November 2, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

নারীবাদ নিয়ে নামকরণের বৈচিত্রময়তা ও বিশ্বাসী মানুষের সংগ্রাম

বাংলা ভাষার ব্লগার, সামাজিক – রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এক সময়ের সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, যিনি স্বপ্ন দেখেন একটি লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক সংস্কৃতি ও সমাজের। নারীবাদ তাই তার চিন্তা, পড়াশোনা ও লেখালেখির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন – ইসলামী নারীবাদ: মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষের সংগ্রাম। আজ পড়ুন এর দ্বিতীয় পর্ব।।

নারীবাদ কি? এই প্রশ্নটির হয়তো খুব বেশি উত্তর ছিল না মাত্র কয়েকযুগ আগেও। কিন্তু আজকের সময়ে নারীবাদী আন্দোলনের যে অজস্র ধারার উপস্থিতি সেই প্রেক্ষিতে এই সহজ প্রশ্নটি শুধু জটিলই হয়ে ওঠেনি, এই প্রশ্নটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। আসলেই কি নারীবাদ বলে কিছু আছে? আসলেই নারীবাদ বলে কোনো কিছুর দরকার আছে? সাধারণভাবে মানুষের মুক্তির সংগ্রামের সাথে নারীবাদের সম্পর্ক কী? মানুষের সামগ্রিক মুক্তির সংগ্রাম, মানুষের বিরুদ্ধে হওয়া বিদ্যমান শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরে কি আলাদা করে নারীর মুক্তির সংগ্রামের দরকার আছে? একটা সময় পর্যন্ত মার্কসবাদী রাজনৈতিক তাত্ত্বিকগণের একটি বড়সড় যুক্তির জায়গা ছিল পিতৃতন্ত্র আসলে পুঁজিবাদেরই আরেকটি রূপ, পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার শেকড়সুদ্ধ বিলোপ করতে পারলেই সমাজে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। কিন্তু ইতিহাসে সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলোর অভিজ্ঞতা সেই দাবিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে নারীর বহিরাঙ্গনের জীবনকে অনেকটাই মুক্ত করেছে বটে, কিন্তু তাকে নারীর সমানাধিকার অর্জন বলতে অনেকেই আপত্তি করবেন। তাহলে নারীবাদের আসল লক্ষ্যটি কী?

নারীবাদী তাত্ত্বিক বেলহুকস তাঁর লেখা ‘Feminism for everybody’[1] গ্রন্থে খুব সহজ ও প্রাণবন্তভাবে এই বিষয়টির অবতারণা করেছেন। তিনি এই বইয়ে লিখছেন – “‘নারীবাদ হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদী শোষণের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম, সকল রকমের পিতৃতান্ত্রিক শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রাম”। লিঙ্গ বৈষম্যবাদী শোষণের ভিত্তি হচ্ছে নারীর উপরে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব’র দাবি। আর এই লিঙ্গ বৈষম্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চালিত রাজনৈতিক – সাংস্কৃতিক  সংগ্রামই হচ্ছে নারীবাদ। বেল হুকস ও তার সমসাময়িক নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন প্রচলিত অর্থে ‘মানুষের বিরুদ্ধে হওয়া শোষণ’ এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরেও কেন নারীর নিজের মুক্তির সংগ্রামটি জরুরি। এই প্রশ্নে প্রধান নারীবাদী তাত্ত্বিক ধারাগুলোও নিজেদের মাঝে তফাত রচনা করে চলেছে।  আবার নারীবাদ নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শ্বেতাঙ্গ আভিজাত্যবাদের অভিযোগে পশ্চিমের নারীবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদীদের দ্বারা। পশ্চিমের নারীবাদী ধারার একটি অংশ শুরু থেকেই ঔপনিবেশিক ও পুঁজিবাদী শক্তির তাবেদার হিসাবে হাজির থেকেছে ইতিহাসে, এই অভিযোগ এসেছে মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রী নারীবাদীদের কাছ থেকে। ন্যান্সি ফ্রসার বা লিজ ভোগেল এর মতো নারীবাদীরা পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ আভিজাত্যবাদী নারীবাদকে পুঁজিবাদ ও সাম্প্রতিক কালের চরমডানপন্থী নয়া-উদারনৈতিক রাজনীতির বিছানাসঙ্গী হিসাবে উল্লেখ করেছেন। নারীবাদ নিয়ে এই রকমের একটি জটিল বোঝাপড়ার সময়ে এই লেখাটি নারীবাদের একটি বিশেষ ধারার উপরে আলোচনা হাজির করতে চাচ্ছে, তা হচ্ছে ইসলামী নারীবাদ বা বিশ্বাসী মুসলিম নারীর সমানাধিকারের সংগ্রামকে।

