মাথাটা যখন আপনার-আমার, একটু ভেবে দেখবেন কি?
ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। মাথাটা আপনার। হিজাব, ঘোমটা, আল্লাহ আকবর, জয় শ্রীরাম – চয়েস অবশ্যই আপনার। এখন কলকাতা শহরেও হিজাব পরিহিতাদের সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকাতেও দেখেছি হিজাবের বেশ রমরমা। কেউ বলে, এটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। আবার কেউ বলে, ধুলো ধোঁয়া থেকে সৌন্দর্য রক্ষা করে; লোভী পুরুষের থেকে বাঁচায়। আবার কেউ বলে, যতই বিদ্যা থাক ঘরোয়া, ধার্মিক মেয়ে না হলে বিয়ের বাজারে সমস্যা হয়। এ ব্যাপারে আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। প্রায় এক বছর আমি এক গার্লস স্কুলে পড়িয়েছিলাম। সেখানে ক্লাস নাইন থেকে মেয়েরা শাড়ি পড়ত। হেড মিস্ট্রেস একদিন নোটিস দিলেন, “নবম ও দশম শ্রেণির মেয়েদেরকে এবার থেকে সালোয়ার কামিজ পরে আসতে হবে।” ব্যাস, শুরু হয়ে গেল আন্দোলন। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ কামিজ পরে আসেনি। মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলাম, “সালোয়ারে তো অনেক স্বাচ্ছন্দ্য, তাহলে?” আন্দোলনকারীদের থেকে একজন বলেছিল, দিদি, আমাদের বড় দেখাবে না, অন্য নিচু ক্লাস মানতে চাইবে না।” আরেকজন বলেছিল, “সেই তো বিয়ে হলে পরতেই হবে, এখন থেকে অভ্যাস করাই ভালো।” আমাদের এক শিক্ষিকা বললেন, “যাই বলো, শাড়িতেই নারীর সৌন্দর্য খোলতাই হয় বেশি। দ্বিতীয় জনের কথাটা বেশ মনে ধরেছিল। বিয়ের পর সালোয়ার কামিজ, জিন্স পরে বউ শ্বশুরবাড়িতে নেচে বেড়াচ্ছে, এ যে ঘোর অমঙ্গল! সত্যিই তো, বিয়ের বাজারে এখনও শিক্ষিতা অথচ ঘরোয়া আচার বিচার সম্পন্ন মেয়ের চাহিদা বেশি। প্রেমে অবশ্য বেপরোয়াদের চাহিদা মন্দ নয় কিন্তু বিয়ের সময় , ‘ওসব মেয়েছেলে’।
বাপের বাড়ি হোক বা শ্বশুরবাড়ি যারা বেপরোয়া ম্লেচ্ছ, তাদের প্রত্যেককে দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে সামিল হতে হয়েছে। এখানে কোনো যুক্তি বুদ্ধি চলেনা, শুধুই অভ্যাসকে আঁকড়ে সংসার রাজনীতির ময়দানে সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে সামিল হওয়া। শুধু পরিবারে নয়, আমার স্কুলে ইলেভেনে পড়ার সময় কামিজ পরে আমাকেও একঘরে হয়ে থাকতে হত কারণ বেশিরভাগ মেয়ে শাড়ি ছাড়েনি। ভাগ্যিস, আমাদের স্কুলে কোনো ড্রেস কোড ছিল না! অনেকেরই হয়তো মনে আছে, এক স্কুলের দিদিমণির শাড়ি-সালোয়ার বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
এখন আবার উল্টো ব্যাপার। কামিজ, জিন্স ছেড়ে যেদিন শাড়ি পরে অফিস যাই, সেদিন লোকজন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “আজ কি কোনো স্পেশাল ডে? শুধু শাড়ি নয়, সিঁদুর পরেন না কেন, হাতে শাঁখা পলা কই, এক হাতে চুড়ি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েদের মধ্যেই এই আলোচনা চলে বেশি।
