September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

আমার হ্যাশট্যাগ মিটু: বিপন্নতা ও যুদ্ধের দিনগুলো  

মুশফিকা লাইজু।। বরাবরই আমি আলোর পেছনে ছুটেছি। জেনাকি পোকা থেকে মাটির প্রদীপ, আর মধ্য আকাশের গনগনে সুর্য- সব আলোই আমার কাছে আরাধ্য।

মহাবিদ্যালয় ছেড়ে যখন পৃথিবীর পাঠশালায় প্রবেশ করলাম, আলো হওয়া ছাড়া তেমন কোন স্বপ্ন আমার ছিল না। আমি জানতাম যে কোন উপায়ে আমাকে আলো হতেই হবে। পথ যাই হোক, আমি সুকুমার কলাকেই বেছে নিয়েছিলাম। কারন সাধারণের কাছে পৌঁছাতে হলে এইটাই সবচেয়ে দ্রুত মাধ্যম। নাটকই আমার সেই হাতিয়ার হবে, সেটাই ছিল আমার ধ্যান।

আমি আমার এই লক্ষ্যকে স্বপ্ন বলবোনা। কারন আমার এই পরিকল্পনা আমি ঘুমিয়ে করিনি, আমি জেগেই করেছিলাম।

আমার লক্ষ্য ছিল স্থির। আমি নাট্যতত্ত্বেই ভর্তি হলাম। পৃথিবীর নারী পুরুষ ভেদ-বৃত্তান্ত এবং শকুন-জানোয়ার কুলের সাথে আমার তখনঅব্দি তেমন জানাশোনা ছিল না। ৩২ বছর আগে, সময়ের পরিক্রমায় যখন শিক্ষকরূপী এক হায়েনার সাথে দেখা হল, মানুষ থেকে নিজেকে নারীতে আবিস্কার করলাম আর চরম অপমানে পৃথিবীর এক নতুন অর্থ আমার সামনে বিভীষিকা হয়ে দেখা দিলো। আমি স্থির হলাম, স্তম্ভিত হলাম, আমি ভেঙে-গুড়িয়ে গেলাম। আমার সামনের মুক্তির সব দরোজা যেনো সহসা বন্ধ দেখতে পেলাম। আমার চেতনার সব আলো ধীরে ধীরে আমার সামনেই নিভে যেতে লাগলো। নিজেকে আলো নয়, প্রাণ নয়, মানুষ নয়, এমন কি কোন নারীও নয়, শুধুমাত্র মাংসাশী একটি পুরুষের খাদ্য মনে হতে লাগলো।

আমি গুড়িয়ে যেতে যেতে আমার সব শক্তি সঞ্চারিত করে প্রতিবাদ করলাম। সর্বশক্তি দিয়ে আমার এই অসম্মানের প্রতিকার চাইলাম। সহপাঠি-বন্ধুদের জানালাম। কিছু শিক্ষককে জানালাম। নিজের গোছানো স্বপ্নের শিক্ষাজীবনকে ছাড়লাম। সব সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে আইনের আশ্রয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নিলাম। মফস্বলে বেড়ে ওঠা মাত্র ১৮ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে, অর্থহীন-আশ্রয়হীন হয়ে আত্মগোপনে গিয়ে ভেসে যেতে যেতে কেমন করে যেন টিকে গেলাম।

পরবর্তী ৩১ বছর এই ঘটনা আমাকে জলন্ত আগুনের মধ্যদিয়ে টেনে নিয়ে গেছে। জীবনের অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যদিয়ে আমি নারী অধিকারকে জীবনের কর্মপন্থা হিসেবে স্থির করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কখনও সেই নিপীড়ন দৃশ্যকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলিনি। সেই বিভৎস দৃশ্য আমি বয়ে বেড়িয়েছি চলার পথে। আমার অসম্মানকে আমি শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছি। ঐ নিপীড়নকারীকে শাস্তি দিতে চেয়েছি। আমার অসম্মানের বিনিময়ে তাকে শতকোটিবার অসম্মান করতে চেয়েছি। কত পরিকল্পনা করেছি, প্রকাশ্য সভায় তাকে সেই দিনের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে বলবো। এমনকি একটা উপন্যাস লিখবো বলেও ভেবেছি। যখনই অবসাদবোধ করতাম, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যেতাম; এমনকি একবার তো ৭২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখলাম।

গত বছর দশেক ধরে পৃথিবীময় হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলন যখন প্রায় ধুমায়িত- শেষ ধাক্কাটা ভারতে এসে আগুনের মত আছড়ে পড়লো। আমি প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করলাম এই সময়ের কাছে আমাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আমি আমার প্রতি হওয়া অসম্মানের কথাটা লিখে ফেললাম এক নিমিষেই। একেবারে জলন্ত দগদগে ঘা’য়ের মত সেই স্মৃতি উঠে এলো আর্ন্তজাতিক একটি আন্দোলনের প্লাটফর্মে। আমি অনেকদিন পরে প্রশান্তিতে ঘুমাতে গেলাম। যদিও মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ততদিনে সেই নিপীড়কের মুক্তি মিলেছে।

অনেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি একবারও আমার রাষ্ট্রীয় সমাজ, বসবাসরত সমাজ কিংবা পরিবারে কথা ভাবিনি!

হ্যাঁ, গত ৩১ বছর ধরে তো ভেবেই চলেছি এবং এই একই ঘটনা আমি নিরন্তর ঘটতেই দেখেছি- প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। অন্যান্য অযুত-নিযুত নারীর সাথে, প্রতিকারহীনভাবে। কখনও শিক্ষক, কখনও ডাক্তার, কখনও শিল্পী, অভিনেতা, উপস্থাপক, নিছক সাদামাটা প্রকাশক বা বই বিক্রেতা; কখনও চাচা, মামা, খালু, এমনকি কখনও নিজের গাড়ির চালক পর্যন্ত  নিপীড়কের ভুমিকায় অবর্তীণ হয় বজ্রপাতের মত। নারীদের প্রতি হওয়া এই যৌন নিপীড়ন যেন নারীদের ভবিতব্য হয়ে উঠেছে।

আমার ক্ষুদ্র শক্তিতে সেদিন যা পারিনি আজ আমার তা কর্তব্য হয়ে দেখা দিলো। আমি ফেলে আসা বর্তমান এবং বর্তমান নিপীড়নের শিকার নারীদের আলো হতে চাইলাম, যোগাতে চাইলাম সাহস। আমার এই প্রতিবাদের মধ্যদিয়ে আজকের নারীদের জানাতে চাইলাম, আমাদের নীরবতা ভাঙা উচিত। আমাদের নির্ভীক হওয়া উচিৎ। এই দেশ ও সমাজকে আগামীর কন্যাদের জন্য বাসযোগ্য করা আমাদেরই দায়িত্ব।

আমি সাড়া পেলাম ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই। প্রচুর প্রগতিশীল মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়ে শক্তি যোগাল, সাহস দিল। যদিও সেই প্রকাশ্য নিপীড়নের প্রতিবাদের কন্যাসাহসীকাদের দলে আমরা ছিলাম ১২-১৩ জনের একটি ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী দল মাত্র। তাদের মধ্যে আমিই বয়োজেষ্ঠ্য।

নেতিবাচক ভূমিকায় অনেকেই অবর্তীন হলেন। নিপীড়কের ফেলে যাওয়া চ্যালা-চামুন্ডরা শুরু করলো পাল্টা লেখালেখি। ঐ নিপীড়ককে পুরুষ নয় অবতার প্রমান করতে চাইল তারা।  প্রকাশ্যে দেখে নেবার হুমকি-ধামকিও দিল। আমি আবারও দ্বিতীয়বারের মত বিপন্ন হলাম। জীবনসংশয় দেখা দিল। আমাকে প্রশ্ন করা হল, অপরাধীর মৃত্যুর এত বছর পরে এসব কেন?

আমি বললাম, পাপের মৃত্যু হয় না, মৃত্যু হয় পাপীর। আমি বিচার নয়, মরোনোত্তর তিরস্কারের আবেদন করলাম সমাজের কাছে।

প্রায় ২০০ জনের মত নারী নিপীড়কের নাম উল্লেখ না করে, তাদের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। এবং অগণিত নারীরা বিভিন্ন সমাবেশে বলেছে যে, হ্যাঁ তাদের সাথেও এই ধরণের যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে জীবনে একাধিকবার। তারা সমাজের, পরিবারের ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক ঐ নিপীড়করা কিন্তু ঠিকই ভীত হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, অন্তত যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন তারা নড়েচড়ে বসেছেন। নাটক পাড়া, মিডিয়া হাউজ, কর্পোরেট অফিসগুলো, এমনকি সরকারি অফিসের কর্তারা পযর্ন্ত ঘেমেনেয়ে গেছেন। তারা এতদিন পযর্ন্ত ভাবতেই পারেননি যে, কোন নারী তার যৌন নিপীড়নের কথা প্রকাশ্যে প্রকাশ করতে পারে।

তবে সকলের কাছে না হলেও আমি বাংলাদেশের  অনেক নারী পুরুষের কাছে আলো হতে পেরেছি। আমার সাহসের জন্য তারা আমাকে অভিনন্দিত করেছে। এখনও প্রচ্ছন্নভাবে আমার ছায়া হয়ে সাহস যোগাচ্ছেন। অনেক নারী আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছে ,পরামর্শ চেয়েছে, পথ খুঁজেছে উত্তরণের। যদিও একমুহূর্তের জন্য আমি ভাবিনি যে আমারও হারানোর সম্ভাবনা ছিল, কারণ আমি কারো মা, বউমা, স্ত্রী, সহকর্মী, আমাকে মনে নেয়া আর মেনে নেয়া কারো কারো জন্য কিছুটা কঠিন হলেও হতে পারতো। কিন্তু আমার এই কঠিন সময় আমার পরিবার আমার সাথেই ছিল, ছিল চলার পথের সহযোদ্ধারাও। অনেক নারী অ্যাক্টিভিস্ট ব্যক্তিগতভাবে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়েছেন।

যতটা ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে অযুক্তভাবে আমরা এই আন্দোলনটা এদেশে তৈরি করেছিলাম, ঠিক তার শতগুন শক্তি নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারকরা এই আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার একটি কৌশলগত প্রায়স চালিয়েছে। তার উদাহরণ কিছু গণমাধ্যম। কারণ সরিষার মধ্যেই ভূত ছিল। সত্যিকার অর্থেই তাদের সিংহাসন কেঁপে উঠেছিল। এখনও কম্পমান। পুরুষতন্ত্রের ওই সৈনিকরা #মিটু যোদ্ধাদের জীবননাশের হুমকি দিয়েছে, চাকুরি ছাড়তে বাধ্য করেছে, কর্মস্থলে নানা বিপত্তি তৈরি করেছে এবং সর্বোপরি প্রকাশ্যে কথা বলার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

অনেকেই তাচ্ছিল্য ভরে আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, #মিটু আন্দোলন তো থেমে গেছে! গোপনে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলেছে এই ভেবে যে, এ যাত্রা বেঁচে গেছে। তাদের জন্য এই বার্তা দিতে চাই যে, আন্দোলন চলমান আছে। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত মেয়েরা তাদের প্রতি হওয়া নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করছে প্রমানপত্রসহ। তারা আরো সুগঠিত হচ্ছে। আর #মিটু কোন ঝটিকা আন্দোলন নয়, নয় কোন হঠাৎ চাওয়া দাবী-দাওয়া। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক আন্দোলন। যা বহুকাল ধরে মানবিক সমাজের তলানীতে পচন ধরিয়েছে, যা প্রতিহত করতে হবে এখন থেকেই। দীর্ঘ ৩১ বছর পর আমি যখন আমার প্রতি হওয়া যৌন নিপীড়নের কথা, আমার অসম্মানের কথা, সকল ভয়কে তুচ্ছ করে প্রকাশ করতে পেরেছি, তখন কোন না কোন ঘরে আরো কোন মুশফিকা লাইজু যে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আপনার করা যৌন সহিংসতার কথা প্রকাশ করবার জন্য অপেক্ষা করছে না, তা কে বলতে পারে?

 

মুশফিকা লাইজু: জেন্ডার বিশেষজ্ঞ  ও পরামর্শক

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *