মাঝেমধ্যে যে দুই-একটি কন্টেন্ট আসে, তা বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখি। সেই আগ্রহের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই সম্প্রতি পাওয়ার এনার্জি ড্রিঙ্কের এক বিজ্ঞাপন দেখলাম। দেখে খানিকটা অবাকও হলাম। স্যাটায়ার এবং মেটাফোরের মোড়কে এভাবে যে দারুণ শক্তিশালী এক বার্তা পাবো, তা আশা করিনি। বিজ্ঞাপনের শেষে এসে যারপরনাই চমকেও উঠলাম।
এই বিজ্ঞাপন এক মোরগ ব্যবসায়ী এবং তার ‘সোনা মিয়া’ নামের মোরগের। যে মোরগ এইটুকুন থেকে আচমকা একদিন হয়ে গেছে খাম্বা। বড় হয়ে যাওয়ার কারণে যে এখন আর কোনো কথা শুনতে চায় না। শুধু তড়পায়। সোনা মিয়া, এইটুকুন থেকে খাম্বা, বড় হয়ে তড়পানো কিংবা ‘মোরগ’ এর ইংরেজি শব্দের ভিন্নার্থক মেটাফোর – এ থেকেই সচেতন দর্শকের বুঝে যাওয়ার কথা, বিজ্ঞাপনে আসলে কোন বিষয়টিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ক্রমশই বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, ‘সোনা মিয়া’ নামের মোরগটি হাত ফসকে চলে গিয়েছে মোরগ বিক্রেতার নাগালের বাইরে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কখনো কোনো তরুণীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সে, কিংবা চলে যাচ্ছে আরো কোনো নাশকতার উদ্দেশ্যে। এভাবে চলতে থাকা বিজ্ঞাপনের শেষে এসে যখন পুরুষদের উদ্দেশ্যে দেয়া হলো এক বিশেষ বার্তা – Dear Men, please learn how to keep your cock in control. এই বিদ্রুপাত্মক বাক্যটিই যেন খুব দারুণভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো পুরো বিজ্ঞাপনের আবহকে!
গুরুত্বপূর্ণ এটাই, এই বিজ্ঞাপন অনেকেরই ভালো লাগবে না। কারণ, এখানে যে বার্তাটা দেয়া হয়েছে, তা অনেকের জন্যেই অস্বস্তিকর। অস্বস্তিকর এই অর্থে, এই বিজ্ঞাপন অনেককেই তাদের প্রকৃত চেহারার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। আর নিজের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে অস্বস্তিকর আর কিইবা হতে পারে? তাছাড়া হিউমার, সারকাজম, স্যাটায়ার এগুলোর সাথে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত না হওয়ায়, এই বিজ্ঞাপনের ভুল ব্যাখাও দেবেন অনেকে। এবং বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, যেখানে ধর্ষণের জন্যে এখনো ভুক্তভোগীকেই দায়ী করা হয় অধিকাংশ সময়ে, সেখানে প্যারাডাইম শিফটের এ বিষয়টা অনেকেরই ঠিক সহ্য হবে না। তবে যেটাই হোক, প্রতিকূল স্রোতে দাঁড়িয়ে এরকম এক বার্তা, তাও সমাজের প্রোটাগনিস্টদের প্রশ্নবিদ্ধ করে বানানো, সেটি নিয়ে কথা বলার অবশ্যই জায়গা আছে। এবং যে আন-অর্থোডক্স ফরম্যাটে এই বার্তা দেয়া হয়েছে, সেটি নিয়েও বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
নির্মাতা মাহাথির স্পন্দনের এই বিজ্ঞাপনটি তাই ‘সাহসী স্যাটায়ার’ এর অন্যরকম এক নিদর্শন হয়েই থাকবে। দারুণ এই নির্মাণের জন্যে এই নির্মাতার প্রতি শুভকামনা তো থাকবেই, পাশাপাশি ‘দ্য বিগ কন্টেন্ট লিমিটেড’, যারা এই বিজ্ঞাপনটি বানালেন, তাদের নিয়েও আলাদা করে কথা না বললে অন্যায় হবে। এই প্রোডাকশন হাউজের আগের কাজগুলো দেখলে দেখবেন, তারা সামাজিক বার্তার বিজ্ঞাপনে আগে থেকেই সিদ্ধহস্ত। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ‘নট হার ফল্ট’, ‘ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুলুকসন্ধান নিয়ে বিজ্ঞাপন বানিয়ে খুব অল্পসময়েই যে জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে তারা, তা ক্রমশ তাদের প্রতি আস্থাই দৃঢ় করেছে। সামাজিক সচেতনতা সাপেক্ষে তাদের এরকম কাজ আরো আসবে, এটাই আশা করি।
আশফাক নিপুনের ‘মহানগর’-এ ওসি হারুণ বলেছিলেন – আর সবকিছু সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা গেলেও নিজের রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায় না। খুব কঠিন এ কাজ।
পাওয়ার এনার্জি ড্রিংকস খেলে নিজের রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করার মতন ‘পাওয়ার’ বা মনোবল পাওয়া যাবে কি না, তা জানা নেই কারো। তবে এ বিজ্ঞাপন দেখে খানিকটা হলেও যদি চিন্তা পালটায় কারো, তাহলে সেটাই ইতিবাচক। সেখানেই এই বিজ্ঞাপনের জয়। মোদ্দা কথা এটাই, বিজ্ঞাপন সবাই দেখতে পারে। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপন ভেতরে ধারণ করাটাই আসল চ্যালেঞ্জ। এটা সবাই পারেনা। এখানেই তাই পার্থক্য। দিনশেষে এই বিজ্ঞাপনের আপ্তবাক্য কয়জন করোটিতে প্রবেশ করাবেন, সেখানেই আসল পাওয়ার। আসল শক্তি।
বিজ্ঞাপনটির লিঙ্ক :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4981649161869119&id=380936885273726