তবে এই লেখায় ‘ইসলামী নারীবাদ’ ও ‘ইসলামী নারীবাদী’ হিসাবে যে আলোচনাটি ও যাদের লেখালেখি পর্যালোচনা করা হবে তাদের অনেকেই নিজেকে ‘নারীবাদী’ হিসাবে ঘোষণা করেন এবং নিজেদের লেখালেখিকে ‘নারীবাদ’ হিসাবে উল্লেখ করেন, আবার অনেকেই তা করেন না। তবে তাদের লেখালেখির একটা বড় অংশ যেহেতু নারী ও ইসলামকেই ঘিরে আবর্তিত সে কারণে তাদের নিজেদেরকে ইসলামী নারীবাদী বা মুসলিম নারীবাদী হিসাবে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা নেই। আবার অনেকেই নিজেদেরকে বিশ্বাসী মুসলিম দাবি করলেও রাজনৈতিক মতামতের দিক থেকে নিজেদেরকে সেকুলার ও উদার গণতন্ত্রী দাবি করে থাকেন, সেই হিসাবে এই বর্গের নারীবাদীরাও নিজেদের লড়াইকে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলে দাবি করলেও নিজেদের মতবাদিক অবস্থানকে কেবল ‘নারীবাদ’ হিসাবেই উল্লেখ করে থাকেন (আবশ্যিকভাবে ‘ইসলামী’ নারীবাদ নয়)। আবার এর ভিন্ন ধারার মানুষেরাও রয়েছেন যারা মনে করেন ‘ইসলামী নারীবাদ’ বলে আসলে তেমন কিছু নেই, যা আছে তা হচ্ছে বিশ্বাসী মানুষ বিশেষত বিশ্বাসী নারীদের সংগ্রাম, বিশ্বাসী নারীদের সংগ্রামকে ‘নারীবাদ’ বলার আপত্তিকর দিক উল্লেখ করেছেন অনেকেই। কেননা বিশ্বাসী নারীদের অনেকেই মনে করেন নারী পুরুষের সমতার বিষয়টি তাদের ধর্ম বিশ্বাসেরই অংশ, তাই সমানাধিকারের লড়াই তাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠারই লড়াই, অন্য কিছু নয়।