মাঝে মাঝে মেয়েদের এইসব আন্দোলন দেখলে বড্ড করুণা হয়। হায় রে, আমাদের মনিষীরা, আপনাদের শিক্ষা বৃথা। চয়েসের নামে নিজের মাথাকে (যুক্তি বুদ্ধি) ঢেকে এরা কোথায় চলেছে? অবশ্য, এ প্রশ্নের উত্তর কিছুদিন আগে করা একটা সমীক্ষায় উঠে এসেছে – সেটা হল, প্রায় সত্তর শতাংশ নারী স্বামীর ঘরে ভাতের সঙ্গে মারও খেতে চান। খুবই ভালো কথা। আর বেশি কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। গেরুয়া উত্তরীয়, হিজাব ঘোমটা বোরখা পরে আপনারা শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি জাহান্নাম, বেহেস্ত যেখানে খুশি যান, দয়া করে স্কুল কলেজে যাবেন না কারণ ওখানে যাবার শর্তই হল, মাথাটা খোলা রাখা।
এবার আসি নারী দিবসের কথায়। সেই দিনটা বিশেষভাবে নারীদের। অগুনতি প্রশস্তি। মেসেজের পর মেসেজে দশভূজা – কাঁখে বাচ্চা, হাতে খুন্তি থেকে ল্যাপটপ, মিসাইল থেকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার। ভালো, বেশ ভালো, খুব ভালো, অসাধারণ! যা খুশি করার দিন। ঘোমটা সিঁদুর হিজাব বোরখা খুলে একটু নেচে নিন, বক্তৃতা দিন, প্রতিজ্ঞা অঙ্গীকার প্রয়োজনমতো করে নিন, করিয়ে নিন। কাল থেকে কিন্তু যেমনকার তেমনি –
১. দিনকাল ভালো না, একা কোথাও যাবে না।
২. আমার এনআরআই পুত্রের জন্য ঘরোয়া মেয়ে দেখে দিস তো একটা, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারও হবে আবার ঘোমটা দিয়ে খ্যামটাও নাচবে।
৩. কি ভালো শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিস রে, ওরা তোকে দারুণ সাপোর্ট দেয়।
৪. খুব তো নারীবাদী, পুরুষদের দুঃখের কথাও একটু বলবেন তো।
৫. ওমা, মাছ মাংস ঠেকানো খাবার কি পবিত্র বিধবাদের দেওয়া চলে?
৬. ইস্কুল কলেজ অফিসে দিদিমণি মেয়েগুলো যে কত খায়, ওরা বাড়িতে খেতে পায় না ?
৭. আমি তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম, তুমি ? কেন, আমি নাম ধাম গোত্র পাল্টে তোমার সন্তানের মা হব।
৮. সব দোষ যখন ছেলেদের, তখন বিয়ে করার দরকার কী, একা থাকলেই তো পারতেন ?
৯. সে আর বলতে, যত নষ্টের মূলে ওই প্রেম। এত বড় নারীবাদী কিন্তু প্রেমে পড়েই ধড়াস। সব কিছু ভুলে, এমনকি কন্যাশ্রীর টাকাটা পর্যন্ত না নিয়ে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে ভেগেছি। যা ভাগ, লেখাপড়া শিখে চাকরি আছে ?
৯. তুই চাকরি করবি, আমি ঘোমটা দিয়ে, শাঁখা সিঁদুর আলতা পায়ে সংস্কৃতি টেনে নিয়ে যাব। জানিস, অপবিত্র কাঠিয়াবারের গঙ্গার কত বড়? বেশ্যা বলবি না, বল ব্যবসা।
১০. ওমা, বৌদি,মাথায় সিঁদুর নেই কেন গো? ওই তো, দাদার মাথায়। আর হিজাব? বাজারে গরম হল্কা ছেড়ে শেয়ার বাজার চাঙ্গা করে যুদ্ধের বাজারে উইড়া গেছে।
কলির শ্যাষ। খালি যুদ্ধ। শোনো, পতি পরম গুরু, বেশি কথা বলবে না, যেমন আছ তেমনি থাকো। কোনোদিন লক্ষ্মীকে হাতে তুলে পাঁচশ টাকা দিয়েছ? চাইতে গেলেই মদ খেয়ে পিটিয়েছ। পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কিংবা কন্যাশ্রী প্রকল্প মেয়েদের অনেকখানি ভরসা জুগিয়েছে, একথা অস্বীকার করতে পারি না।
না না আর পয়েন্ট নয়, এখন একটাই প্রশ্ন আপনি যে এসব যাচ্ছেতাই লেখেন, পরিবার সহ্য করে কীভাবে ?
সেই অমোঘ ডায়ালগ, “ভালোবাসা সত্য হলে একদিন নারীবাদী – পুরুষবাদীর মিলন হবেই হবেই হবেই।”
মাথাটা যখন আপনার আমার একটু ভেবে দেখলে ক্ষতি নেই বরং লাভ আমাদেরই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]