November 21, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

ট্রুথ লাভ অ্যান্ড আ লিটল ম্যালিস

মাসকাওয়াথ আহসান ।। সভ্য সমাজে কী আপনি কখনো কল্পনা করতে পারবেন, নোয়াম চমস্কি ক্ষমতা-কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছেন বলে; অ্যামেরিকার কোনো ফেসবুকার তসলিভাংকা নোয়াম চমস্কির ব্যক্তিগত জীবনের কাসুন্দি নিয়ে বই লিখে নিউইয়র্ক বইমেলায় আনবে। ফইন্নি মার্কা সবে স্মার্ট হওয়া আক্লিভা; সখিরানেট ফেসবুকে এসে খিল খিল করে হেসে ভাববে; বিরাট শিক্ষা দিয়েছে চমস্কিকে। চমস্কিকে মানুষ যেন তার দর্শন চিন্তা নয়; চিনবে তসলিভাংকার চটি পড়ে। হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট এসে কুঁচ কুঁচ করে কক্ষনো বলবে না; চমস্কির ওপর আজ হইতে চ্চদ্ধা হারাইলাম! চমস্কি তো জায়নিস্টদের তৈরি করা ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাই বলে জায়নিস্টের বাসার গৃহকর্মী ছেলেটি বলদাভ রায়হানেস এসে চমস্কির বেড রুমের গল্প নিয়ে রগড় করে; ফেসবুকে দেড়শটি লাইক কুড়াবে! দেড়শজন ফইন্নি জায়নিস্ট শিবিরে নেই; হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট শিবিরেও নেই। অ্যাংলো স্যাক্সন সভ্যতার সুপিরিয়রিটি ঠিক এই জায়গায়।
আপনি কি কল্পনা করতে পারেন ইউভাল হারারি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বলে রাশিয়ার কোন ফইন্নি মার্কা তসলিভাংকা হারিরির সচিত্র গে জীবন নিয়ে রগরগে উপন্যাস লিখে মস্কোর বাজারে পাঠক পাবে। মস্কোর কোন ইতিহাসানস্কি দাঁত কেলিয়ে বলবে, ব্রাভো দিদি; তুমি তো হারিরির বেবাক রহস্য ফাঁস কইরা দিছো! এই ছোটলোকি অ্যাংলো স্যাক্সন রক্তে নাই; কারণ তা এভলভ করেছে; ডারউইনের থিওরি অনুযায়ী ওরা শিম্পাঞ্জি থেকে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মানুষ হয়েছে।
কিন্তু আরব বিশ্বজুড়ে ডারউইনের শিম্পাঞ্জিরা এখনো খাওয়ার সময়, নারী সম্পর্কে কথা বলার সময়, শিম্পাঞ্জির মতো মুখ খিঁচিয়ে ওঠে। যৌন অবদমনে কিলবিল করে চারবিবি নিয়ে বিরাট বিশুদ্ধ পুরুষ হয়ে ঘোরার সময়। সাংবাদিক খাশোগজি সৌদি যুব যুবরাজ এমবিএস-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে, সেক্স পলিটিকসের অস্ত্র দিয়ে “কইয়া দিমুর” আসর বসিয়েছিল সৌদি শিম্পাঞ্জিগুলো।

