সেল্ফ-গ্যাসলাইটিং: নিজের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যে আচরণ
বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন কাজী নাজীফা লামিনূর
সান ডিয়েগোতে বসবাসকারী ব্রিটানি বেরিংগার পেশায় একজন জ্যোতিষ লেখক। কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি তার আচরণের দুইটি দিক লক্ষ্য করেন: অনুভূতিহীনতা ও নিজের মধ্যে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা। সে মানসিকভাবে যত দুর্বল বোধ করে, এই প্রতিক্রিয়া তত তীব্র হয়। তিনি বলেন, “অতীতে আমি ধ্বংসাত্মক আচরণ মেনে নিতাম কারণ আমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইতাম যে পরিস্থিতি ততটাও খারাপ নয়। আমার ভেতরের নানা দুর্বলতা, চিন্তার প্রতিফলন, আবেগ ও নানাবিধ প্রতিক্রিয়ার কারণেই এমনটা হয়”। বেরিংগার নিজের এই সাধারণ অভিজ্ঞতাকে বেশ সাধারণ মনে করেন।
অনুশ্রী সাক্সেনা, একজন ফ্রিল্যান্স কপিরাইটার এবং ইউটিউবার। জীবনের ব্যক্তিগত ও পেশাগত উভয়ক্ষেত্রেই নিজেকে একজন ব্যর্থ মানুষ মনে হয় তার। তিনি নিজেকে বোঝান যে কেউ তাকে পছন্দ করে না এবং নিজের পছন্দের কাজটি করার ক্ষমতা তার নেই।
তিনি বলেন, “নিজেকে নিরুৎসাহিত করা আমার আচরণের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রায়ই নিজেকে একজন লোভী প্রতারকের মতো মনে হয়। মনে হয়ে আমি এমন কিছু চাইছি যার যোগ্য আমি নই”।
উল্লিখিত দুজন নারীই সেল্ফ-গ্যাসলাইটিং নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। গ্যাসলাইটিং প্রসঙ্গে আমরা হয়তো আগেই শুনেছি। গ্যাসলাইটিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে অন্যের উপর শক্তিশালী প্রভাব তৈরি করে তার মানসিক নিয়ন্ত্রণ হাতিয়ে নেয়া হয়। অন্যদিকে সেল্ফ-গ্যাসলাইটিং সংঘটিত হয় ব্যক্তির নিজের মধ্যেই। এর ফলে একজন মানুষ তার আবেগ এবং বাস্তবতাকে অবৈধ ভাবতে শুরু করে, এমনকি নিজের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে।
আপনি কি নিজের মধ্যে উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখতে পাচ্ছেন? আমরা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ পেয়েছি যাদের মতামত আপনাকে সাহায্য করতে পারে। নিজেকে ভুল ভাবার কারণ নেই, এবং এতসব উদ্বেগ ছাড়াই আপনার জীবনযাপনের অধিকার আছে।
কীভাবে সেল্ফ-গ্যাসলাইটিং শনাক্ত করবেন?
মিনেসোটার ক্লিনিকাল থেরাপিস্ট ও ট্রমা বিশেষজ্ঞ ব্রিট বারখোল্টজ বলেন, নিজের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে, যেমন নিজেকে খুব সংবেদনশীল বা অতিরিক্ত নাটকীয় মনে হতে পারে। ফলস্বরূপ আত্ম-সন্দেহ তৈরি বা নিজেকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। বারখোল্টজ ব্যাখ্যা করেন, “আপনার মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে; যেমন: আমি কি ভুল করছি? এই পরিস্থিতি কি আমি তৈরি করেছি? আসলেই কি সব দোষ আমার? এটা কি খারাপ কিছু? ইত্যাদি।
দক্ষিণ ক্যারোলিনার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ক্যাটলিন ক্যাম্পবেল আরো কিছু লক্ষণকে তালিকাভুক্ত করেন। এর মধ্যে রয়েছে নিজের মতামতের উপর আস্থার অভাব, নিজের প্রতিক্রিয়াকে বৈধ করার জন্য অন্যদের কাছ থেকে অত্যধিক আশ্বাস চাওয়া, স্ব-অনুমান করা এবং এসব নিয়ে বারবার চিন্তা করা।
মানুষের মধ্যে অনুকরণ ও অনুসরণের প্রবণতা রয়েছে যার ফলে গ্যাসলাইটিং একজনের থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। বারখোল্টজ এখানে বলেন, “যদি এই ধরনের চিন্তাভাবনা আপনার মনে বারবার এবং সহজাতভাবে আসে, তাহলে এর একটি ভালো দিক হলো যে, নিজেকে নিয়ে তৎপরতা আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং আপনি আপনার বাস্তবতাকে সন্দেহ করতে এতটাই অভ্যস্ত যে অন্যরা আপনার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবেনা”।
ক্যাম্পবেলের মতে পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, সঙ্গী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা – যে কারো দ্বারাই গ্যাসলাইটিং এর শিকার হওয়া সম্ভব। এটি এমন একটি হাতিয়ার যা ব্যক্তিগত স্বার্থে কাউকে হেয় করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
কীভাবে স্ব-গ্যাসলাইটিং বন্ধ করবেন?
এ ধরণের মানসিক উদ্বেগ প্রতিরোধে বারখোল্টজ এবং ক্যাম্পবেল উভয়েই কোনো বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়ার পরাপর্শ দিয়েছেন।
ক্যাম্পবেল বলেন, “একজন মনোবিজ্ঞানী হিসাবে আমার শীর্ষ সুপারিশ হলো যদি আপনি নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলতে চান, তবে থেরাপির সাহায্যে নিজের ভিতরকার বাধা ও দ্বিধাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। নিজেকে অসম্মান করার প্রবণতার কারণে একার পক্ষে সেল্ফ-গ্যাসলাইটিং থেকে পরিত্রাণ পাওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং। যার ফলে প্রতিটি পদক্ষেপ আপনার কাছে কঠিন মনে হতে পারে। একজন থেরাপিস্ট আপনাকে নিরাপদে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে এবং আপনার পক্ষে নিজের উপর আপনার আস্থা ফিরে পাওয়া সহজ হয়”।
একজন থেরাপিস্ট যদি সহজলভ্য না হয় তবে বারখোল্টজ এবং ক্যাম্পবেলের দেয়া কিছু পরামর্শ রইল আপনার জন্য যাতে আপনি নিজে থেকেই চেষ্টা করতে পারেন।
১. সেল্ফ-গ্যাসলাইটিং এর ধারণা ও উৎস সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়ার চেষ্টা করুন
আপনাকে প্রথমে লক্ষণগুলো জানতে হবে এবং এগুলো উস্কে ওঠার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এটি বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে বিভিন্নরকম হতে পারে এবং বিভিন্ন লোকের ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি নিজের সম্পর্কে যত বেশি সচেতন হবেন এবং জানবেন, বাস্তবতা-পরীক্ষা করা তত সহজ হবে। পাশাপাশি এই বিষয়ে পড়াশুনা করতে পারেন। আপনার চিন্তাগুলি লিখে ফেলুন এবং দেখুন সেগুলো সেল্ফ-গ্যাসলাইটিংয়ের উদাহরণ কিনা। এভাবে এগোলে বেশ উপকার পেতে পারেন। প্রিয়জনদের সাহায্য নিন যারা আপনার আবেগকে যাচাই করতে পারে।
২. নিজের ভাবনাগুলো যাচাই করুন তবে বিচার করবেন না
আপনার আবেগগুলো যৌক্তিক কিনা সেই দ্বন্দ্বে না গিয়ে এগুলো গ্রহণ করুন এবং নিজেকে মনে করিয়ে দিন যে আপনার যা আছে তা আপনার অধিকার। কখনো কখনো হতাশা অনুভূত হতে পারে কিন্তু তা নিয়ে অতিরিক্ত ভাবার প্রয়োজন নেই। এই প্রসঙ্গে ক্যাম্পবেল বলেন, আবেগগুলো অনুভব করার মাধ্যমেই সেগুলো কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। অন্যদিকে বেরিংগার দিলেন রেইন (RAIN) কৌশল মেনে চলার পরামর্শ। যার অর্থ স্বীকৃতি (Recognise), অনুমতি (Allow), তদন্ত (Investigate) এবং প্রাকৃতিক সচেতনতা (Natural Awareness)। এই বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখলে অনুভূতির কাছে আত্মসমর্পণ সহজ হয় আবার নিজের আবেগকেও ছোট করার সুযোগ থাকেনা।
৩. নিজের সাথে কথা বলুন যেন আপনি একজন বন্ধুর সাথে কথা বলছেন
এই পর্যায়ে নিজের সাথে নম্র হন। মনে রাখুন, এই পরিস্থিতি সামলে উঠতে সময় এবং পরিশ্রম প্রয়োজন। যারা এই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে তাদের কথা ভাবতে পারেন। নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। নিজেকে ইতিবাচক কিছু ভাবতে শেখান। বারবার বলতে চেষ্টা করুন, “আমি নিজেকে বিশ্বাস করি। আমার অনুভূতি বৈধ। আমি একজন ভাল মানুষ”। আত্ম-সহানুভূতি প্রচন্ড শক্তিশালী। এটি আপনার সম্পর্ককে উন্নত করতে পারে, আপনার স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে পারে এবং আপনাকে সামগ্রিকভাবে সুখি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে বারখোল্টজ উৎসাহ দিয়ে বলেন, “আপনার মধ্যে ‘খারাপ’ বা ‘ভুল’ কিছু নেই, আর যদি থাকেও, আপনি লড়াই করেন। এই প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে যাবেন না বা নিরুৎসাহিত হবেন না। ধারাবাহিক পরিবর্তনই টেকসই পরিবর্তন।”