ওহ মাই গড! এখনো বিয়ে করোনি? কবে করবা?
সাদিয়া আক্তার ।। “ওহ মাই গড! তোমার বয়স বিশ বছর? এখনো বিয়ে করোনি? কবে করবা আর সময় শেষ হয়ে গেলে? বাচ্চা নিবা কবে? চারটা বাচ্চাও যদি না নিতে পারো তাহলে আর কীসের সংসার করলা? স্বামীর মন মানসিকতারও তো একটা বিষয় আছে তাইনা? বিয়ে করে ফালাও তাড়াতাড়ি। নাহলে যৌবন কমে গেলে আর কেউ চেয়েও দেখবে না। কুড়িতেই তো বুড়ি হয় সেটা জানো তো? তুমিও তো সেই বয়সেই আছো।”
কথাগুলো রিটায়ার্ড একজন শিক্ষিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল অফিসারের। কথাগুলো তিনি গড়গড় করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকেই বলেছেন আর আমি শুনেছি।
এমন অগণিত মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। ভাইয়া, ভাবী আর আমি ঘুরছিলাম নির্ঝর এলাকায়। হঠাৎ তার সাথে দেখা। ভাইয়ার স্যার, খুব সম্মান দেখালো সে। সাথে আমরাও। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, হাজবেন্ড কী করে তোমার? বললাম আমি আনম্যারেইড। শুনেই তার চক্ষু চড়কগাছ। এরপরেই গড়গড় করে উপরের কথাগুলো বলে দিল। ভাইয়াকেও বলে গেল খুব করে। তার কাছে বেশ ভালো ভালো প্রস্তাব আছে সেটাও। যাওয়ার সময় আমি বলেছিলাম, “আমি ২৫ বছর বয়সের পরে বিয়ের কথা ভাববো আর স্বামীর মন মানসিকতা রক্ষা , কয়টা সন্তান নিতে হবে সেটা অবশ্যই আমি ডিসাইড করব। আপনার সাজেশনের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।” ভাবতে পারছিনা এই বিষয়টা যে, আমাকে পরিচয় জিজ্ঞেস না করে স্বামীর পরিচয় জিজ্ঞেস করে আগে – মানুষ কেমন একটা মানসিকতা নিয়ে বেঁচে আছে, চিন্তা করে দেখুন।
ভাইয়া খুব রেগে গিয়েছিল আমার উপর। সেদিন আর কথাও বলেনি আমার সাথে। বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে হাত মিলিয়ে খুব আঁটঘাট বেধে নামলো আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য। মাঝে মাঝে এখন আম্মুর সাথে এসব বিয়ের ব্যাপার নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয়। আগে অবশ্য এমন চিন্তাভাবনা আমার মা বাবা এবং ভাইয়া কারো মধ্যেই ছিল না। হঠাৎ খুব বিয়ের প্রস্তাবের উপদ্রব বেড়ে গেল। দেখা মিললো অনেক মাসয়ালা প্রদানকারীদের। মৌলবাদী ভাই, বোন এবং আন্টি, আংকেলরা এমনভাবে গ্রাস করেছে যে এই একটা বিষয় নিয়ে আমার সাথে আমার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের সম্পর্ক খারাপ পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে।
একটা মেয়ে বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত হলো মানে সে বাচ্চা নিতে পারবে এখন থেকেই। তাই তাকে তাড়াতাড়ি ধরে বেধে বিয়ে দিয়ে দাও। নাহলে সে স্বামীকে সুখ দিতে পারবেনা, বাচ্চা নিতে পারবেনা, সংসার করতে পারবে না। বিশ এর দিকে বয়স গেল মানে তাকে সমাজে নষ্টা বলে গণনা করা হয়। মা মাঝে মাঝেই বলেন, এখনো বিয়ে না করলে পরে মানুষ খারাপ বলবে। তখন আর ভালো কেউ নিতে চাইবে না। যে মা আমাকে একসময় বলতো, আগে পড়ালেখা, নিজের কেরিয়ার তারপর বিয়ে। বিয়ের কথা মাথায় আসলে পিটিয়ে হাড় ভেঙ্গে দেব। সে মাত্র এই কয়েকদিন পরে আমাকে আমার বিয়ের কথা বলে। আমাদের সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গেছে যে আমার তাদের সাথে কথা বলতেও ভয় হয় এখন যে আবার বিয়ের কোনো প্রস্তাবের কথা বলে কিনা! সেই ভেবে তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দেই। তারা ওদিকে ব্যস্ত আমার বিয়ে নিয়ে আর এদিকে আমি ব্যস্ত আমার পড়ালেখা নিয়ে, কীভাবে কেরিয়ারে ফোকাস করব তাই নিয়ে। মানে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আমি আগে আমার পরিচিত অনেককেই দেখতাম এসব নিয়ে অনেক ডিপ্রেসড কিন্তু পাত্তা দিতাম না। হেসেও উড়িয়ে দিতাম । কিন্তু এগুলো এখন নিজেই সহ্য করি।
মেয়েদের বেশি বয়স নিয়ে যাদের খুব টেনশন আপনারা আপনাদের সাজেশনগুলো আপনাদের নিজের কাছেই রাখুন। ওই বাজে বক্তৃতাগুলো কাউকে দেবেন না। আপনাদের মানসিকতা পরিবর্তন করুন নাহয় এগুলো নিজেদের মধ্যেই রাখুন। মেয়েরা কোনো বাচ্চা দেয়ার মেশিন না। স্বামীর মন রক্ষা করা, সুখ দেয়া – এগুলোর জন্য কোনো নারীর জন্ম হয়নি। তাদের নিজেদেরও একটা জীবন আছে। সেটা তারা সুন্দর করে কাটাতে চায়। কাকে বিয়ে করবে, কখন বিয়ে করবে, তার কী করা দরকার, তার জীবনের সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে দিন।
ছেলেরা যখন তাদের বয়স তিরিশ পার হলেও বিয়ে করে না তখন সেটায় কোনো সমস্যা থাকেনা। কিন্তু এই জায়গায় একটা মেয়েকে তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। আচ্ছা ছেলেদের যৌবন কি শেষ হয়না? নাকি তারা চিরযৌবন প্রাপ্ত? সব যৌনতা, সুখ, ইচ্ছা এগুলো কি ছেলেদের জন্যই? বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছেলেদের যৌবন খুব বাড়ে আর মেয়েরা বুড়ি হয় তাইনা?
সমাজ, রাষ্ট্র এবং এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিস খুব পজিটিভলি দেখুন। দেখবেন জীবন খুব সুন্দর, যা বার বার উপভোগ করার পরেও শেষ হবেনা।
এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা যা বর্তমানে পার করছি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]