বাংলায় আমরা ‘নারীবাদ’ শব্দটিকে মূলত ইংরেজি শব্দ Feminism এর বাংলা অর্থ হিসাবে নিয়েছি। অর্থাৎ ইংরাজি Feminism শব্দটি দিয়ে প্রধানত আমরা যা বুঝি সেসব ধারণা বা বোঝাপড়াগুলোকে আমরা সহজ করে নাম দিয়েছি ‘নারীবাদ’। ইসলামের ঐশী  গ্রন্থ  কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে আল্লাহ কুরআন নাজেল করেছেন আরবি ভাষায় যেন নবী মুহাম্মদ সহ এর অনুসারীদের বুঝতে সমস্যা না হয়। আদি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা ছিলো আরবি কিন্তু ইসলাম প্রসারিত হবার সাথে সাথে আজকের দুনিয়াতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশটিই আর আরবি ভাষাভাষী নয়। কিন্তু আজকের পৃথিবীর বেশীরভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাষা আরবি না হলেও, যেহেতু ধর্ম হিসাবে ইসলাম এর আবির্ভাব ও যাত্রা শুরু হয়েছিল আরব অঞ্চলে এবং যেহেতু ইসলাম ধর্মের প্রধান গ্রন্থ কুরআনসহ এর প্রথম দিককার অপরাপর গ্রন্থ ও বয়ান সমূহ রচিত হয়েছিল আরবিতে এবং এখনও মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মচর্চার প্রধান ভাষা আরবি, তাই আরবি ভাষায় নারীবাদ প্রসঙ্গটিকেই প্রথমে অনুসন্ধান করেছেন নারীবাদী গবেষকদের অনেকেই। মারগোত বদরান ও মিরিয়াম কুক বলছেন[2], প্রকৃত অর্থে আরবি ভাষায় আজকের সময়ের ইংরেজি ‘Feminism’ শব্দটির ঠিক সরাসরি সমার্থক কোনো শব্দ নেই। এখনও নেই। ইংরেজি ফেমিনিজম শব্দটির খুব কাছাকাছি অর্থ প্রকাশ করে এমন একটি শব্দ প্রথমবারের মতো লিখিত রচনায় ব্যবহার হয় ১৮৬০ সালে একজন আরব নারী কবির কবিতায়। আরবি ভাষায় ‘ফেমিনিজম’ এর সমার্থক শব্দ নেই বটে কিন্তু আরব নারীর রাজনৈতিক বয়ানে, আলোচনার প্রসঙ্গে নারীর মুক্তির প্রসঙ্গ হিসাবে ইংরেজি ফেমিনিজম এর কাছাকাছি কিছু বোঝাপড়া প্রথম নিয়ে আসেন  মিশরের নারী সক্রিয়তাবাদী লেখক মালাকা হিফনি নাসিফ। মালাকা হিফনি নাসিফ মিশরের উম্মা পার্টির মুখপত্র আল-জারিদা পত্রিকায় ছদ্মনামে লিখতেন, ‘বাহিতাত আল বাদিয়া’ লেখক নাম (pen name) নিয়ে। তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ লেখেন পরবর্তীকালে ১৯০৯ সালে একটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় “আল-নিসায়াত” শিরোনামে। ইংরেজি ফেমিনিজম বা বাংলায় নারীবাদ বলতে আজকে আমরা যা বুঝি আরবি ‘নিসাইয়াত’ শব্দটি দিয়ে আক্ষরিক অর্থে তেমনটি বোঝায় না, বরং ‘নারী সংক্রান্ত’ বা ‘নারীর দ্বারা’ বা ‘নারীর প্রসঙ্গে’ এই রকমের অর্থ বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু ‘আল-নিসাইয়াত’ বইটির দুই মলাটের ভেতরে যে বিষয়বস্তু, আলোচনা ছিল তার সবই আজকের মতোই নারীর অধিকার ও তার বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ নিয়ে। যদিও পশ্চিমে এখন ফেমিনিজম শব্দটির বহু বিচিত্র অর্থ ও বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। খুব সহজে ফেমিনিজম বা নারীবাদকে সংজ্ঞায়িত করাই কঠিন হয়ে উঠেছে এই সময়ে। মারগোত বদরান ও মিরিয়াম কুক আরব নারীবাদীদের লেখালেখি পর্যালোচনা করে ইসলামী নারীবাদের একটি মোটাদাগের সংজ্ঞা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কুক ও বদরানের মতে[3]

দুই শতকের আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের লেখালেখি থেকে মুসলিম বিশ্বাসী নারীদের সংগ্রামকে আমরা নারীবাদ বা যে নামেই ডাকিনা কেন, সেটা আসলে নারীর এক ধরনের সচেতনতার অবস্থান যা নারীকে শুধুমাত্র তাঁর লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে যে পদ্ধতিগত বঞ্চনার শিকার হতে হয় সে সম্পর্কে অবহিত করে, তার উপরে চাপিয়ে দেয়া আচরণ আর চিন্তাপদ্ধতিকে ছুড়ে ফেলতে এবং তা করার মধ্যে দিয়ে তার নিজের অবস্থান ও জীবনকে বদলে ফেলতে প্রণোদিত করে।

মিরিয়াম কুক ও মারগোত বদরান এভাবেই মুসলিম বিশ্বাসী নারীদের ঐতিহাসিক সচেতনতা ও সংগ্রাম কে উল্লেখ করেছেন। তুলনামূলকভাবে এই সংজ্ঞাটি আধুনিক পশ্চিমা নারীবাদী তাত্ত্বিক বেল হুকস এর দেয়া নারীবাদের সংজ্ঞার একেবারেই কাছাকাছি বোধ। সুতরাং আরবি ভাষায় সরাসরি ‘নারীবাদ’ বা ‘ফেমিনিজম’ এর মতো শব্দ না থাকলেও ঐতিহাসিক চেতনাগত ভাবে বিশ্বাসী মুসলিম নারী (এবং পুরুষও বটে) তাঁর নানামুখী সক্রিয়তাবাদী তৎপরতার মধ্যে দিয়ে  আসলে নারীবাদেরই চর্চা করেছেন গত দুইশ বছর ধরে। কখনও বা নিজের পরিবারের মধ্যে, কখনও নিজের সমশ্রেণির মানুষের মাঝে আবার কখনও বা দেশি ও ভিনদেশি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কখনও কখনও নারীর এই সক্রিয়তাবাদ নিজের পিতার বা স্বামীর প্রশ্রয়ের গণ্ডীর মাঝেই ঘুরপাক খেয়েছে আবার কখনও বা পিতা, স্বামী’র সুরক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে, বা খোদ পিতা ও স্বামীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই নিজের জীবন দিয়ে নারী তাঁর অধিকার পাবার সংগ্রামে অংশ নিয়েছে।

এই রকমের একটি অবস্থায় নারীবাদের আরও এক বা একাধিক ধারা হিসাবে ‘ইসলামী নারীবাদ’ ও ‘ইসলামী নারীবাদী’ এই দুটি নামকরণ প্রথমেই পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। অন্তত এই লেখার ক্ষেত্রে একটা বিষয়  কবুল করে নেয়া দরকার যে এই নামকরণগুলো খুব শক্ত বাধনের নামকরণ নয়, ইংরাজিতে যাকে আমরা বলি ‘Loosely Defined’ বা খুব ঢিলেঢালা ভাবে বা মোটা দাগে কোনো কিছুকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা আর কি। অর্থাৎ ইসলামী নারীবাদ বলতে সাধারণ অর্থে বিশ্বাসী মুসলিম নারীদের নারীমুক্তি ও সমানাধিকারের সংগ্রাম নিয়ে লেখালেখিকে সহজ করে আলাপ করার একটা প্রচেষ্টার জন্যেই এই নামকরণ। মুসলিম সমাজের ইতিহাসে নারীদের সংগ্রামের অন্তত প্রথম দিককার ইতিহাস বলছে পশ্চিমা নারীবাদের মতোই মুসলিম সমাজেও নারীর অধিকারের যে অসমতা তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের শুরু হয়েছিলো অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীদের হাতেই। Shahrzad Mojab তাঁর Theorizing the Politics of ‘Islamic Feminism[4]‘ প্রবন্ধে লিখছেন এই সকল অভিজাত নারীরা ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন, ইসলামের মৌলিক টেক্সট বা আখ্যানগুলো সম্পর্কে এঁদের গভীর পড়াশুনা ছিল, ফলে তাঁরা জানতেন নারী ও পুরুষের অধিকার সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে ইসলামের ঐশী গ্রন্থ কী বলে আর সেই সকল টেক্সট এর কত ধরনের ইন্টারপ্রিটেশন বা বোঝাপড়া তৈরি হয়।  ফলে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নারীর এই অসমতাকে তাঁরা অযথাযথ মনে করতেন এবং সেকারণেই সেই বিষয়ে তাদের ভিন্নমতের কথা নিজ শ্রেণীর পুরুষদের কাছে তুলে ধরতেন। কখনো লেখালেখির মাধ্যমে কখনো বা আপাত প্রতিবাদের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের নিজ শ্রেণির বাইরে সত্যিকারের বঞ্চিত নারীদের অর্থাৎ সাধারণ অনভিজাত নারীদের মাঝে তাদের এই লেখালেখি কতটা পৌঁছুতে পেরেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে শাহারজাদ মোজাব। তাই তিনি তাঁর প্রবন্ধে সন্ধিগ্ধ প্রশ্ন রেখেছেন সেই সময়ের মুসলিম সমাজের নারীদের এই সকল প্রতিবাদকে ‘নারী বিষয়ক সচেতনতা’ (Feminine Consciousness) বলা যাবে নাকি ‘নারীবাদী সচেতনতা’ (Feminist Consciousness) বলা হবে? কেননা সেই সময়ের নারীদের এই সকল লেখালেখি কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ছিলনা, এমন কি এই সকল প্রতিবাদের কোন নির্দিষ্ট সাংগঠনিক রূপও দেয়া যায়নি। উনিশ শতকের আগের মুসলিম নারীর সংগ্রামকে শাহারজাদ মোজাব সরাসরি নারীবাদী সংগ্রাম না বললেও অনেক সাম্প্রতিক নারীবাদী সেই সকল সংগ্রামকে ‘নারীবাদী’ সংগ্রামের অংশ হিসাবেই গণ্য করেছেন। সেকারণেই ১৯৯০ এর পর থেকে আধুনিক নারীবাদীদের অনেকেই মুসলিম নারীর ইতিহাসের এই পর্ব অর্থাৎ উনিশ শতক থেকেই মুসলিম বা ইসলামী নারীবাদের সূচনা বিন্দু হিসাবে ধরে এর আলোচনাগুলোকে বিন্যস্ত করেছেন। আবার অন্যদিকে আধুনিক সময়ের মুসলিম ও বিশ্বাসী নারীদের মাঝে যারা উল্লেখযোগ্যভাবে নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নটিকে ইসলামের কাঠামোর ভেতরে থেকেই মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন, তাদের কেউ কেউ এই সকল সংগ্রামকে ‘নারীবাদ’ ও ‘ইসলামী’ বলতে নারাজ। আবার কেউ কেউ একে ‘নারীবাদ’ বলতেও নারাজ। আসমা বারলাস, মুসলিম নারীর অধিকার প্রসঙ্গে আধুনিক সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য ইসলামী তাত্ত্বিক হলেও তিনি নিজেকে ‘নারীবাদী’ বা ‘ইসলামী নারীবাদী’ হিসাবে উল্লেখ করেন না এবং করতে চান না। এমন কি তিনি মনে করেন মুসলিম নারীর যে পিতৃতন্ত্র বিরোধী সংগ্রাম তাকে ‘নারীবাদী’ বলে সংজ্ঞায়িত করা যথাযথ হবেনা,  কেননা ইংরেজি Feminism শব্দটি এতো বহু বিচিত্র সব ধারাকে অন্তর্ভুক্ত করে যে এই অতি- অন্তর্ভুক্তিকরন প্রায়শই পরস্পর বিরোধী ধারাগুলোকেও একই নামের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে যা তার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হয়না। আবার বারলাস মনে করেন ইংরাজি ‘feminism’ শব্দটির মাঝেও এক ধরনের ভাষাগত কর্তৃত্ববাদীতা রয়েছে, অর্থাৎ যা কিছু নারীর সমতার সংগ্রাম তাকেই যেন এই একটি শব্দেই প্রকাশিত হতে হবে, যা তাঁর কাছে যথাযথ মনে হয়না। ‘ইসলামী নারীবাদ’ ধারণার বিষয়ে বারলাসের আরও একটি আপত্তির যায়গা হচ্ছে কোন কিছুকে ‘ইসলামী’ বলে সংজ্ঞায়িত করার একটা সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের নামকরণ এই সকল চিন্তার ‘অন্য কিছু’ হয়ে ওঠার রাস্তাটা বন্ধ করে দেয়, অর্থাৎ বিশ্বাসী মুসলিম নারীর মুক্তির সাথে সংশ্লিস্ট এই সকল চিন্তাকে কেবল ‘ইসলামী’ ও ‘নারীবাদ’ নামেই ডাকতে হবে, এটা এক ধরনের ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক নিপীড়ন’ এর সমতুল্য মনে করেন তিনি।

আবার ইরানী নৃতত্ত্ববিদ জেবা মীর হোসেইনি মনে করেন ‘ইসলামী নারীবাদ’ একটা প্রায় অসম্ভব প্রস্তাবনা এই কারণে যে খোদ ‘ইসলাম’  কিংবা ‘ নারীবাদ’ (‘Islam’ and ‘Feminism’) এই দুটি ধারণার কোনোটিকেই একটি স্থির সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই দুটি ধারণা একই সাথে অনেক ধরন, স্বরূপ নিয়ে হাজির হতে পারে, একই সময়ে, একই প্রেক্ষিতে। অর্থাৎ ‘ইসলাম’ একই নামে বহু ধরন নিয়ে হাজির আছে আমাদের মাঝে, আবার ‘নারীবাদ’ও একই নামে বহু ধরন নিয়ে উপস্থিত আমাদের মাঝে, সে কারণেই ‘ইসলামী নারীবাদ’ একই সময়ে অজস্র মতামত কে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে যে সকল মতামত হয়তো প্রায়শই পরস্পর সংগতিপূর্ণ নাও হতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার নারীবাদী তাত্ত্বিক সাদিয়া শেখ উপরের মতামতগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে ‘নারীবাদ’কে কেবল পশ্চিমা হিসাবে আলাদা করে দেয়ার মানে হচ্ছে পশ্চিমের বাইরে সারা দুনিয়া ব্যাপী নারীর যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম তাকে উপেক্ষা করা, প্রান্তিক হিসাবে তাকে ঐতিহাসিক গণনার বাইরে ঠেলে দেয়া।

‘নারীবাদ’ ও ‘ইসলামী নারীবাদ’ নিয়ে এই সকল বিতর্কে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম – অমুসলিম নারীবাদী অংশগ্রহণ করেছেন। আমিনা ওয়াদূদ, জেবা মীর হোসেইনি, ভ্যালেন্টাইন মোঘাদাম, মিরিয়াম কুক, সাইদিয়া শেইখ, উমাইমা আবু বকর, মারগোত বদরান, আসমা বারলাস, আয়িশা হিদায়াতুল্লাহ, রিফাত হাসান, আজিজাহ আল হিবরি এর মতো নারীবাদী তাত্ত্বিকগণ এই বিতর্কের উল্লেখযোগ্য নাম। এই সকল নারীবাদীদের মাঝে মতামতের তফাত বহু বিচিত্র ও প্রান্তিক। একদিকে এঁদের কেউ কেউ মনে করেন ইসলাম ও নারীবাদ ভীষণ আলাদা দুটি বিষয় আবার কেউ কেউ মনে করেন নারীর সমঅধিকারের প্রশ্নটি ইসলামের এতোটাই মজ্জাগত বিষয় যে নারীবাদ ও ইসলাম অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পর্কিত একটি প্রসঙ্গ।

এই বিতর্কের মাঝ থেকে মুসলিম নারীদের এই সকল চিন্তাকে ‘ইসলামী নারীবাদ’ হিসাবে সুপষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন মিশরীয় নারীবাদী ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক মারগোত বদরান। তিনি দুটি কারণে ‘ইসলামী নারীবাদ’ (ইংরাজিতে Islamic feminism’) শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন, প্রথমত – এর মাধ্যমে যারা মনে করেন যে ‘ইসলাম’ ও ‘নারীবাদ’ দুটি পরস্পর বিরোধী ধারণা, তাদের চিন্তাকে মোকাবিলা করা যাবে এবং দ্বিতীয়ত – ‘ইসলামী নারীবাদ’ এই বর্গের অধীনে মুসলিম বিশ্বাসী নারীদের নিজেদের মুক্তিসংগ্রামের সকল আলাপকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

মুসলিম বিশ্বাসী সক্রিয়তাবাদীদের কাছে ‘নারীবাদ’ এর আগে ইসলামী শব্দটির প্রাসঙ্গিকতা হচ্ছে এই নারীবাদী বা নারীমুক্তি সংগ্রামীদের প্রায় সকলেই নারীর সমতার প্রশ্নটি ব্যাখ্যা করেছেন ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিক থেকে। এঁরা মুসলিম পিতৃতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের গড়ে ওঠা ও বিকাশের সূত্র ধরেই। এই নারীবাদীদের প্রায় সকলেই নারীর সমতার প্রশ্নটিকে ইসলামী বিশ্বাস পদ্ধতির একটা মৌলিক অংশ হিসাবেই হাজির করেছেন এবং সে কারণেই নারীর সমতার লড়াইটি এই নারীবাদীদের কাছে কোন পার্থিব সংগ্রাম বা দায়িত্ব নয়, বরং নারীর সমতার লড়াই এঁদের কাছে তাদের ধর্মবিশ্বাসেরই অংশ, আধ্যাত্মিক বা spiritual fight এর অংশ। সেজন্যেই এই আলোচনায় মুসলিম বিশ্বাসী নারীদের যে সংগ্রাম সেই নারীবাদী সংগ্রামকে  এক নামে ‘ইসলামী নারীবাদ’ হিসাবেই নেয়া হয়েছে।

