November 24, 2024
কলামফিচার ২

প্রসঙ্গ: টিপ

শাওন মাহমুদ ।। ভাষা আন্দোলন সৃষ্টির সময় থেকেই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর জাতীয় সম্মিলনে এক স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন সূচিত হতে থাকে। দল, মত, ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে “আমরা সবাই বাঙালি” এই স্লোগানে জনগণের স্বাধীন ভাবনার পথ হতে থাকে উন্মুক্ত। সেসময় থেকেই গণমানুষের তীব্র ঐক্যবদ্ধতা সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে থাকে। ঐক্যের জোরালো রশ্মি একাত্তরে আরো তীব্রতর হুংকার দিয়ে উঠেছিল। এ ভূমির মানুষ হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, বৌদ্ধ নয়, খ্রীষ্টান নয় – সমষ্টিগতভাবে তারা সবাই বাঙালি।

বাঙালির মিলিত প্রাণের কলরব এক অনন্য স্বকীয়তায় পৃথিবীর অন্যান্য ভূমি হতে একেবারে আলাদা এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। এবং এই স্বকীয়তা ছিল বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

সমষ্টিগত ভাবনা এবং জীবনযাপনের ধারায় এদেশে তৈরি হয়েছিল সমষ্ঠিগত উৎসব, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় পালন, লালন এবং উদযাপনের অভ্যাস। মুসলিম রীতির শবেবরাতে, ঈদ, শবেমেরাজ, রোজা বা চানরাত অন্য সকল ধর্মের মাঝে উদযাপনের উৎসব ছিল। হিন্দুদের পূজো, হোলি, ভাইফোঁটা পালন ছড়িয়ে পড়েছিল সব ধর্মের উঠোনে। খ্রীস্টানদের বড়দিন, ইস্টারে মুখরিত হতো পাড়া প্রতিবেশীরা। বহুমূখী ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, স্বকীয়তাকে উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর করতো।

প্রসংগ টিপ – গত দুইদিন আগে রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দারকে পুলিশের পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি ‘টিপ পরছোস কেন’ বলে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। প্রতিবাদ জানালে পুলিশটি তার মোটরবাইকের চাকা লতার পায়ের উপর উঠিয়ে দিয়ে আবারও খারাপ কথা বলতে বলতে চলে যায়। লতা সমাদ্দার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যদের ঘটনা জানালে তারা তাকে থানায় অভিযোগ দিতে বলেন। এই খবরটি সংবাদপত্রে আসা মাত্র অনলাইনে প্রতিবাদের ঝড় বইতে থাকে, যা এখনও চলছে।

স্বাধীন বাংলাদেশ এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে কপালে টিপ পরার বিষয়টিও যুগ যুগ ধরে সমষ্ঠিগত জীবনযাপনের সংস্কৃতি ধারায় ক্রমশ বাহিত হয়ে এসেছে। জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে আমাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সাজের নাম, টিপ বা তিলক। যা হাজার বছর ধরে বাংলা ও ভারতের ঐতিহ্যময় ইতিহাসের একটি ক্ষুদ্র অংশ বা প্রতীক মাত্র। ধর্মের অপব্যাখ্যা, নারী স্বাধীনতায় বাঁধা, সংস্কৃতি বিরোধীতা, শ্রেষ্ঠ অর্জন বাঙালির স্বকীয়তা ধ্বংস করবার প্রয়াসে যতই পরিকল্পনা করা হোক না কেন, যতদিন পৃথিবীর বুকে একজনও বাঙালির প্রাণ থাকবে তখনও সে নিজ স্বকীয়তার অবিরত আলোয় আঁধার ঘোচাবে শেষ মূহুর্তেও।

নারী পুরুষ নির্বিশেষে বেশির ভাগ মানুষ কপালে টিপ এঁকে ছবি তুলে তা তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে। আজ আবারও মনে হচ্ছে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হবার সময় এসেছে। আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সমষ্ঠিগত জীবন যাপনে বাধা সহ্য করবার সময় গড়িয়েছে। আজ আমার আবারও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে যে আমরা সবাই বাঙালির দেশ আবারও ফিরে আসবে তার অনন্য স্বকীয়তার দোলায় ভেসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *