আলেক্সান্দ্রা কোলনতাই: পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সাম্যবাদের স্বপ্নে
ফাতেমা তুজ জোহরা ।।
আলেক্সান্দ্রা কোলনতাই একজন রাশিয়ান বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ ও মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক। মার্ক্সবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত এই নারী রাশিয়ায় ১৯১৭-১৮ এর দিকে ভ্লাদিমির লেনিন সরকারের আমলে বলশেভিক পার্টিতে উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী যিনি সরকারি মন্ত্রীসভার সদস্য হন।
মার্ক্সবাদ আদর্শে অনুপ্রাণিত আলেকজান্দ্রা কোলনতাইয়ের জন্ম রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে, ১৮৭২ সালের ৩১ মার্চে। তার বাবা জেনারেল মিখাইল আলেক্সেভিচ ডোমন্টোভিচ-এর পরিবার ছিল ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভুত। রুশ-টার্কিশ যুদ্ধে ক্যাভালরি অফিসার হিসেবে কাজ করার পর নানা জায়গায় বদলি হয়ে মিখাইল আলেক্সেভিচ পিটার্সবার্গেই স্থায়ী হন। সেখানে থেকেই তিনি রাজনীতির দিক ঝুঁকে পড়েন।
এদিকে আলেক্সান্দ্রার মা আলেক্সান্দ্রা আলেক্সান্দ্রোভনা মাসালিনা পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন ফিনল্যান্ডের। আলেক্সান্দ্রোভনা মাসালিনা তার প্রথম বিয়ে ভেঙে মিখাইল আলেক্সেভিচকে বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়ে করতে তাদের দু’জনকেই বেশ কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল। বাবা-মায়ের এই দীর্ঘ সংগ্রামের গল্পই সম্পর্ক, বিয়ে ও যৌনতা সম্পর্কে আলেক্সান্দ্রা কোলনতাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়ক ছিল।
আলেক্সান্দ্রা যতো বড় হতে থাকেন, তার মেধাও ততো বিকশিত হতে থাকে। তিনি ছিলেন বাবার বেশ অনুরাগী। বাবার মতোই ইতিহাস ও ভাষার প্রতি তার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। বড় হবার সাথে সাথে ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি, ফিনিশ ও জার্মান ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি।
জীবনের প্রথম ধাক্কা খান যখন তিনি হাইস্কুল শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার মা স্পষ্টই জানিয়ে দেন যে মেয়েদের এতো পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। তখনকার রীতি অনুযায়ী নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে ভালো “স্বামী” পাওয়ার জন্য। আর সে জন্য এতো পড়াশোনার দরকার নেই।
তবে আলেক্সান্দ্রা ছিলেন অন্যরকম এক নারী। তিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন ভ্লাদিমির লুডভিগোভিচ কোলোনতাইকে। আলেক্সান্দ্রার মা এই সম্পর্ক মেনে না নিলেও অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর ১৮৯৩ সালে তারা বিয়ে করেন এবং এরপরেই আলেক্সান্দ্রা নিজের পড়াশুনা ও মার্ক্সবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
সে সময় রাশিয়ায় অভিজাত পরিবারের নারীদের জীবন ছিল গৃহস্থালি ও পারিবারিক দায়দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেরকম এক সময়ে এক যুগান্তকারী নারী মাত্র ২৭ বছর বয়সে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টিতে যোগদান করেন। সে সময় তিনিই দেখিয়েছিলেন যে নারী হলে শুধুই ঘরকন্না নয়, ইচ্ছা থাকলে ঘর-সংসার ছাড়াও নারীরা অন্য অনেক কিছুতেই যোগদান করতে পারেন। তার এই মনোভাবই তাকে শক্তি যোগায়। ১৯১৭ সালে তিনি সোভিয়েত প্রশাসনে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন এবং সমাজকল্যাণের জন্য “পিপলস কমিসার” হিসেবে নিযুক্ত হন।