আরেকটি বিষয় বলে নেয়া দরকার, তা হচ্ছে উনবিংশ শতকের ইসলামী নারীমুক্তির প্রথম দিকের সংগ্রামীরা নিজেদের কোনো অর্থেই সুনির্দিষ্টভাবে ‘নারীবাদী’ বা ‘ফেমিনিস্ট’ দাবি করেন নি। বরং এই শতকের নারীমুক্তির স্বপক্ষের মানুষেরা মূলত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছিলেন এবং এঁদের প্রত্যাশা ছিল উপনিবেশ বিরোধী শক্তির বিদায়ে এই দেশগুলোতে নারীর মুক্তি ঘটবে। যদিও বাস্তব ইতিহাসে তা ঘটেনি। ঠিক যেভাবে সমাজতন্ত্রী নারীবাদীদের মোহভঙ্গ ঘটেছিল সমাজতন্ত্র কায়েম ও নারীর মুক্তি বিষয়ে একইভাবে মোহভঙ্গ ঘটেছিল বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত মুসলিম নারী আন্দোলনকারীদের মাঝেও। প্রথমে মিশরে এবং পরবর্তীকালে ইরানে, ইতিহাস প্রমাণ করেছে বিদেশি দখলদারের বিদায় দেশীয় দখলদারদের হাত থেকে নারীকে মুক্তি দেয়না। ইতিহাস বলছে আরব, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও পারস্যের ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে উপনিবেশমুক্তির পরে নারী বন্দী হয়েছে তার স্বদেশীয় ধর্মীভিত্তিক পিতৃতন্ত্রের কাছে।দেশ মুক্তি পেয়েছে উপনিবেশ পরিচয় থেকে কিন্তু নারী মুক্তি পায়নি তার প্রতি হওয়া শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে। একই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি আফগানিস্তানে সোভিয়েত ও মার্কিন দখলদারদের বিদায়ে সবচাইতে বড় পরাজয় ঘটেছে আফগানিস্তানের নারীদের। দেশ শত্রু দখলমুক্ত হয়েছে বটে তবে নারী প্রবেশ করেছে দীর্ঘমেয়াদী বন্দিত্বের কারাগারে। ইরানের নারীবাদী সক্রিয়তাবাদী ও বিদ্যায়তনিক পণ্ডিত হাইদে মোঘিসি তাই লিখেছেন – ‘ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের একমাত্র পরাজিত শক্তি হচ্ছে নারী। কেননা শাহ’র আমলের তুলনায় এই নতুন মোল্লাতান্ত্রিক শাসনে নারী ক্রমাগত ভাবে তার অধিকার হারিয়েছে’। ইরানের ইসলামী বিপ্লব কিভাবে নারীর মনুষ্য অধিকার, সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনি ও পারিবারিক অধিকার  হরণ করেছে সেসব নিয়ে ইরানের নারীবাদীদের অজস্র লেখালেখি, গবেষণাকর্ম রয়েছে।

এ কারণেই মুসলিম নারীর মুক্তির সংগ্রাম আলাদা করে আলাপের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। মুসলিম সংগ্রামী নারীকে নারীবাদী বা বিশ্বাসী সংগ্রামী নারী যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাঁর সংগ্রামটি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধেই। এখানেই সারা দুনিয়ার অন্যান্য নারীমুক্তি সক্রিয়তাবাদীদের সাথে মুসলিম নারীর মৈত্রীর বন্ধন, কেননা দুজনের সংগ্রাম একই নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বরং মুসলিম নারীর সংগ্রামটি সেক্যুলার নারীবাদীদের সংগ্রামের চাইতেও অধিক কঠিন, দুস্তর। কেননা মুসলিম নারীকে প্রথমে তাঁর ধর্মের সাথে, বিশ্বাসের সাথে মোকাবিলা করতে হয়, তারপরে সেই ধর্মের উপড়ে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। সেকুলার নারীবাদীদের সংগ্রাম বরং আজকের যুগে তুলনামূলক ভাবে অনেক সরাসরি কেননা তাদেরকে আলাদা করে বিশ্বাসের সাথে মোকাবিলা করতে হয়না।

[1] Hooks, Bell. 2014. Feminism Is for Everybody. 2nd ed. London, England: Routledge.

[2] Badran, Margot & Cooke, Miriam (1990). Opening the Gates a Century of Arab Feminist Writing. Bloomington: Indiana University Press.

[3] Margot Badran and Miriam Cooke. (2004). Opening the gates : an anthology of Arab feminist writing. Bloomington, Ind. :Indiana University Press,

[4] Mojab, S. (2001). Theorizing the Politics of “Islamic Feminism.” Feminist Review, 69, 124–146. http://www.jstor.org/stable/1395633

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *