September 20, 2024
কলামফিচার ২

মেয়েদের বাড়ি কোনটা?

শাফেয়ী আলম ।। আমরা বলি ‘‘মেয়েদের নিজস্ব কোন বাড়ি হয় না।” অথচ বাস্তবে মেয়ে ছাড়া কোনো বাড়িই পূর্ণতা পায় না। “প্রতিটা বাড়ি নারী ছাড়া শূন্য হাড়ি।”

আহা! কী চমৎকার শোনা গেল।

আচ্ছা। মানুষ ছাড়া যেকোনো বাড়িই তো শুন্য, সে নারী হোক বা পুরুষ। মানে নারী পুরুষ মিলিয়ে যেই পারিবারিক কাঠামোর সাথে তুলনা করে এই শুন্যতার কথা বলা হয়েছে, সেটা তো নারী বা পুরুষ যেকোনো লিঙ্গের অবর্তমানেই অপূর্ণ। নাকি?

কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে এরকমভাবে তাদের অবদান ও অংশগ্রহণকে গ্লোরিফাই করতে হয় না কেন? কারণ একটা বাড়িতে তার দালিলিক মালিকানা আছে, ফলে তার জন্য কোনো সান্ত্বনা পুরষ্কারের দরকার নেই। শান্ত তাকেই করতে হয়, যার কোনো অর্জন বা প্রাপ্য নেই।

একটি বৈবাহিক সম্পর্কে একজন পুরুষ ও নারী কি সমান বা একই ধরনের বিনিয়োগে অংশগ্রহণ করেন? কোনো কারণে বৈবাহিক চুক্তিটি ডিসোলিউশান বা ডিভোর্স হলে আমরা দেখি, পুরুষের ক্ষেত্রে সেটি শুধু সম্পর্কের বিচ্ছেদ, তার জীবন থেকে কেবল একজন নারীর বিয়োগ, নারীর ক্ষেত্রে তার মাথার উপরের ছাদ থেকে পায়ের নিচের মাটি, পুরো সিস্টেম থেকে সে বাদ পড়ে যায়। একটি বৈবাহিক সম্পর্কে একজন পুরুষ কি পুঁজিপতি এবং নারীটি কি শ্রমপত্নী নন? একটি পরিবারে কেবল অর্থের যোগান দেওয়াই একজন পুরুষের দায়িত্ব, আর নারীর দায়িত্ব ঘর সামলানো, কেবল শ্রম দেওয়া, তাই তো? পুরুষটি তার মূলধন সরিয়ে নিলে মেয়েটি কি বাস্তুহারা হয় না? তখন কোথায় হয় তার বাড়ি?

এখন একজন স্বনির্ভর, যোগ্যতা সম্পন্ন নারী, সংসার ছাড়াও বাজারে যার শ্রমের মূল্য আছে সে হয়তো নিজের  অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারেন। এই যোগ্যতাকে সাধুবাদ তো আমরা জানাবোই না, রিকোগনাইজ পর্যন্ত করব না, আমরা বরং এই বলে এই স্বনির্ভরতাকে খারিজ করে দেব, ‘‘কী হবে এত বিদ্বান হয়ে, সংসারতো টিকাতে পারলো না!’’ মানে সংসার টিকানোটাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা, যে সংসারে তার কোনো মালিকানা নেই। মানে শ্রমিকের নিজের প্রয়োজনেই কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

এই সমাজ তাই মেয়েদেরকে ওভার কোয়ালিফায়েড শ্রমিক হিসেবে তৈরি করতে চায় না, যাকে কোনো সংসার অ্যাকোমোডেইট করতে চায় না। এমন শ্বশুর-শাশুড়ি তো নিশ্চয় আছেন, সংসার ভাঙার জন্য বউ এর স্বাবলম্বনকে দায়ী করেন এবং এর বিপরীতে এমন বাবা-মাও আছেন যারা মনে করেন, মেয়েদের এতটা না পড়ালেও চলতো! একজন নারীকে এই সমাজে ভালনারেবল করে রাখা হয় যাতে সে অ্যাবিউজ এবং টক্সিসিটিকে সহ্য করতে বাধ্য হয়।

এম্পায়ার্ড উইমেন শব্দটার সাথে আজকাল আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। জীবনে এরকম উইমেনের সাথে আমাদের দেখা হোক বা না হোক, আমরা তাদেরকে ভালো চোখে দেখি না। কারণ সে সিস্টেমকে ধাক্কা দেয়, সেই সিস্টেম যে সিস্টেম আমাদেরকে কমফোর্ট দেয়, আমরা আনকমফোর্টেবল কিছু নিতে চাই না। সত্য যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, কেন আমরা তার মুখোমুখি হতে চাই না? আমরা কি অন্যায় করছি কারও সাথে, যা আমরা ঢাকতে চাই, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো?

আচ্ছা, এম্পায়ার্ড ম্যান বলে কি কিছু আছে? আমার জানা মতে নাই, এম্পাওয়ারমেন্ট পুরুষের ডিফল্ট ক্যারেক্টারিস্টিক, বরং সেটা না হলে তার জন্য সিস্টেমে টিকে থাকা কঠিন।

নারীর এম্পায়ার্ড হওয়ার যোগ্যতা আছে, যেকোনো কাজ করবার গুণ আছে, প্রতিভা আছে, তবু তাকে শুধু সংসারের কাজে আটকে রাখা হয়। কখনও এই বন্দিত্বকে ওভাররেইট করা হয়, কখনও গ্লোরিফাই করা হয়, সেইসব খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলে করা হয় নির্যাতন।

এই সমাজে ছেলেরা বিয়ে করে, আর মেয়েদের বিয়ে হয়। মেয়েদেরকে তারা বউ হিসেবে নেয়, কাদেরকে কাদেরকে যেন আবার নেয়ও না, নিয়ে আবার কখনও কখনও পরিত্যাগও করে। পরিত্যাগ করলে সে সেই বাড়িতে পরিত্যক্তা হয়, যে ছাড়া নাকি ঐ বাড়ি  শূন্য হাড়ি! পরের ধনে পোদ্দারি করতে পারা যাদের জন্য গৌরবের, যাদের স্বনির্ভরতাকে সমাজ সহ্য করে না, উত্তরাধিকারের ধারায় যাদের নাম নেই, যারা মালিকশ্রেণির অংশ নয়, সেইসব মজুরদের বাড়ি থাকবে না, তাতে আর বিস্ময় কী! কিন্তু এই তেতো সত্যকে সুগারকোটেড করে খাওয়ানো কেন? সব রকম সুগারই স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *