টিপকাণ্ড: উল্টো পথে হাঁটছে আমার স্বদেশ
তানিয়া নাসরীন তৃপ্তি।।
“আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা”
মায়ের মুখে এই লাইনগুলো শুনে বড় হয়নি এমন মানব সন্তান এই বঙ্গদেশে নেই। অথচ সেই টিপ আজ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় (৯০’র দশকে) সব ধর্মের মায়েরা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে ৭/৮ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের চোখে কাজল আর বড় বড় টিপ পরাতেন। পুরনো অ্যালবাম খুঁজলে ছোটবেলার কাজল আর টিপ পরা ছবি অনেকেই পেয়ে যাবেন। আর এসব অ্যালবামে আরও পাবেন মা খালা চাচীদের শাড়ি পরে কপালে উঁচু করে টিপ পরা সাদাকালো ছবি। হলফ করে বলতে পারি এমন কোনো পুরনো ছবি নেই যেখানে বাঙালি নারীর কপালে টিপ নেই, তা তার ধর্ম যাই হোক না কেন।
আমাদের মায়েদের কালের ছবিতে দেখেছি কত প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও তারা বেল বটম প্যান্ট আর শার্ট পরেছেন। বান্ধবীরা মিলে সিনেমা দেখতে গেছেন। কিন্তু আমার কিশোরীবেলায় আমি উপজেলা শহরে থেকে সে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারিনি। ষাটের দশকে বাঙালি সমাজ সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটেছিল তা ক্রমাগতই সংকুচিত হয়েছে স্বার্থোদ্ধারে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয়ার কারণে।
এবার আসি মায়ের হাতের সেই কাজল আর টিপের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার সময়ে। ক্লাস ফোর ফাইভে থাকতেই হরহামেশাই টিপ পরতাম। টিপ না থাকলে নেলপলিশের টিপ পরতাম আমার পাশের বাসার মমতাজ খালাকে দেখে। মমতাজ গ্রামের মুসলমানের বউ হয়েও সব সময় কপালে লাল টিপ বা নেলপলিশের লাল টিপ পরে থাকতো। কপালে দাগ হয়ে গিয়েছিলো টিপ পরতে পরতে। আমাদের গ্রামের আরও খালা, মামী, ভাবি অনেকেই টিপ পরতেন। এমনকি স্লিভলেস বা ম্যাগি হাতার ব্লাউজও পরতেন অনেকেই। সেই ৯০ এর দশকেও কেউ তাদের অশ্লীল তকমা দিয়ে তাদের নিয়ে বিচার বসায়নি। কেউ তাদের নিগ্রহ করেনি কিন্তু আজ ২০২২ সালে করছে!
প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা দিতেই প্রথম টিপ নিয়ে বিপত্তি শুরু হলো। আমাদের স্কুলের একজন স্যার মেয়েদের টিপ পরা নিয়ে খুবই নিষেধাজ্ঞা দিতেন। এমন কি স্কুলের বাইরেও উনার ভয়ে ক্লাস এইট পর্যন্ত তেমন টিপ পরা হয়নি। কারণ উনি স্কুলে গেলেই জিজ্ঞেস করবেন ঈদে টিপ পরেছিলে কিনা, অমুক প্রোগ্রামে টিপ পরেছিলে কিনা। স্যার মানুষ, মিথ্যে বলবো কিভাবে! কিন্তু স্যারের সেসব কল্পিত ভয় আর ইমোশনাল ব্লাকমেইলিংয়ের শেকল ছিঁড়ে ফেলছিলাম ক্লাস নাইনে উঠেই। টিপ পরতাম কিছু হলেই, কিছু না হলেও টিপ পরতাম, বিকেলে হাঁটতে বের হলেও টিপ পরতাম, পড়ার টেবিলে বসেও টিপ পরতাম। বাবা মা বা আশপাশের কেউ কখনও টিপ পরতে নিষেধ করেনি। আমি সালোয়ার কামিজ পরা শুরু করেছি কলেজ থেকে; স্কুল জীবন পর্যন্ত ফ্রক, স্কার্ট পরেই কেটে গেছে। ফ্রক/স্কার্টের ঝুল বা ওড়নার অভাব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কারণ তখন আমার বয়সী সব মেয়েদের স্বাভাবিক পোশাক ওমনই ছিল। কিন্তু এখন কিশোরীদের অবস্থা দেখে আমার ভয় হয়। ঢাকার স্কুলগুলোতে ছেলে মেয়ে আলাদা ক্লাস করানো হয়, তবুও ছোট ছোট মেয়েগুলোকে অ্যাপ্রোন পরিয়ে বিশাল ওড়না পেঁচিয়ে তারপর স্কুলে যেতে হয় এই গরমেও। এতটুকু মেয়েরা এত বড় ওড়না সামলে রিক্সায় চড়ে কিভাবে হাঁটাচলা করে! আমি কম্বাইন্ড স্কুলে পড়েও তো শুধু ভি ওড়নাই পরেছি।
কলেজে ওঠার পর সাজসজ্জার স্বাধীনতা আরও একটু বাড়লো। বিভিন্ন পোশাকের সাথে ম্যাচিং টিপ পরতাম। আর সাদা কলেজ ড্রেসের সাথে ছোট কালো টিপ প্রায় সব মেয়েদের নিত্যসঙ্গী ছিল। আমাদের কলেজের ইতিহাস ম্যাডাম প্রতিদিন সুতি শাড়ি পরতেন। আর শাড়ির সাথে পরতেন মেরুন লিপিস্টিক ও বড় বড় মেরুন কালারের গোল টিপ। “মায়ের মতই ভালো” সেই শ্যামাঙ্গিনীর সেই মিষ্টি হাসি আর সুমধুর বাচনভঙ্গি আমার হৃদয়ে আজও দাগ কেটে আছে। ২০০০ সালের দিকে একটা উপজেলা শহরের কলেজ শিক্ষিকা বড় টিপ পরে চলতে পেরেছেন কিন্তু আজ ২০২২ সালে ঢাকা শহরের শিক্ষিকা টিপ পরার কারণে হেনস্তা হচ্ছেন।
এবার আসি কৈশোর থেকে তারুণ্যে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা প্রাইমার, ফাউন্ডেশন, হাইলাইটার ইত্যাদি কোনো মেকআপ বা সাজসজ্জা চিনতাম না। আমাদের সাজ ছিল বড় বড় টিপ। আর বেশি হলে কাজল। লিপিস্টিকও তেমন কেউ পরতো না। খুব বেশি হলে হালকা লিপগ্লস। আমরা শাড়ি পরলে টিপ পরতাম, সালোয়ার কামিজ পরলে টিপ পরতাম, জিন্স ফতুয়া পরলেও টিপ পরতাম, স্কার্ট পরলেও টিপ পরতাম, ক্লাসে যাওয়ার আগে টিপ পরতাম, বাজার করতে গেলে টিপ পরতাম। মোটামুটি জীবন ছিল টিপময়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টিপের রঙ থাকতো লাল। তখনও আমি এই বাংলায় ছিলাম, তখনও আমি মুসলমানই ছিলাম। তখন আমাদের কেউ বলেনি হিন্দুয়ানী টিপ কেন পরেছো। এমনকি আমরা তখন এমন ফুলস্লিভ আর লম্বা ঘেরওয়ালা বোরখা টাইপ জামা (বর্তমান ফ্যাশন) পরতাম না। ছোট হাতার ছোট ছোট জামা পরতাম। পুরাতন ছবি ঘেটে দেখছি সেসব ছবি অশ্লীল তো লাগে না। কিন্তু এখন একটা ছোট হাতার জামা পরা স্বপ্নের মত হয়ে উঠছে দিনদিন। মুখে অনেকেই কিছু না বললেও সবাই এমনভাবে তাকাবে যেন খুব অপরাধ করে ফেলেছি। আর নামীদামী ফ্যাশন হাউসগুলোও ব্যবসা জমজমাট রাখতে জামাকাপড়ের ডিজাইন করছে পাব্লিক ডিমান্ড অনুযায়ী। তাই না পরে উপায় নেই। পুরো সিস্টেম যখন একদিকে চলবে তখন বিপরীত দিকে চলতে পারা মানুষের সংখ্যা কমই হবে। তাই যত দিন যাচ্ছে ভয় বাড়ছে। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে উন্নতির দিকে গেলে অবশ্যই সেই সিস্টেমের সাথে তাল মিলিয়েই চলতে রাজি কিন্তু যেভাবে উল্টো পথে হাঁটছে, তার সাথে তাল মেলাবো কিভাবে!
তারপর এলো চাকুনি জীবন, এখনও আমি টিপ পরি। তবে আগের মত না, এখন শুধু অফিসে শাড়ি পরলে টিপ পরি, তাও খুব ছোট ছোট। আর একমাত্র কারণই বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক চাপ। অফিসে ৯০’র দশকে যোগদান করা আর ২০১৮/১৯ এ যোগদান করা নারী সহকর্মীদের গ্রুপ ছবি দেখে (পোশাক ও সাজসজ্জা) কিছুদিন আগে আতঙ্কিত বোধ করছিলাম। সমাজের উচ্চস্তরে থেকেও যে সামাজিক চাপ আমাকে বাঁধা দিচ্ছে আমার স্বাভাবিকতায়, আমার ভালো লাগায়, সেখানে সর্বস্তরের নারীর দশা কী হয়! আমরা ক্রমেই উল্টো দিকে হাঁটছি তার প্রমাণ চারপাশ বড় বড় ক্ষতে দগদগ করছে শুধু।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]