বিয়ের ঠিক পর পরই আলেক্সান্দ্রা একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেন। কিন্তু সন্তান আর সংসারের মাঝে জীবন কাটাতে এই নারী জন্ম নেন নি। রাজনৈতিক দলের সদস্য হবার কারণে তিনি একটি টেক্সটাইল কারখানা পরিদর্শনে যান। সেখানে নারী শ্রমিকদের ভয়াবহ অবস্থা তিনি প্রত্যক্ষ করেন। এই ঘটনা তার রাজনৈতিক জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলে।
এরপর তিনি শ্রম আন্দোলনের ইতিহাস পড়াশুনা শুরু করেন। সেই সাথে তখন নারী শ্রমিকদের তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলার লড়াইয়ের সূচনা করেন। আর মধ্যবিত্ত নারীদের সমাজের বাধা-বিপত্তি ও পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি প্রচারণা শুরু করেন। জীবদ্দশায় তিনি নারীদের নিজের অধিকার বুঝে নেয়ার জন্য সব সময়ই উৎসাহ দিয়ে গেছেন।
যেহেতু তিনি রাশিয়ান বিপ্লবী সরকারের সদস্য ছিলেন তাই নারীদের অধিকার আদায়ের যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন সেগুলোর অনেকটাই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীদের জীবনধারা উন্নত করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “নারী বিভাগ”। এই বিভাগটি সে সময়ে সোভিয়েত নারীদের নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে এবং শিক্ষা ও কাজের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছিল। তবে কমিউনিস্ট পার্টিতে তিনি ধীরে ধীরে সমালোচনার পাত্রী হয়ে ওঠেন এবং রাজনৈতিক প্রভাবও হারান। ১৯২০ এর দশক থেকে তিনি বিভিন্ন কূটনৈতিক পদে নিযুক্ত হন যাতে করে সাধারণ মধ্যবিত্ত নারীদের জীবনে তিনি কোনো ধরনের প্রভাব ফেলতে না পারেন ও যেকোনো ধরনের নীতি প্রণয়ন করার ক্ষমতাও তার না থাকে। আর ১৯৩০ সালে এই “নারী বিভাগ” পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।
কোলনতাই বিশ্বাস করতেন বিয়ে একটি পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার্থে পুরোনো প্রথা। এই প্রথা নারীদেরই ভাঙতে হবে। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হলেই ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজে শক্তিশালী এক মেলবন্ধনের মাধ্যমেই নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের শোষণ বন্ধ হবে। নারীমুক্তির অগ্রদূত হিসেবে তিনি নারীবাদকে দেখেন একটি নতুন সমাজব্যবস্থা হিসেবে, যাকে তিনি মার্ক্সীয় নারীবাদ হিসেবেও অভিহিত করেন।
বুর্জোয়া নারীবাদীদের তিনি আজীবন সমালোচনা করে গেছেন। তার মতে, নারীদের ভোটাধিকার নারীদের রাজনৈতিক সমতা দেয় কিন্তু সেই খেটে খাওয়া শ্রমিক নারীটির অধিকার আদায়ে তো সক্ষমতা দেয় না। সাধারণ নারীদের অধিকারের জন্যই তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। আর সংগ্রাম করেছেন খেটে খাওয়া নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য।
আলেক্সান্দ্রা কোলনতাই জীবদ্দশায় পেয়েছেন ৪টি পুরষ্কার যার মধ্যে রয়েছে “অর্ডার অব লেনিন”, “অর্ডার অফ দ্য রেড ব্যানার অব লেবার”, “নাইটস গ্র্যান্ড ক্রস অব দ্য রয়াল নরওয়েজিয়ান অর্ডার অব সেন্ট ওলাভ” ও “অর্ডার অব আযটেক ঈগল”।
সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখা এই নারী মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫২ সালের ৯ মার্চ, রাশিয়ার মস্কোতে; তার ৮০তম জন্মদিনের মাত্র মাসখানেক আগে।