এবার আসা যাক দক্ষিণ এশিয়ায়; যৌন অবদমনের কুরুক্ষেত্রে। পাকিস্তানের ইমরান খান বিবিসির সাবেক সাংবাদিক বলে রেহাম খানকে বিয়ে করার পর দেখেন; সে জমিদার গিন্নির মতো আচরণ শুরু করলে; ইমরান ডিভোর্স চান। ব্যাস ক্ষেপে গিয়ে রেহাম বেডরুমের গল্প লেখেন। সেই গল্প নিয়ে বিরোধী দলের পাটোয়ারীরা আজো লোল ফেলে। লুণ্ঠক ও অবদমিত ছোটলোকের দল; পাঞ্জাবের গমক্ষেতে রেললাইনের ধারে যার দাদা পটি করতো; সে ডিফেন্স এরিয়ার আলিশান প্রাসাদে থাকলেও জিন ভেংচি দিয়ে ওঠে; সুড় সুড় করে।
কতগুলি মেয়ে আবার ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরে টেবিলে কাঁটাচামচ মেরে বৃটিশ ককনি কপি করে উইমেন লিবের নেত্রী হয়ে ঘুরছে; মিডল এইজ ক্রাইসিসের টিচারের সঙ্গে নখরা করে ভালো রেজাল্ট আর কিছুই না করে সেক্স পলিটিক্সের ভিত্তিতে প্রমোশন বাগিয়ে মেধাবী প্রতিশ্রুতিশীল মেয়েদের বিকাশের পথে বাধা হয়।
পাকিস্তানের বিখ্যাত এক পত্রিকার সেনাবাহিনীর ভাড়ুয়া এক সম্পাদক এক কার্টুনিস্টের ওপর রেগে যায়। এই শিল্পী জিয়াউল হকের ঘুম হারাম করেছিল। পাকিস্তানের মস্ক-মিলিটারি কেউ সহ্য করতে পারে না কার্টুন। তাদেরকে খুশি করতে সম্পাদক অফিসের সেক্সপলিটিক্সের এক নারীকে নিয়োগ করলো। আর্টিস্ট তাঁর রুমে দিনমান আঁকে; সেখানে ঢুকে ইংলিশ ভিংলিশ নারী ঐ কাজপাগল আর্টিস্টকে নিজেই জড়িয়ে ধরে সিনক্রিয়ট করলো। তারপর “হ্যাশ ট্যাগ মি টু” দিয়ে বাজার মাতালো। বাংলাদেশের বাতাবি মার্কা টিভি শোতে এই মি টু আমরা দেখেছি। নির্যাতিত নারীর মি টু আন্দোলনকে কীরকম পাপিয়াপট্টির অস্ত্র বানিয়েছে এরা।
ভারতে খুশওয়ান্ত সিং ঠিক এরকম অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়েছেন। আর শাশী থারুরের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গুজরাটের গমক্ষেতে পটি করা নোংরামি তো দেখেছেন। তাদের সঙ্গে ঠিকই যোগ দিয়েছে মুম্বাইয়ের সেক্স পলিটিক্সের নেত্রীরা।
শৈশবে অগ্নিপথ মুভিতে দেখেছিলাম, লালবাতি এলাকায় বয়স্ক শিক্ষা দিতে গিয়ে এক শিক্ষক পঞ্চায়েত প্রধানের ষড়যন্ত্রে; সেক্স পলিটিক্সের শিকার হয়ে অপমানে আত্মহত্যা করেন।
ঐ সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটিতে এসে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি পড়াতাম ঈশ্বরদীতে। একদিন এক নতুন ফর্সা কাপড় মাস্তান এসে বলে, তুমি মিয়েদের পড়াও; তুমাকে কলংক দিয়ে দেবোয়ানে! হুঁশিয়ার হই চইলো! একথা আমার বন্ধুদের জানালে, পাতি মাস্তানটিকে তারা আদর করে দেয়। তখন সে আমাকে এসে মাফ চেয়ে বলে, তুমি দেকি রসিকতা বোজোনা পাবেল!
অগ্নিপথ দেখার পর “গান্ধা কইরা দেয়ার” মাইন পাতা ভূমিতে সাবধানে হাঁটি। খুব বেছে বেছে মিশেছি। আমাকে ভুল বুঝে অনেকে রেসিস্ট বলেছে। কিন্তু আমার কাছে প্রতিটি রেস সম্ভাবনাময়; প্রতিটি মানুষের চোখে স্বর্গের আলো। আমি জানি সভ্যতার ধারা টেমস থেকে কঙ্গোর দিকে একমুখী নয়; তা কঙ্গো থেকে টেমসের দিকেও যায়। কিন্তু কখনো কোথাও লুজবল দিইনি আমি। এমন মেয়ের সঙ্গে মিশিনি যে কোনো অবিবর্তিত শিম্পাঞ্জির কাছে আমাদের বন্ধুত্বের গল্প করবে।
আমাকে না চেনায়; গোবরায়তনের কতগুলো অনগ্রসর চুলকানি রায় তাদের কদমা দিয়ে রগড় করার সখি নিয়ে ব্যর্থ হাহাহিহি করে দর্শক পায়নি। কার কাজ নাই; যাকে ছোটবেলা থেকে চেনে; তাকে গোয়ালে বড় হওয়া হীনমন্য বলদের ঈর্ষার কাল্পনিক গল্প দিয়ে চিনবে! বাংলাদেশ তো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দেশ। এখানে গ্রামের চাখানা অ্যারিস্টটলের পাঠশালা। গ্রামের মেয়েরা বেগম রোকেয়ার আলো হাতে চলে।
ফলে বিদেশে কিছু একটা পড়তে গিয়ে কিছু একটা করছে; জিনস টিশার্ট পরে পতাকা মাথায় জড়িয়ে পথিকৃত বাতেন “হা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ করছে”; কিংবা স্ট্রেট কাট চুল কেটে মনিকা লিভনিস্কির মতো সেজে কোয়ালিটি টাইম কাটাচ্ছে আকলিমা নদী; কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ বলে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে; তাই বলে ওটা দেখে বাংলাদেশ ইমপ্রেসড হবে না। এস এম সুলতান, সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রিজিয়া রহমান, দিলারা হাশেম, সেলিনা হোসেনের মতো স্মার্ট আমাদের ছেলেমেয়েরা। তাদের কয়েকজন ঠিকই বলদা রাশির গোবরায়তনের ফইন্নিগুলিকে বলেছিল, এই লেখক যে আপনাদের পুছতেছে না; তাও কথা কইয়া ক্যালরি নষ্ট করেন কেন! আমরা তার বিষণ্ণতার শহরের পাঠক; এটা আমাদের অন্যরকম ভালোলাগার লোক; আপনেরা অফ যান।
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের প্রতিটি মানুষকে নিয়ে বাজে কথা বলে; জামায়াত আর আওয়ামী লীগের সাইবদরেরা। ভটভটি আপা কারো লেখা দেখে হিংসা হলে পাঠিয়ে দেয়, বাল্টন দাসকে; যাও মল ঢেলে দিয়ে এসো; লেখকের টাইমলাইনে কও গিয়া পাকিস্তানপন্থী। কিংবা অবদমিত জামায়াত পাঠায় ফুরকান খাদেমকে ; যাও টাইমলাইনে গিয়ে বলে এসো, নারীগো উলঙ্গ দেখতে খুব খায়েশ; তাই হিজাবের সমালোচনা করেন মিয়া!
অ্যাজ ইফ ফইন্নির ছেলেমেয়েদের বয়ান কিনতে সবাই বসে আছে; আর কুনো কাম কাজ নাইক্কা।
ধরুন শিবির আর শিবসেনা; পালা করে বাংলাদেশের গুনী মানুষদের গালি দেয়। জামাতের অপছন্দ প্রগতিশীলতা; আর শিবসেনা চায়, মুছুম্মান কেনু লেখক হবে! তারা রবীন্দ্রনাথের মাজারের খাদেম হবে! বংকিমের কাছে “বন্দে মাতরম” শিখবে!
