আমাদের প্রতিবাদ, ছাড়পত্র ও একজন ফেমিনিস্ট ফিল্মমেকার
সাদিয়া মেহজাবিন ।। আমাদের তেল আনতে পান্তা ফুরায়, এখন আর কারো আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের নাড়া দেয় না। সিনেমা বা রুচিশীল বইয়ের আলাপ তো বিলাসিতা। তারপর নারীবাদ নিয়ে আলাপ বা একজন ফেমিনিস্ট ফিল্মমেকার বা সিনেমা নিয়ে আলাপ করলে আমাদের সুশীল সমাজের মনে দাগ লেগে যায়। তবুও যতসব ঘটনা চাপা পরে যাচ্ছে তা নিয়ে আওয়াজ তুলতেই হয়।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সৃজা কিংবা আশামনির ঘটনা আমাদেরকে কতটা আঘাত করেছে জানি না, তবে জানা আছে, অন্যসব ঘটনার মত এটাও চাপা পড়ে যাবে। আশামনি লিখে রেখেছিল, সোনা বাবা মাকে বিদায়! আশা হয়তো একবারো ভাবেনি – না আত্মহত্যা না করি, বিচার চাই। বিচার দূরে থাক আশা কেবল ভেবেছে সম্মান! এই সম্মানের সংজ্ঞা আমাদের সমাজ নির্ণয় করে নানান নীতি দিয়ে। সম্মানের দোহাই দিয়ে সৃজাও ১২ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে। কোথাও উচ্চ রব ওঠেনি। এতসব ঘটনার মাঝেও চোখ আড়াল করে চলে যেতে হয়। কিন্তু চেপে যাওয়া শব্দ কোথাও না কোথাও লিপিবদ্ধ হচ্ছে। ভাববেন না সকলেই ভুলো মনের। কেউ তুলে রাখে কলমে, কেউ সিনেমার স্ক্রিপ্ট বোর্ডে। এমনি এক শর্ট ফিল্ম “ছাড়পত্র”। নির্মাণ করেছেন অপরাজিতা সংগীতা। আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবের ১৬ তম আসরে প্রিমিয়ার শো হয় “ছাড়পত্র” স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার।
এবারের ১৬ তম আসরে সুযোগ হয়েছে “ছাড়পত্র”র প্রিমিয়ার শো দেখার। সমসাময়িক ঘটনা এবং একজন ফেমিনিস্ট ফিল্মমেকারের অবস্থানসহ সিনেমাটি কেন যৌক্তিক তা দিয়েই সূচনা হোক লেখার। সমাজ চায় নারীরা কেবল ঘরের কাজই করবে, খুব বেশি হলে অল্প পড়াশোনা। আর বেশিরভাগ সুশীল সমাজ মানতে নারাজ নারীর শিল্পচর্চাকে। নারীকে কেবল তারা ক্যানভাসেই প্রদর্শন করবে কিন্তু একজন নারীই যখন স্বয়ং ক্যানভাসের স্রষ্ঠা হয়ে ওঠে তখন তারা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। সিনেমা বানানো এবং তাতে বাস্তবা তুলে ধরে আর দশজনের মনে সাড়া জাগানো বিরাট কর্ম।
ছাড়পত্রের শুরুতেই দেখা যায়, একজন স্ত্রী ডিভোর্স চাচ্ছে আইনি প্রক্রিয়া মেনে। কারণ জানা এবং সমাধানের ইচ্ছায় উকিল জানতে চান কেন স্ত্রী ডিভোর্স চান। সাধারণত আমাদের সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চর্চার বাইরে গিয়ে যেসব কুরুচিপূর্ণ প্রশ্ন করা হয় সেসবই করছিলেন উকিল। ভালোবাসার অভাব নেই তবে কেন চান ছাড় এমন প্রশ্নেই উঠে আসে। স্বামী চান তাদের একটি মেয়ে হোক। তবে স্ত্রী চাননা সন্তান নিতে এবং এমন সিদ্ধান্তে স্বামীকে বাবা হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে ভেবেই চাইছেন ছাড়। ভাবা যায়, পুরান রীতি সকলে তো ছেলেই চায়। কিন্তু দর্শকের স্মৃতিতে আরেকটু শান দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসে তনু, নুসরাত, ৯০ বছরের বৃদ্ধাসহ দুই মাসের শিশু ধর্ষণের কথা। একজন নারীর পক্ষে কতটা কুৎসিত বাস্তবতার মুখে পড়তে হয় তারই যেন এক ধারাবাহিকতা। তবে স্ত্রী ছেলেও চান না কেননা একজন সন্তান যখন মানুষের মত বেড়ে না উঠে পুরুষ হয়ে বেড়ে ওঠে তখন হয়তো আর অন্যায় চুপ করে সহ্য করা যায় না। ছাড়পত্র’র শেষে দেখা যায় স্বামী সব কিছু মেনে নিয়ে, নিজেই বরং ব্রত হন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার এবং সমাজ সংস্কারকের।
সিনেমা বোদ্ধারা সিনেমার রঙ, অভিনয় অথবা কৌশলগত সমালোচনা করেই নির্লিপ্ত হবেন না বরং এই সময়ে এমন বিষয়ে স্পর্শকাতর সিনেমার জন্যে দোষারোপও করতে পারেন। তবে সত্য বলতে লজ্জা নেই, চোখের জল নিয়েই দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিলাম। মানছি সিনেমা নিয়ে আলোচনায় একপাক্ষিক আলোচনা শ্রেয় না। সেক্ষেত্রে আলোচনার খাতিরে সমালোচনা দিয়েই কিছু কথা বলা যাক। সন্তান পৃথিবীতে না আনার অথবা কেবল পুরুষের দ্বারা সংস্কার দিয়ে হয়তো এত বিরাট সমস্যার সমাধান করা যাবে না তবে মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার প্রচেষ্টায় আমাদের পরিশ্রম প্রয়োজন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কড়া নাড়ার ব্যাপারটা হলো বাস্তবতাকে সাহসের সাথে পর্দায় তুলে ধরা। আমরা যারা ভয়ে চুপসে যাই, যারা ভুলে যাই তনু-নুসরাতের কথা কিংবা সাহস করিনা প্রতিবাদ করতে, তাদের জন্যে ‘ছাড়পত্র’ আদর্শ হিসেবে তুলে রাখা যায়। তার জন্যে একজন ফেমিনিস্ট ফিল্মমেকার হিসবে পরিচালককে সফল বলতে হয়। এবং স্বয়ং “ছাড়পত্রে’র যৌক্তিকতাও প্রমাণ হয়।
চলচ্চিত্র উৎসবে অপরাজিতা সংগিতার সাথে ‘ছাড়পত্র’ এবং ‘ফিল্মমেকার’ হিসেবে তার অনুভূতির কথা জানার সুযোগ হয়েছিল।
ছাড়পত্রের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় এটি বেশ শক্তিশালী সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে যার বেশিরভাগ ধামাচাপা পড়ে গেছে, নয়তো সঠিক বিচার পাননি। তাই সেক্ষেত্রে ছাড়পত্রের কাজ করতে গিয়ে নিশ্চিতভাবে নানান ঝুঁকির মুখে পড়েছেন অপরাজিতা সংগীতা। এ বিষয়ে বলেন, অন্তর্দহনের কারণেই এই সিনেমা বানানো। আমি তো একজন শিল্পী, সিনেমা মেকার, তাই সিনেমার মাধম্যেই প্রকাশ করেছি। সমসাময়িক অনেক ঘটনাই চাপা পড়ে গেছে এর মানে এ নয় তার কোনো অস্তিত্ব নেই বা সে অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে না। এই ঘটনাগুলোকে কোথাও না কোথাও তুলে রাখতে চেয়েছি এবং যেন হারিয়ে না যায় তাই নিজের জায়গা থেকে কিছু করার চেষ্টা করেছি। আর ঝুঁকি ছিল, আছে কিন্তু ঝুঁকি আছে বলেই তো প্রতিবাদ করব না, তা নয়। তাহলে তো আমরা পিছিয়ে যাব। আমি একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার, ফেমিনিস্ট ফিল্মমেকার হিসেবে চেয়েছি কেবল বিনোদন নয় এমন প্রতিবাদমূলক কিছু করতে। তাই সামনে কোনো বিপদ আসলে আশা করি সামলে নেওয়া যাবে। সকলে সিনেমা দেখুন, সিনেমা ভালোবাসুন। আর অবশ্যই প্রতিবাদ করুন। অন্যায়ের প্রতিবাদ জরুরি।
সিনেমা দেখার মন এবং বিবেকবোধ থেকে এই সিনেমা যে কেবল আমাকে ছুঁয়ে গেছে তা না। উৎসবে আসা নানান পেশার দর্শকও বিশেষ করে যারা নারী তারা নিজেদের বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত হয়েছে। আমরা জানা অজানায় হারিয়ে ফেলি এসব শব্দ, হয়তো প্রতিবাদ না করে করে এমন অবস্থা হয়েছে যার ফলে এখন আর আমরা বুঝি না অন্যায়টা হচ্ছে কোথায়। অন্যত্র হিসেব বাদ দিয়েও বলা যায় এখন আমরা পিছিয়ে। সমতার রেখা যতদিন টানা হবে না ততদিন হয়তো এই দায় কাঁধেই থাকবে। তাই অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হোন, প্রতিবাদ জারি রাখুন।