পরিভাষার রাজনীতি: পিছিয়ে পড়া নয়, পিছিয়ে দেয়া জনগোষ্ঠী
জোবদাতুল জাবেদ ।। নানান বক্তৃতা, সেমিনার, কিংবা কোনো গালভরা কথোপকথনে যখনই আলাপ উঠে সমাজের ঐ মানুষগুলোকে নিয়ে, যারা অন্যায্য পরিকাঠামোর মাঝে কোনঠাসা জীবনযাপন করছে, তাদেরকে আমরা “পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী” বলেই সম্বোধন করে থাকি। ২০১৯ সালের কথা, তখন একটি গবেষনার কাজে সারা বাংলাদেশ হতে এমনই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের মাঝে অন্যতম একটি গোষ্ঠী, আমরা অনেকে যাদের তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া বলে সম্বোধন করে থাকি, তাদের ৮০ জন মানুষকে নিয়ে কিছু ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) আয়োজন করি। সেই ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা একজন লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষ হঠাৎ তার কথা বলার সময় বেশ সরল ভাবে একটি জটিল কথা বলে দিলেন। তিনি বলেছিলেন “সবাই আমাদেরকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলে, কিন্তু আমরা তো আসলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী না! আমাদেরকে সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাহলে আমাদের ‘পিছিয়ে দেয়া জনগোষ্ঠী’ না বলে কি কারনে ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ বলা হয়?”। তার এই লাইনটি শোনার পর দীর্ঘ সময় নিজের মধ্যে এই ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ পরিভাষাটার ‘রাজনীতি’ বোঝার চেষ্টা করেছি। ‘পরিভাষার রাজনীতি’ কথাটা একটু অদ্ভূত লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করতে গিয়ে, সময়ের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে এই পরিভাষার রাজনীতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছি দিনে দিনে। একটি জনকল্যানমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ, রাষ্ট্রের সকল প্রকার নাগরিকের জন্য সমান হবার কথা ছিলো, কিন্তু বাস্তবতা কী সেটা ব্যাখ্যা করা নিঃষ্প্রয়োজন।
‘লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী’, যাদের রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি পরিবারও স্বীকার করে না। এই অস্বীকারের চক্রে একে অন্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। পরিবার বলে সমাজ মানবে না, সমাজ বলে রাষ্ট্রের আইন মানবে না, রাষ্ট্র বলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, আর সেই ধর্মের ঢালটাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পরিবারের মানুষগুলোই! কি অদ্ভূত এক চক্র! এই চক্রের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে রাষ্ট্রের ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ হয়ে যাচ্ছে ‘লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী’। চলুন আমাদের জানা কথাগুলোই আরো একবার সুস্পষ্ট করে বোঝার চেষ্টা করি। কী করে পিছিয়ে পড়েছে এই জনগোষ্ঠী। বলছিলাম গবেষনা ও এফজিডির কথা, সেখানের ৮০ জনের গল্প থেকেই একটি “কমন স্টোরি” বলি। গল্পে প্রবেশের আগে বলে নেই যে ৮০ জন মানুষ তাদের জীবন সংগ্রামের গল্পগুলো বলেছিলেন, তাদের সবারই বর্ণিত গল্পের চিত্রটা প্রায় একই।
তাদের জন্মটা জৈবিক ভাবে ছেলে হিসেবে হলেও বয়স যত বাড়তে থাকলো, আস্তে আস্তে তারা নারীর মতো করে অনুভব করতে থাকলেন। নারীর মতো বলতে সমাজের নির্মিত নারীত্ব নির্ধারণের যে সূচক গুলো আছে, সেই সূচকগুলোতে তারা নারীর মতো মনে করেন নিজেকে। ব্যাট-বল নয়, পুতুল নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, “পুরুষ” এর মতো অগোছালো হাতের লেখা কিংবা ঘর নয় “নারী”-র মতো গোছালো ঘর ও সুন্দর হাতের লেখা। চালচলনে “মেয়েলী(!)” স্বভাব, পুরষত্বের লেশ নেই! তাদের প্রকৃতি প্রদত্ত মনোভাব ও আচরণের কারণে সমাজে তারা লাঞ্চিত হন। তাদের পরিবারের অন্য সহদোর, পিতা, মাতা, আত্মীয়স্বজন সমাজের মানুষদের কাছে তাদের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হন, লজ্জায় পড়েন তাদের নিয়ে। শুরু হয় পরিবার থেকে তাদের সংশোধনের বিশেষ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় বাবা, ভাই, বোন, মা কিংবা নিকট আত্মীয়রাও বাদ জান না, একজন মানুষের প্রকৃতিক সত্ত্বাকে জোর করে সমাজ নির্মিত “পুরুষত্বের” সূচকের মধ্যে আনতে, মানুষগুলোর উপর শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এদিকে, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্তু একদম মুখ বন্ধ করে বসে থাকে না! তাদেরও সামাজিক দায় আছে! তারাও তাদের থেরাপি শুরু করে। সহপাঠী, শিক্ষক সকলে মিলে তাদের পুরুষ বানাতে নানান পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করেন, যার মধ্যে রয়েছে বুলিং, মৌখিক নির্যাতন, অপমান, শারীরিক গঠন-গড়ন-কন্ঠস্বর ইত্যাদি বিষয়ে “বিশেষ বিশেষ মন্তব্য”। এইভাবেই বেড়ে উঠতে থাকেন আমাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর “লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময়” মানুষগুলো।
পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের মধ্যদিয়ে যখন একটি শিশু বেড়ে ওঠে, সেই শিশুর মনোজাগতিক বিকাশ কতটুকু হওয়া সম্ভব তা বর্ণনার অবকাশ রাখে না। এই বীভৎস পরিস্থিতিতে “তারা” বেড়ে উঠতে থাকেন। একটা সময় তারা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন, বা পরিবারই বন্ধ করে দেয় তাদের পড়াশোনা, কারণ তারা পরিবারের জন্য “সামাজিক লজ্জা”। ব্যাস, শেষ হয়ে যায় রাষ্ট্রের একটা মানুষের শিক্ষা গ্রহন করার উপায়! তারপর তারা আরেকটু বড় হয়, যত বড় হতে থাকে, ততই তাদের নিয়ে পরিবারের হতাশা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। কারণ তারা তখনও পুরষত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয় না! এই হতাশার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে পরিবারিক নির্যাতন ও নীপিড়ন। একটা সময় মানুষগুলো বাধ্য হয় পরিবার ছেড়ে “বাজারে টাকা তোলা” সেই মানুষগুলোর কাছে চলে যেতে, যারা তাদের মতো করে বেঁচে থাকা সত্ত্বেও তাদের আমরা হিজড়া/হিজলা ইত্যাদি বলে সম্বোধন করি। যাদের দেখলে সমাজের মানুষগুলো সম্মান না করুক, অন্তত ভয় পায়। ঐ হিজড়াদের কাছে চলে যাবার পর আরো একবারের মতো বন্ধ হয়ে যায় “তাদের” বিকশিত হবার পথ, বিছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হয় তারা তাদের পরিবার থেকে।
শুরু হয় তাদের নতুন জীবন, আমাদের কমন স্টোরির মূল চরিত্রগুলো সেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেই জন্ম হোক না কেন, তাদের ঠিকানা হয় হিজড়া গুরুর ঘুপচি ঘরে। সেই ঘরগুলো হয় সমাজের ভদ্দরলোকদের আবাসস্থল থেকে দূরে কোনো বস্তিতে কিংবা এমন কোনো জায়গায় যেখানে নাগরিক কোনো সুযোগ সুবিধা থাকে না। পানি, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশনের মতো অতি-প্রয়োজনীয় নাগরিকসেবাগুলো যেখানে “চুরি” করে কিন্তু মধ্যসত্ত্বভোগী (পড়ুন লোকাল দালাল) টাকা দিয়ে অপ্রতুলভাবে ভোগ করতে হয়। সেই হিজড়া গুরুর ঘরে বড় হতে শুরু করেন “তারা”। সেখানে শুরু হয় ভয়ংকর এক জীবনযুদ্ধ, একদিকে খাদ্যের অভাব, অন্যদিকে গুরুর নির্ধারিত এলাকায় টাকা তোলা (হিজড়া সংস্কৃতিতে একে ছল্লা বা বাদাই বলে সম্বোধন করা হয়), আবারও সেই সমাজনির্মিত সূচকে পুরুষ হবার যুদ্ধে তারা ব্যার্থ হন, আবার সেই পুরুষরাই রাতের অন্ধকারে তাদের ভোগ করতে শুরু করেন। অসুস্থ্য হলে চিকিৎসা বলতে, হাতুড়ে কোনো ডাক্তার যদি দয়া করে দেখেন, টাকা থাকলেও ভালো ডাক্তারের কাছে তারা যেতে পারেন না। বাদাই তুলতে গেলে মানুষের দুর্ব্যবহার, পুলিশের নির্যাতন, বাদাই তুলে আনার পর টাকা কম পড়লে কিংবা যে কোনো তুচ্ছ ঘটনাতে গুরুর দ্বারা অমানবিক নির্যাতন এইসবের মধ্যদিয়েই “তারা” জীবন পার করে। এই হলো আমাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর একদম কমন স্টোরি।
এখন বলুন তো, এরা কি আসলে পিছিয়ে পড়েছে, নাকি এই রাষ্ট্র আইন দ্বারা, সমাজ তার নিয়ম দ্বারা সুনিপূনভাবে লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোকে পিছিয়ে দিচ্ছে? তাদের নাগরিক হিসেবে যে মৌলিক চাহিদাগুলো আছে সেগুলো রাষ্ট্র নিশ্চিত করছে না, তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা নেই, বস্ত্রের নিশ্চয়তা নেই, বাসস্থানের অধিকারকে তুলে নিয়ে “সমাজ” থেকে বহুদূরে নিক্ষেপ করেছে, বৈরী পরিস্থিতি তৈরি করে শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে, সেখানে চিকিৎসা সেবার কথা বলাই বাহুল্য। যারা এই ৫টি মৌলিক চাহিদাই রাষ্ট্রের থেকে পাচ্ছে না, এই চাহিদাগুলো পূরন করতে পদে পদে সমাজ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যাদের মৌলিক অধিকারকে কোনোভাবে স্বীকারই করা হয় না, স্বীকৃতি তো অনেক দূরের কথা। তারা ঠিক কী করে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হয় একটু কি কেউ বুঝিয়ে বলতে পারবেন? আমি দীর্ঘ সময় ভেবে কোনো সমীকরণ মিলাতে না পেরে এখন গ্রামের সেই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষটির ভাষা প্রতিধ্বনি করে বলি “লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী”, নাকি “সমাজের পিছিয়ে দেয়া জনগোষ্ঠী”। আর যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশে তো এখনো আলাপই করা যায় না। কিন্তু আমি একজনই তো এই সমাজের সকলের কণ্ঠস্বর নই। তাই আমি পিছিয়ে দেয়া জনগোষ্ঠী বললেও বাকিরা তো এখনো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীই বলে! কিন্তু কী কারণে? তারা কি এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে না?
বাস্তবতা উপলব্ধি সমাজের বেশিরভাগ মানুষ করে না, কিংবা করতে চায় না। কারণ যখনই আমি স্বীকার করবো লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী, রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক পিছিয়ে দেয়া জনগোষ্ঠী, তখনই তাদের পিছিয়ে দেয়ার দায়টা আমাদের সবার উপরেই বর্তাবে, আর আমরা কেউ সেই দায় নিতে আগ্রহী নই। ঐ যে, যে গল্পটা বললাম, সেই গল্পের পরিবার, আত্মীয়, সমাজ, সহপাঠী, শিক্ষক, ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ এরা কারা জানেন তো? এরা আসলে আপনি, আমি আর আমরাই। এই মানুষগুলো কোনো ভিনগ্রহ থেকে আসা প্রাণী নয়। আমরাই নির্যাতক, নীপিড়ক আর অধিকার লুণ্ঠকারী হয়ে লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষগুলোর প্রাকৃতিক সত্ত্বাকে অস্বীকার করে তাদের পিছিয়ে দিচ্ছি, যা প্রকারন্তরে রাষ্ট্রকেই পিছিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই দায় আমরা স্বীকার করি না। যখন চোখে আঙুল দিয়ে কেউ এই দায়বদ্ধতা আমাদের দেখিয়ে দেয়, আমরা তখন বলি, আমি তো না বুঝেই করি, না/মানে/কিন্তু/যদি ইত্যাদি শব্দ দিয়ে নিজেদের অন্যায়গুলোকে সাফাই দিতে শুরু করি। আমাদের দায় স্বীকারের একটা ক্ষেত্র যাতে তৈরি না হয় তাই সুন্দরভাবে আমরা আবেগ ও দরদ ভরা কণ্ঠে সেই মানুষগুলোকে “পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী” বলে আখ্যা দেই, পাছে “পিছিয়ে দেয়া জনগোষ্ঠী” বললে, পেছানোর দায়টা স্বীকার করে নিজেকে সংশোধন করতে হয়, সেই মানুষগুলোকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে হয়। আর এখানেই লুকিয়ে আছে এই পরিভাষার রাজনীতি। এই পরিভাষার রাজনীতি কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আরো একটি ভয়ংকর পরিভাষা আছে “তৃতীয় লিঙ্গ”, অন্য একটি লেখায় এই তৃতীয় লিঙ্গের রাজনীতি নিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবো। এছাড়াও কী করে আমাদের রাষ্ট্র তথা সমাজ ব্যবস্থায় এই পরিভাষার রাজনীতিগুলো পুরুষতন্ত্রের দ্বারা সৃষ্টি, বিকশিত ও পালিত হয় তার চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
এই লেখা যদি আপনাকে সামান্যটুকুও প্রভাবিত করে, তবে আসুন প্রতিজ্ঞা করি, আমরা কেবল লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে নয়, কোনো জনগোষ্ঠীকেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলবো না। আমরা আমাদের ব্যর্থতা, অন্যায় ও নাগরিকের দায় স্বীকার করে তাদের “পিছিয়ে দেয়া জনগোষ্ঠী” বলেই সম্বোধন করবো।
জোবদাতুল জাবেদ: মানবাধিকারকর্মী ও কমিউনিটি সংগঠক