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কলকাতার পাঠকেরা লেখকের ধর্ম দেখেনা; এভলভ করে গেছে। চিন্তার জগতে তারা মানব ধর্মের। ওরা বাংলাদেশের লেখকের বই গোগ্রাসে গেলে। ২০০২ সাল থেকে ডয়চেভেলেতে কাজ করার সূত্রে, সুনীলদা, মহাশ্বেতা দেবী, সুবোধ সরকারের যে অনুপ্রেরণা পেয়েছি; তরুণ শ্রীজাত যেভাবে ইয়ুথ শোতে এসে বন্ধুত্বের হাত ধরেছে; যেভাবে এখনো প্রতিদিন যুক্ত থাকি কলকাতার সাহিত্য আড্ডায়; আমার অবাক লাগে বাংলাদেশে প্রগতিশীল সেজে থাকা শিবসেনা দেখলে।
করাচিতে ভারতের লেখক অত্যন্ত পছন্দের; রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ হয়; অনুবাদক দীনবন্ধু মিত্রকে খোঁজে; কলকাতাকে সাহিত্যের বাতিঘরের মর্যাদা দেয় করাচী। অথচ বাংলাদেশের শিবিরেরা পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু লেখক বাদ দিতে চায়। এই সর্বোনেশে ইসলামপন্থী; আর ইজরায়েল সাজা গরীবের শিবসেনাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার নিকৃষ্ট শিম্পাঞ্জি।
আওয়ামী লীগ এতো আলোকিত রাজনৈতিক দল; তারা কেন ভিন্নমতের লেখকদের গান্ধা করতে সিপি গ্যাং পোষে; গোবরায়তন বানায়; বুঝে আসেনা সত্যি।
সলিমুল্লাহ খান উজ্জ্বল এক বুদ্ধিজীবী; উনি যে সংখ্যক বই পড়েন; যেমন শ্রুতিধর; অমন গড গিফটেড হতে আমাকে আবার জন্মাতে হবে। যেহেতু উনি চমস্কির মতো প্রচলিত ন্যারেটিভ চ্যালেঞ্জ করেন, রবীন্দ্র নজরুল কারো মাজারের খাদেম না হয়ে তাদের তেলওয়াত করেন; সুতরাং তাকে নিয়ে “তার ব্যবহৃত জুতোর চেয়ে কম মূল্যে”র শিবসেনারা রগড় করে; তাঁকে ভেংচি কাটে। ফইন্নিগুলোর পেটে বোমা মারলে বিদ্যার ছিটেফোটা পাওয়া যায়না; আসে মি খানকে ওজন করতে।
সেই গ্রাম্য আকলিমা নদী ইউরোপে জিনস আর টপস পরে; বিদেশের বাংলা আড্ডায় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের ভাই ভাই করে; খুব স্মার্ট হয়ে ছফার প্যারোডি করে সলিমুল্লাহ খানকে নিয়ে “গোবর গ্রন্থ” প্রণয়ন করেছে। ভেবেছে যারা মি খানের ঔজ্জ্বল্যের কাছে নিষ্প্রভ সেই নাম পুরুষেরা লুফে নেবে এই কাসুন্দি; ফার্স্ট জেনারেশান সেক্স পলিটিক্সের মি টু’রা লাইন ধরে “বেড রুমের ব্যাবাক কথা ফাঁস কইরা দিমু” পড়বে!
সেই দিন কি আছে নাতি; খাবলা খাবলা হাতু খাইতি! ইন্টারনেট আলোকসরণিতে বাংলাদেশের পাঠকেরা যুক্ত বিশ্ববীক্ষার উদার পথে।
তারা জানে, একজন বাংলাভাষী ‘হারিরি’র তৃষ্ণা সলিমুল্লাহ খানই মেটাতে পারেন।
আর ফুরিয়ে যাওয়া ইন্টারনেট বাইজির শেষ মুজরার ট্র্যাশ গ্রন্থনৃত্য রয়ে যাবে বিকৃতির ল্যাবিরিন্থে; হারিয়ে যাওয়া উপেক্ষায়; পড়ে থাকা পরচুলো আর জরির পোশাকের অক্ষমতার কান্নায়।

(লেখাটি নিউটনের তৃতীয় সূত্রমতে লেখা বলে সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তেতো; পাঠকের সুকুমার বৃত্তি আহত হলে তার জন্য আগাম দুঃখ প্রকাশ করছি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *