November 24, 2024
কলামফিচার ২

দায়িত্বশীলের ভেতরে ‘চুপা পুরুষ’ ও লিসিস্ট্রাটার প্রতিরোধ 

মেহেদী হাসান ।। অ্যারিস্টোফেনিসের (জন্ম খ্রীস্টপূর্ব ৪৪৫)  লিসিস্ট্রাটা এক আশ্চর্য পণ করে বসেছিল। গ্রীসের ছোট নগর রাষ্ট্রগুলো তখন পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে মাতোয়ারা, অধিকাংশ পুরুষ যুদ্ধে চলে যায়, মেয়েগুলোর বিরহে দিন কাটে আর এদের অনেকে বিধবা হয়ে পড়ে। আজকের সমাজের মতোই ছিল সে সমাজের অবস্থা। মেয়েদের কথা ভাববে কে? তাই লিসিস্ট্রাটা এগিয়ে আসে। মেয়েদের বোঝায়, এই পুরুষগুলো যতই যুদ্ধবাজ হোক, ঘরে ফিরলে মেয়েদের কাছে দুর্বল। চলো, আমরা যুদ্ধবাজ পুরুষগুলোকে এড়িয়ে চলি! এক বছরের জন্য। ওদের শারীরিক সংস্রব থেকে দূরে রাখি নিজেদের। দেখবে, সুড়সুড় করে এগুলো যুদ্ধ ফেলে ঘরে ঢুকে যাবে। আমাদের সমাজে শান্তি নেমে আসবে।
অনেকে লিসিস্ট্রাটাকে মেনে নেয়, অনেকে মেনে নেয় না। ভাবতেই পারে না, পুরুষকে কীভাবে দূরে রাখবে নিজের শরীর থেকে। আমাদের বাংলাভাষায়ও মেয়েদের এমন স্বর পাওয়া সম্ভব। মানিকরাম গাঙ্গুলির (অষ্টাদশ শতাব্দী) ধর্মমঙ্গলে নয়নী যখন বলে, ‘পতিসনে প্রীতি নাই, সতী হয়ে কই’, তখন আমাদের বিস্ময় আর কাটে না। পতির সঙ্গে প্রীতির ভাব হয়নি বড়ু চণ্ডীদাসের (ত্রয়োদশ শতাব্দীপ) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও। তাই রাধা প্রেমে পড়েছিল কৃষ্ণের যে কি না সম্পর্কে শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে ভাগ্নে হয়। সে যাক, এসব সাহিত্য আমাদের দুটো পরিষ্কার শিক্ষা দেয় আর তা হলো : নারীরা সমাজে মানুষের অধিকার পায়নি সব সময়, তবে সে অধিকার আদায়ে তারা আদিকাল থেকেই সংগ্রামশীল। লিসিস্ট্রাটার অভিনব উদ্যোগে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কোনো এক পুরুষ বলেছিলো: ‘এই সব অসম্ভব নারীরা, এরা কীভাবে আমাদের চারপাশে থাকে! কবি ঠিকই বলেন: তাদের সাথে থাকতে পারি না, আবার তাদের বাদ দিলেও চলে না।’
বাদ যে দেওয়া যায় না  তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রেখেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দৃষ্টান্ত মেনেছেন। এতে যে মেয়েদের একটা অপর বর্গ হিসেবে তুলে ধরেছেন তা হয়তো তাঁর অনধিগম্য। তিনি সম্প্রতি বলেছেন : “এখানে আমাদের ছাত্রনেতারা বলছেন যে এখানে জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের কেউ সহজে বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ সারা রাত এরা ঘুরাফিরা করে। বাট আমি চাই না যে আমাদের যারা এত ভালো ভালো স্টুডেন্ট, যারা এত সুন্দর সুন্দর … আমাদের এখানকার যে ডিপার্টমেন্টগুলো এবং আমাদের যে বিখ্যাত শিক্ষকরা…তারা যাদেরকে গ্র্যাজুয়েট করে তোমাদেরকে বের করতে চায়, তাদের এ রকম একটা কালিমা লেপুক তাদের মধ্যে।”

শাবিপ্রবি উপাচার্য আরো বলেন, ‘‘ওই জায়গাটা কেউ চায় না, কোনো গার্জিয়ান চায় না কিন্তু। এখন, আমরা যদি কাউকে বলি তোমার বাবা-মা কাউকে ফোন করব। তখন তোমরাই তো এটা বাধা দিবা না না না এইটা হবে না, দেখ হয়রানি করতেছে। এটা তো প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব, তোমাদেরও নৈতিক দায়িত্ব যে এই মেয়ে কেন রাতের বেলা সোয়া দশটা পর্যন্ত স্যাররে সময় দিছে’’।”

এ প্রসঙ্গে একই রকম ঘটনা নিয়ে আনিসুজ্জামানের একটা স্মৃতিচারণ মনে পড়ছে। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি খোলা থাকার সময় পর্যন্ত (সম্ভবত রাত ৯টা) মেয়েদের হল খোলা রাখার আন্দোলনে মেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।  সে অনেক আগের কথা। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আনিসুজ্জামান ছাত্রীদের বক্তব্য শুনতে বসেছিলেন। এক ছাত্রী তখন আনিসুজ্জামানকে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, আপনাদের মতে, আমরা রাতে বাইরে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবো। যে দিকে আপনাদের ইঙ্গিত! আরে, নষ্ট হতে চাইলে এসব তো আমি দিনেও করতে পারি।
আনিসুজ্জামান এ যুক্তি শুনে আর কিছু বলেন নি। আমার ধারণা তিনি মেনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভিসি মহোদয় ছাত্রনেতাদের উদ্ধার করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তাঁর মতো পদধারীর জন্য সঙ্গত হয়নি। মনের ভেতরে ‘চুপা’ যে পুরুষটা আছে তাকে সামাল দিতে হবে। একটা দায়িত্বশীল জায়গায় থাকলে সে জায়গার মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষাও আমাদের থাকা দরকার। শুধু চেয়ার দেখলে বসে পড়লে হয় না। বেফাঁস কথা বললে কেবল বিপদ আরও বাড়ে। ব্যক্তির মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে অন্যের হাত নেই। কিন্তু সেটা অন্যের জন্য হানিকর কি না দেখতে তো হবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এটুকু বুঝি এ ধরনের প্রতিরোধ  আকাশ থেকে পড়ে না, বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে এর যোগাযোগ। লিলিস্ট্রাটার প্রতিরোধের যে গল্পটা শুরুতে বলেছি, তা সে সময়কার বিদ্যমান বাস্তবতা থেকেই এসেছে। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, আবার লিখি, কোনো আন্দোলন সংগ্রাম আকাশ থেকে পড়ে না,  সমাজে চেপে রাখা কোনঠাসা অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যই প্রতিরোধ বা বিদ্রোহ হয়। তাই সমাধানেও সে পথেই অগ্রসর হওয়া সবার জন্য মঙ্গল। মনের ভেতরের চুপা পুরুষটাকে আমরা লুকিয়ে রাখি সে সময়। সেটা বেরিয়ে পড়লে সংকট বাড়ে, কমে তো না। দায়িত্বশীল পুরুষের ভেতরে যে ‘চুপা-পুরুষ’টা থাকে তাকে সজ্ঞানে লুকিয়ে রাখতে হয়। এটা বেরিয়ে পড়লে লিসিস্ট্রাটারাও প্রতিরোধে নেমে পড়বে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *